বাক্স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হল গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা, এ কথা বলে গিয়েছেন পণ্ডিতরা। তর্কবিতর্কও কম হয়নি এ নিয়ে। বাক্স্বাধীনতার পরিসর ব্যবহার করেই আবার অনায়াসে অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার হনন বা লঙ্ঘন করা যায়, ফলে সাধু সাবধান। আমেরিকার ‘ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট’-এর কথা মনে করা যেতে পারে। ব্রিটেন ও ভারতের মতো প্রাচীন ও বৃহৎ গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কবচের কথাও মনে করা যেতে পারে। কিন্তু বাক্স্বাধীনতার বিরুদ্ধের যুক্তিটিকে আক্রমণের অস্ত্র শাণিয়ে সমগ্র গণতন্ত্রের উপরেই যে তীব্র কশাঘাত এখন চলছে— এমনটা আগে খুব বেশি দেখা যায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্প সে দিক দিয়ে ইতিহাস রচনা করলেন। বিশ্বের বহু গণতন্ত্রপন্থী দেশেই এখন এই একই প্রবণতা— ভারতীয় নাগরিককে তা আর মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। তবে ট্রাম্পের আমেরিকা যা করছে, আমেরিকার অন্যান্য কীর্তিকলাপের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই তাকে বিশ্বরেকর্ড বলা চলে। সাম্প্রতিকতম রেকর্ডটি অবশ্য তৈরি হল ট্রাম্পের আমেরিকা নয়, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির আমেরিকার সৌজন্যে। প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে হার্ভার্ড তাদের মুখের উপর স্পষ্ট বলে দিল যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কিছুতেই মাথা নত করবে না, যা-ই ঘটুক না কেন। সাম্প্রতিক পৃথিবীতে এর তুল্য উদাহরণ আর দেখা গিয়েছে কি? ঠিকই, উৎকর্ষের গরিমা, অর্থসম্পদের নিশ্চয়তা ছাড়া এই প্রতিস্পর্ধা ঘটতে পারত না। তবুও বলতেই হয়, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বনাম আমেরিকান ইউনিভার্সিটির এই অসামান্য চিত্রনাট্যটি যে রচিত হতে পারল, তার অন্যতম কারণ নিহিত আছে— মুক্তচিন্তা বা অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার দর্শনে। রাষ্ট্রীয় ‘আইডিয়োলজিক্যাল ক্যাপচার’ বা আদর্শগত বন্দিত্ব স্বীকার না করার দর্শনে। ভোলা যাবে না, গত কয়েক বছরে এই ইউনিভার্সিটিও ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের মতপ্রকাশে বাধা দান করেছে। তবু ট্রাম্প ২.০ যুগের এক কঠিন মুহূর্তে এমন দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি আজ সমস্ত স্বাধীনচেতা গণতন্ত্রী দুনিয়ার অভিবাদন দাবি করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু একা কিছু করছেন না। তাঁর কোনও পদক্ষেপই পাগলামি নয়, মাথাগরমের বাড়াবাড়ি নয়, সব ক’টির পিছনেই এক বিশেষ দর্শন কার্যকরী। সেই দর্শনটি মার্কো রুবিয়ো-র কথা থেকে আন্দাজ করে নেওয়া যায়। আমেরিকার বিদেশসচিব রুবিয়ো বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা, রাজনীতির করার জায়গা তো নয়। ইজ়রায়েল আমেরিকা যা-ই করুক না কেন, ছাত্রছাত্রীদের তো তা নিয়ে ‘ঝামেলা’ পাকানোর দরকার নেই। ‘পড়াশোনা’ নামক বস্তুটিকে এই ভাবে সঙ্কীর্ণ জায়গায় বেঁধে দেওয়ার মধ্যে একটি রাজনীতি আছে, দার্শনিক ভাবনা আছে। ফলে আজকের আমেরিকায় যা হচ্ছে, কিংবা এর তুলনায় কম মনে হলেও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক-ছাত্র-শিক্ষাক্রম ইত্যাদিকে যে রাষ্ট্রীয় শাসনশৃঙ্খলায় বাঁধা হচ্ছে, এ সব কোনও ক্ষমতা-দৃপ্ত শাসকের এলোমেলো বিক্ষিপ্ত কার্যক্রম নয়। বরং একটি অতি সুকৌশলী রাজনীতি হিসাবেই একে দেখা দরকার। এবং তার পর স্থির করা দরকার, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি বা জেএনইউ-র মতো ক্ষমতার সামনে নতজানু হওয়াই ঠিক পথ, না কি হার্ভার্ডের মতো রুখে দাঁড়ানোও সম্ভব।
এবং সেই প্রসঙ্গে উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক বিষয়টিই যে বিরাট বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে, সে কথাও অনুধাবন করা জরুরি। একটি ভ্রান্ত ধারণা হল, মানবিক বিদ্যাচর্চার মধ্যেই রাজনীতির প্রবেশ বেশি, বিজ্ঞান প্রযুক্তি এগুলি ব্যক্তিমুখী বিষয়, এর জন্য কোনও সামাজিক অধিকারচর্চার রাজনীতির দরকার নেই। কথাটি যে কত ভুল তা বোঝা যায় ট্রাম্পের আমেরিকায় বিজ্ঞানচর্চার ফান্ডিং প্রবল ভাবে কেটে দেওয়ার পদক্ষেপ দেখে, কিংবা মোদীর ভারতে বিজ্ঞানচর্চার ফান্ডিং বিপুল ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ দেখে। দার্শনিক কার্ল পপারের সেই কথাটি মনে পড়তে পারে, ‘ফিলজ়ফি অব সায়েন্স’ হল ‘ক্রিটিক্যাল র্যাশনালিজ়ম’-এর ভিত্তি, বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত দর্শনেই আছে যুক্তিতন্ত্রের প্রকৃত জয়। সেই কারণেই গ্যালিলিয়োদের বা সাখারভদের মুখ বন্ধ করে দিতে হয়, কিংবা হোমি ভাবা, মেঘনাদ দেশাই থেকে শুরু করে সতীশ ধাওয়ান, মাধব গ্যাডগিলরা নিজেরাই নিজেদের বিজ্ঞান-বিবেকের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। জ্ঞানবিজ্ঞানের সব শাখাতেই যুক্তির সাধনা যে প্রকৃত অর্থে মুক্তির সাধনা, এবং মুক্তি যে কখনওই একের নয়, সমূহের— এই মৌলিক কথাটা ট্রাম্পের মতো মুক্তিবিরোধীরা অক্ষরে অক্ষরে বুঝে নিয়েছেন। এবং মুক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)