ব্রাত্য লোকায়ত জীবনের ভাষ্যকার পুলকেন্দু সিংহ প্রয়াত হলেন। মুর্শিদাবাদ জেলার লোকসংস্কৃতি চর্চার যে ধারাটি আজ বহুশাখায় পল্লবিত হয়ে অধিষ্ঠান করছে, সেই চর্চার বীজটি বোনা হয়েছিল পুলকেন্দু সিংহের হাতেই। ১৯৩৬ সালের ১৫’মে মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার আলুগ্রামে জন্ম পুলকেন্দুর। সেই গ্রামে ছিল তাঁর মায়ের মামার বাড়ি। তাঁর মায়ের ঠাকুমা ইন্দুমতী দেবী ছিলেন বিদূষী মহিলা। তাঁর সংকলিত ‘বঙ্গনারীর ব্রতকথা’-র ভূমিকা লিখেছিলেন মহামোহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। গ্রন্থটির অংশবিশেষের জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন হাইনরিক মোদে ও অরুণ রায়। পুলকেন্দুর মা ছিলেন পোলিও রোগী। সে জন্য তিনি মাতামহীর কাছেই মানুষ। পুলকেন্দুর পিতা সুধীর কুমার সিংহ ছিলেন সংসার উদাসী শিল্পী মানুষ। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও তবলা বাদনে বিশেষ পারঙ্গম মানুষটি সংসারের খোঁজ রাখতেন না, খোঁজ রাখতেন না ছেলেমেয়েদের পড়াশোনারও। পুলকেন্দুর প্রথাগত পড়াশোনা তাই বেশি দুর এগোয়নি। সে সময় কান্দি মহকুমায় আরসিপিআই দলের বেশ প্রভাব ছিল। স্থানীয় নেতা কর্মীদের সূত্রে তিনি এই দলের কাছাকাছি আসেন। কিন্তু নিতান্ত কিশোর বয়সেই প্রবাদপ্রতিম জননেতা ত্রিদিব চৌধুরির বক্তৃতা শুনে যোগ দেন আরএসপি দলে। আরএসপির সাংস্কৃতিক শাখা ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘের সূত্র ধরে বহু বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মীর সংস্পর্শে আসেন তিনি। ওই কালপর্বেই আরএসপির মুখপত্র ‘গণবার্তা’তেও তিনি লিখতে শুরু করেন। আরসিপিআই দলের স্থানীয় নেতা কর্মীদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে সংস্পর্শে আসেন বিশিষ্ট গ্রামকর্মী পান্নালাল দাশগুপ্তের। পান্নালাল রাজনীতি ছেড়ে গ্রামোন্নয়নে ব্রতী হলে তিনি ও তাঁর সুহৃদ মুর্শিদাবাদের আর একবিশিষ্ট সন্তান প্রফুল্ল কুমার গুপ্ত দলে টানেন পুলকেন্দুকে। “কম্পাস” পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন পুলকেন্দু। ওই কালপর্বেই বহরমপুরের ‘বর্তিকা’ পত্রিকার কর্ণধার মনীশ ঘটকের সঙ্গেও পরিচিত হন তিনি। পান্নালাল দাশগুপ্ত ও মণীশ ঘটক তাঁকে নিছক গল্প কবিতা না লিখে অবহেলিত অবজ্ঞাত মানুষদের কথা লিখতে উৎসাহিত করেন। তাঁদেরই উৎসাহে পুলকেন্দুর কলমে উঠে এল ঘুঁটে কুড়ানি থেকে কথক ঠাকুর, ডাক হরকরা, রানার থেকে লেটার প্রেসের কম্পোজিটার, পটুয়া থেকে পথের মাদারি খেলুড়ে বহু বিচিত্র পেশাজীবির জীবনকথা। তাঁর চোখ দিয়েই বাঙালিরা দেখল এবং জানল বহু বিচিত্র পেশাজীবি মানুষের অন্দরমহল। তাদের জীবনচর্চা অর্থনীতি আর ইতিহাস। পান্ডিত্য বর্জিত আটপৌড়ে ভাষায় সাধারণের কলমে সাধারণকে নিয়ে লেখা সেই সব প্রতিবেদন বাংলা সাহিত্যে যোগ করল এক অনাস্বাদিত সৌন্দর্য্য।
তিমধ্যে পুলকেন্দু যোগ দিয়েছেন গ্রাম সেবকের সরকারি চাকরিতে। গ্রামে ঘোরা সেই চাকরির সুবাদে নিবিড়ভাবে চিনলেন বাংলার গ্রামজীবন। দরিদ্র মানুষের জীবন জীবিকার তথ্যানুসন্ধানের সুবাদেই তিনি অখ্যাত দরিদ্র লোকশিল্পীদের জীবন যন্ত্রণার হদিশ পান। বহু অজ্ঞাত অনাদৃত লোকশিল্প তাঁর লেখার সূত্রেই উঠে আসে প্রচারের আলোয়।
জেলাশাসক রথীন্দ্রনাথ দে ও শিক্ষানবীশ আইএএস এনভি জগন্নাথনের উদ্যোগের ১৯৭৩ সালে বহরমপুর শহরের সার্কিটা হাউসের লনে সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় লোক উৎসব। জেলার বিভিন্ন আঙ্গিকের অখ্যাত অজ্ঞাত লোকশিল্পীদের সেখানে হাজির করেন পুলকেন্দু। তাদের প্রদর্শিত শিল্প নৈপূণ্যে অভিভূত জেলাশাসক সেইসব লোকশিল্পের ডকুমেন্টেসনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁরই উদ্যোগে গোবিন্দ বিদার্থীর নেতৃত্বে দিল্লির সংগীত নাটক একাডেমির প্রতিনিধি দল এসে মুর্শিদাবাদ জেলার স্থানীয় লোকশিল্পীদের বাউল বোলান জারি কীর্তন পটের গান মনসার গান, বিয়ের গীত শব্দ গান, ভারবোল, আলকাপ, সাঁওতালি নৃত্যগীত প্রভৃতি দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে ধরে রাখেন। আর এই লোকশিল্পীদের সন্ধান দেওয়া থেকে নির্দিষ্ট স্থানে তাদের হাজির করানোর কাজটি সূচারুভাবে সম্পন্ন করেন পুলকেন্দু। অসংগঠিত লোকশিল্পীদের সংগঠিত করে তাদের শিল্প প্রতিভাকে প্রচারের আলোয় আনার লক্ষে ১৯৭৫ সালে তিনি গঠন করেন “লোকায়ত শিল্পী সংসদ”। উপদেষ্টা হিসাবে নানা সময়ে এই সংসদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য, ডঃ সুধীর করণ, ডঃ সনৎ মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী, শান্তিদেব ঘোষ, পান্নালাল দাশগুপ্ত, ডঃ সুরজিৎ সিংহ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সুধী প্রধানের মতো মানুষজন। ১৯৭৭-৭৮ সালে লোক সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহ দানের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তৈরি করে রাজ্য লোকসংস্কৃতি পর্ষদ, বর্তমানে এটি রাজ্য লোকসংস্কৃতি এবং আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র নামে পরিচিত। জন্মলগ্ন থেকে তিনি ছিলেন এর সক্রিয় সদস্য। ১৯৭৬-৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার শান্তি চৌধুরীর পরিচালনায় ‘বাংলার কবিগান’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিলে তাতেও সক্রিয় ভূমিকা নেন পুলকেন্দু। সাক্ষাৎকার দিয়ে শিল্পী যুগিয়ে পরামর্শ দিয়ে এই তথ্যচিত্র নির্মাণে তিনি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। এর পাশাপাশি চলছিল নিরন্তর লেখালিখি, গবেষণাপত্র পাঠ ও বক্তৃতা দেওয়ার পালা. ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘মুর্শিদাবাদের লোকায়ত সংগীত ও সাহিত্য’। এ বিষয়ে প্রথম বই এটিই। সে দিক দিয়ে পুলকেন্দু পথিকৃতের মর্যাদা দাবি করতে পারেন। তাঁর লেখা অন্য বইগুলো হল মহাজীবনের কবিতা (১৯৮২), লোকায়ত মুর্শিদাবাদ (১৯৮৫), স্থান কাল পাত্র (১৯৯১), পঞ্চায়েত ও লোকসংস্কৃতি (১৯৯৩), ফিরে চল মাটির গানে (১৯৯৮), মুর্শিদাবাদের লোকশিল্পী (২০০৩), লোকায়তিক শান্তদেব ও তার অপ্রকাশিত পত্রাবলী (২০০৩), মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র (২০০৬), মুর্শিদাবাদের লোকসংস্কৃতি (২০১৫), যাঁদের সান্নিধ্যে এসেছি(২০২০) ইত্যদি। মুর্শিদাবাদের নানান বৈচিত্রময় জনজাতীর আচার আচরন জীবন চর্চা, সংস্কৃতি, অর্থনিতীর মনোজ্ঞ বিবরণ ধরা আছে তাঁর ‘কালকেতুর আপন দেশে (২০১৮)’ বইটিতে। জেলার নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠির পর্যালোচনাতেও তিনি অগ্রপথিকের ভূমিকায়।
তিনি শুধু লোকসংস্কৃতির চর্চাই করেছেন এমন নয়। লিখেছেন গল্প কবিতাও। নানা খ্যাত অখ্যাত পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে আছে তাঁর গল্প কবিতা প্রবন্ধের সম্ভার। স্বীকৃতি স্বরূপ পুলকেন্দু পেয়েছেন অজস্র সম্মান। ছোটবড় নানান প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়ে ধন্য হয়েছে। ১৯৭৮ সালে অ্যাকাডেমি অফ ফোকলোর তাঁকে সাম্মানিক ফেলোশিপ দেয়। ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নৃত্য নাট্য ও সংগীত দৃশ্যকলা একাডেমি তাঁকে আচার্য্য দিনেশচন্দ্র সেন পুরস্কারে সম্মানিত করে। ২০১০এ বাংলা একাডেমি তাঁকে দেয় তাপসী বসু স্মৃতি পুরস্কার। এ ছাড়া ২০০৮ সালে লালনমেলা, ২০১২ সালে সহজিয়া এবং পুরস্কার পান। বেশ কিছু দিন ধরেই বার্ধ্যক্য জনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। বাইপাস সার্জারি হয়েছিল। কাশিমবাজারের একচিলতে ঘরে বসেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন সাধনা। মৃত্যু থামিয়ে দিল কাজ। আক্ষরিক অর্থেই জেলার লোকসংস্কৃতি চর্চার যুগের অবসান ঘটল।
গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy