Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Big Bang

নাম-মাহাত্ম্য

এক বক্তৃতায় ফ্রেড হয়েল তাই বিগ ব্যাং থিয়োরিতে বিধৃত ব্রহ্মাণ্ডের আকস্মিক জন্মকে এক মহা বিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং বলিয়া নিন্দা করেন।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০ ০১:১০
Share: Save:

নাম-মাহাত্ম্য সমস্ত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ইতিহাসে— এমনকি বিজ্ঞানেও। জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায় সর্বাপেক্ষা সফল তত্ত্ব, বিগ ব্যাং থিয়োরি নামে যাহা পরিচিত, তাহা যে আসলে এক নিন্দাসূচক আখ্যা, এ কথা সচরাচর মনে রাখা হয় না। নামটি পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল কর্তৃক প্রদত্ত। হয়েল ছিলেন বিগ ব্যাং-এর পাল্টা তত্ত্ব স্টেডি স্টেট থিয়োরির অন্যতম প্রবক্তা। বিগ ব্যাং তত্ত্বে ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম আজ হইতে ১৩৭০ কোটি বৎসর পূর্বে, আর স্টেডি স্টেট থিয়োরিতে ব্রহ্মাণ্ড আবহমান কাল ধরিয়া বিরাজমান, তাহার কোনও কালে জন্ম হয় নাই। এবংবিধ তত্ত্বের প্রবক্তা হিসাবে হয়েলের পক্ষে বিগ ব্যাং তত্ত্বকে নিন্দা করাই স্বাভাবিক। ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম কল্পনা করিলে জন্মদাতা ঈশ্বরও আসিয়া পড়েন। বিজ্ঞানীর পক্ষে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানিয়া লওয়া অসম্ভব, সেই কারণে স্টেডি স্টেট থিয়োরির প্রবক্তাগণের পক্ষেও বিগ ব্যাং থিয়োরি মানিয়া লওয়া সম্ভব হয় নাই। এক বক্তৃতায় ফ্রেড হয়েল তাই বিগ ব্যাং থিয়োরিতে বিধৃত ব্রহ্মাণ্ডের আকস্মিক জন্মকে এক মহা বিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং বলিয়া নিন্দা করেন। কিন্তু, নিন্দার্থে ব্যবহৃত ওই রূপকল্পটি এতই সুপ্রযুক্ত হয় যে, উক্ত নামেই তত্ত্বটি পরিচিতি পায়। নামের মাহাত্ম্য এতই বড়!

এই বৎসর পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ় দেওয়া হইয়াছে নক্ষত্রদের মরণোত্তর দশা ব্ল্যাক হোল বিষয়ে। সাধারণ ভাবে বলিলে, প্রত্যেক নক্ষত্রের জীবদ্দশায় চলিতে থাকে দুই বিপরীতমুখী ক্রিয়া। তাহা বুঝিতে হইলে জানা দরকার, চারিটি হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হইয়া একটি হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়। এই বিক্রিয়ায় প্রচুর তাপ উৎপাদিত হয়, যাহা নক্ষত্রের অগ্নিকুণ্ডের মূলে। ওই অগ্নি নক্ষত্রকে লুচির ন্যায় ফুলাইয়া প্রসারিত করিতে চায়। ইহার বিপরীতে কার্য করে নক্ষত্রে উপস্থিত প্রচুর পরিমাণ পদার্থ। ওই পদার্থজনিত প্রচণ্ড গ্রাভিটি নক্ষত্রকে নিষ্পেষিত করিয়া সঙ্কুচিত করিতে চায়। এক দিকে প্রসারণ, অন্য দিকে সঙ্কোচনের এক ভারসাম্য বা ব্যালান্স-এর খেলা চলিতে থাকে নক্ষত্রের জীবদ্দশায়। কোনও নক্ষত্রেরই জ্বালানি ভান্ডার অসীম নহে, সুতরাং প্রসারণ এক সময় বন্ধ হইয়া যায়। তখন নক্ষত্রের জীবনকালের ইতি। এমতবস্থায় মৃত নক্ষত্রে পদার্থের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হইলে, তাহার প্রচণ্ড গ্রাভিটির নিষ্পেষণে তালগোল পাকাইয়া যায়। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন-আবিষ্কৃত জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব অনুযায়ী, পদার্থ তাহার চারিপার্শ্বের শূন্যস্থানকে দুমড়াইয়া-মুচড়াইয়া দেয়। মৃত নক্ষত্রে মাত্রাতিরিক্ত পদার্থ থাকিলে শূন্যস্থান এতই দুমড়াইয়া-মুচড়াইয়া যায় যে, সদা সরলরেখায় চলমান আলোও ওই স্থানের বাহিরে আসিতে পারে না। কোনও স্থানের এমন দশার নামই দেওয়া হইয়াছে ব্ল্যাক হোল। এই বৎসর পদার্থবিদ্যায় তিন জন নোবেলবিজয়ীর মধ্যে স্যর রজার পেনরোজ— তিনি যে তাঁহার গবেষণায় কলিকাতার প্রাক্তন প্রেসিডেন্সি কলেজের অমলকুমার রায়চৌধুরী-আবিষ্কৃত ‘রায়চৌধুরী ইকুয়েশন’-এর সাহায্য লইয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করিয়া সঙ্গত কারণে কোনও কোনও পণ্ডিত পুলকিত বোধ করিয়াছেন। বাঙালিও কিছু আত্মশ্লাঘা বোধ করিয়াছে। দোষ দেওয়া যায় না!

এই প্রসঙ্গে হয়তো বাঙালিকে আরও কিছু শ্লাঘার উপকরণ দেওয়া যাইতে পারে। আপাতত একটি বিষয় অনুল্লিখিত থাকিতেছে— তাহা হইল ব্ল্যাক হোল নামটির সহিত কলিকাতার বিশেষ যোগাযোগ। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশে কলিকাতাস্থ ফোর্ট উইলিয়ামে এক অপরিসর প্রকোষ্ঠে ১৪৬ জন ইংরাজ বন্দিকে একসঙ্গে রাখা হয়। দমবন্ধ হইয়া উহাদের মধ্যে ১২৩ জনই মারা যায়। ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যা নামে কুখ্যাত ওই অপরাধই যে ব্ল্যাক হোল নামের উৎস, তাহা বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদগণ জানিতেন। এত কাল মনে করা হইত, ভারী মৃত নক্ষত্রদের উক্ত নাম প্রয়াত পদার্থবিদ জন আর্চিবল্ড হুইলারের দেওয়া। সম্প্রতি বিজ্ঞান-লেখিকা মার্সিয়া বার্তুসিয়াক অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিয়াছেন হুইলারের নহে, নামটি আসিয়াছে পদার্থবিদ রবার্ট হেনরি ডিকে-র মস্তিষ্ক হইতে। সুতরাং, শুধু গবেষণার চৌহদ্দিতে নহে, ব্ল্যাক হোল নামটির ক্ষেত্রেও বিলাত-সমাজে বাংলাদেশ ও কলিকাতা শহরের ইতিহাসের যোগাযোগ রহিয়াছে, এমন কথা বলাই যায়। নামে হয়তো তেমন কিছু আসে যায় না, তবে নামের ইতিহাসটি গুরুত্বপূর্ণ বইকি।

যৎকিঞ্চিৎ

রসায়নে নোবেলপ্রাপকদের নাম দেখে চক্ষু চড়কগাছ। দু’জন মহিলা প্রাপক, সঙ্গে এক জনও পুরুষ নেই! বিজ্ঞানে? এঁদের পথ দেখাল কে তবে? কে বুঝিয়ে দিল বিজ্ঞানের গূঢ় রহস্য ও দ্যোতনা? ‘মেয়েদের মধ্যে প্রথম’ নয় এঁরা? নোবেলের ইতিহাসে পুরুষ-অভিভাবকহীন দুই ‘অবলা’ পুরস্কার পেলেন, এই প্রথম। পুরুষতন্ত্রের খাসতালুকে দরজা ভেঙে মেয়েরা এই ভাবে ঢুকে পড়লে ভারতবর্ষীয় জেঠামশাই কী ভাবে বলবেন, ‘‘মেয়ে তো, তাই সায়েন্সের মাথা নেই’’?

অন্য বিষয়গুলি:

Big Bang Black Hole
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy