—ফাইল চিত্র।
ফারাকটা খুব স্পষ্ট। ভারত আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় চরিত্রের মধ্যে ফারাকটা এখনও খুব স্পষ্ট।
প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট তথা প্রাক্তন পাক সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ লাগাতার মুখ খুলছেন পাক সরকারের বিরুদ্ধে। প্রথম দিন বললেন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভিতটাই তৈরি হয়নি। তার পর দিন বললেন, নওয়াজ শরিফের ভুল নীতির জন্য পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে কোণঠাসা। যে জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তান চলেছে এই মুহূর্তে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে মুশারফের মতো প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের উচিত, সংহতির বার্তা দেওয়া। জাতীয় স্বার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ার বার্তা দেওয়া। হাতে হাত রেখে কঠিন সময় থেকে দেশকে বার করে আনার পথে পা বাড়ানো।
মুশারফ তা করলেন না। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের চরিত্রে কত গলদ, দেশের সংবিধান কত অপরিণত, প্রধানমন্ত্রী কতখানি অপদার্থ, সে সব বিচার করতে শুরু করলেন। দেশ যখন অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল, সে সময়টাই ছিল এই সব আলোচনা বা তর্কের আদর্শ সময়। রাষ্ট্র পাকিস্তানের ত্রুটিগুলি খুঁজে বার করে তার মেরামতির জন্য সরকারের সঙ্গে সঙ্ঘাতে যাওয়ার সেটাই ছিল উপযুক্ত মুহূর্ত। কিন্তু পাকিস্তানের নেতারা রাষ্ট্রের কাঠামোগত ত্রুটি নিয়ে সে সময়ে আলোচনা করতে চান না। নিস্তরঙ্গ সময়ে ঢেউ ধরে রাখার জন্য ভারত বিরোধী জিগিরে সে সময় একসঙ্গে গলা মেলান সকলে। আর ভারতের কূটনৈতিক এবং সামরিক প্রত্যাঘাতে ইসলামাবাদ যখন টালমাটাল হয়ে ওঠে, ঠিক তখনই পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ পরস্পরকে আক্রমণ করতে শুরু করেন। অন্দরের দৈন্যটাকে বহিঃশত্রুর সামনে আরও প্রকট করে তোলেন।
ভারতের রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় চরিত্র এর ঠিক বিপরীত। বছরভর জাতীয় রাজনীতি সরগরম থাকে এ দেশে। অহোরাত্র চাপানউতোর চলে সরকারে-বিরোধীতে। কিন্তু প্রশ্ন যখন জাতীয় স্বার্থের, প্রশ্ন যখন বহিঃশত্রুকে প্রত্যাঘাতের, তখন সব বিভেদ ভুলে অভিন্ন অবস্থানে ঐক্যবদ্ধ গোটা ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। শাসক বিজেপি বা বিরোধী কংগ্রেস, বামপন্থী দল বা আঞ্চলিক শক্তি, সবাই সরকারি পদক্ষেপের সমর্থনে দৃঢ় অবস্থানে। সবাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাত্ম।
এই রাজনৈতিক পরিণতি বোধ ভারত রাষ্ট্রের নিজস্ব অর্জন। স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল্যবোধগুলিকে যে অসীম যত্নে লালন করা হয়েছে, এই পরিণতি বোধ তারই সুফল। এ দেশে ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রনায়ককে কখনও ইউরোপ বা আমেরিকায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় না। এ দেশে বিরোধী স্বরকে রুদ্ধ করার জন্য দাঁত-নখ বার করা হয় না। ভারতীয় গণতন্ত্রকে তার ৭০ বছরের যাত্রাপথে একাধিক বার বেশ কিছু ব্যতিক্রমী মোড় দেখতে হয়েছে, বেশ কিছু নেতির শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু সেগুলি ব্যতিক্রম হিসেবেই ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে, মূল ধারা হয়ে উঠতে পারেনি। সম্প্রতি গণতান্ত্রিক ভারতীয় মূল্যবোধের বেশ কিছু উল্লঙ্ঘন দেখছি যেন। আশঙ্কাটা উঁকি দিচ্ছে সেখান থেকেই।
সলমন খান যদি বলেন, পাক শিল্পীরা জঙ্গি নন, তৎক্ষণাৎ শিবসেনা তাঁকে পাকিস্তান চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। পাক অভিনেতাদের বিরুদ্ধে এমএনএস-এর ফতোয়া মানতে অস্বীকার করলে করণ জোহরের দফতর ঘিরে তুমুল উত্তেজিত আবহ তৈরি হয়। সংবেদনশীল কথা কেউ বললেই তাঁর মুণ্ডপাতের চেষ্টা শুরু হয়।
বিরোধী স্বরকে সমূলে মুছে দেওয়ার এই প্রবণতা আমাদের রাষ্ট্রে আগে সে ভাবে দেখা যায়নি। বিরোধিতার বিকাশের সব রাস্তা খুলে রাখা হয়েছে বরাবর বরং। সেই কারণেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে পরিণতমনস্ক ভারত।
কিন্তু সে সৌভাগ্য আর কত দিন বহাল থাকবে নিশ্চয়তা নেই। যে মূল্যবোধ রাষ্ট্র পাকিস্তানের চেয়ে রাষ্ট্র ভারতকে অনেক বেশি পরিণত হিসেবে তুলে ধরেছে বিশ্ব-মঞ্চে, সেই মূল্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত যদি চালিয়ে যেতে থাকি, তা হলে রাষ্ট্রীয় চরিত্রের ফারাকটা ঘুচিয়ে পাকিস্তানের মতো হয়ে উঠতে আমাদের খুব সময় লাগবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy