নৈহাটি-নিবাসী ভূপতিরঞ্জন দাস ছিলেন এক অদ্ভুত ধরনের গবেষক। তাঁর গবেষণায় প্রথার চোখরাঙানি ছিল না, পাণ্ডিত্যের অভিমানও না, অথচ বৈচিত্র ছিল। শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ থেকে নীলাচল গমনের পথপঞ্জিকা আর যাত্রাপথের হদিশ নিয়ে তাঁর অদ্ভুত গবেষণার কথা শুনে সুকুমার সেন নাকি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘এসব কথা কোনো পণ্ডিত লিখতে পারবে না। ঘরকুনো সব। পথে বেরোয় না, মানুষের কাছে যায় না কেউ। খালি লাইব্রেরিতে বসে টোকে। সব হল টোকা পণ্ডিত...।’ কথাগুলো লিখেছিলেন সত্যজিৎ চৌধুরী, তাঁর গবেষণার রকমফের বইটিতে। গবেষণা যে কত বিচিত্র হতে পারে, সময়ে-সময়ে প্রথাবিরুদ্ধও, তা আমরা জানি। প্রথার নিগড় মানতে গেলে সৃষ্টিও থমকে দাঁড়ায়। বিজ্ঞান গবেষণার বেলায় এ-কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি; অবশ্য ইতিহাস বা সাহিত্য গবেষণার বেলায় তেমন দৃষ্টান্ত কম। কম বলেই বোধহয় সুকুমারবাবুর ধমক বার বার মনে পড়ে।
একটু খটকাও লাগে। গবেষণা যে-পথেই হোক না কেন, লাইব্রেরি তো পরিহারযোগ্য না। সে শুধু ঘরকুনো, টোকা পণ্ডিতের সাজানো বাগানও না। লাইব্রেরি ব্যবহারেরও রকমফের আছে। যেমন করেছেন দীপক গোস্বামী, তাঁর পরশুরামের চতুঃ রঙ্গ বইটিতে। পরশুরামের রঙ্গময় রচনাগুলোতে স্নিগ্ধ কৌতুকের বর্ণালি যে কেমন বিস্তৃত ছিল, তা মনোযোগী পাঠকের জানা। কিন্তু রচনাগুলো কি মৌলিক, না কি সেগুলো অন্য কোনও সৃষ্টির অনুপ্রেরণায় রচিত? অনুপ্রেরণার সেই আদ্যবীজ তো কালের গভীরে তলিয়ে গেছে। সেখান থেকে তাকে তুলে আনা বড় দুরূহ কাজ। দীপকবাবু সেই উৎস সন্ধানে পরিব্রাজক হয়েছেন, লাইব্রেরির দুনিয়াতেই। বিশ্বে এখন অন্তর্জাল ছড়ানো। সে আসলে আর এক লাইব্রেরি— বিপুল, বিশাল। যে নিষ্ঠা, পরিশ্রম আর অনুকরণীয় অধ্যবসায় সম্বল করে তিনি প্রাক-সৃষ্টি আর উত্তর-সৃষ্টির মধ্যে যোগসূত্র রচনা করার কাজটি সম্পন্ন করেছেন তা বাংলা সাহিত্য-গবেষণার জগতে মান্য হয়ে থাকবে। প্রসঙ্গত, তিনিও নৈহাটিরই হাওয়া-খাওয়া মানুষ।
পরশুরামের (ছবিতে) লেখাজোখা, বিশেষ করে রঙ্গরস নিয়ে আলোচনা আগেও হয়েছে। তা সত্ত্বেও আজকের এই বিরস দিনে অমন এক জন মানুষকে নতুন করে পেতে ইচ্ছে করে। একাধারে সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন, যন্ত্রবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, কৌতুককাহিনির রচয়িতা, সুগম্ভীর ভাষাতাত্ত্বিক আর অভিধান-রচয়িতা এই বাংলায় আমাদের সংসারে যে তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা আমাদের বিস্মিত করে, গর্বিতও। আবার একই সঙ্গে একটু বেদনাও জাগে যখন দেখি, প্রায় কুম্ভীলকবৃত্তির দায়ে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কেউ কেউ অবশ্য অতটা কঠোর না-হয়ে মোলায়েম ভাষায় উদ্বেগ জানিয়েছিলেন, পরশুরাম কি মার্কিন লেখক অধ্যাপক স্টিফেন লিকককে অনুসরণ করেছেন? আবার কেউ কেউ, যেমন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস তাঁর প্রতি কটূক্তি বর্ষণের কাজে এমন প্রবল কুশল যে হ্যাঁচকা টানে তাঁকে প্রায় আদালতে নিয়ে যান আর কী! সৃষ্টির ‘মৌলিকত্ব’ সন্ধানে শিক্ষাভিমানী বাঙালির অমন প্রবণতা অবশ্য আজও প্রবহমান।
সাহিত্যে মৌলিক সৃষ্টি বলে কিছু হয় কি না, সেই তর্কে কেউ কেউ বলেন, সব সৃষ্টিই আসলে পূর্বসূরিদের নবায়ন। পরশুরামের বেলায় সংযমস্নিগ্ধ রসিকতা, বৈঠকি মেজাজ আর সুনিপুণ ব্যঙ্গই হয়তো বাংলা সাহিত্যে মৌলিক; অন্য কোনও মৌলিকতার কথা সেখানে অবান্তর। যাঁরা অমন অবান্তর কর্মে লিপ্ত ছিলেন তাঁরা কিন্তু এ কথা ভাবেননি যে সমাজজীবনের বিচিত্র সংস্কার, মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা এবং অনুরূপ অসংখ্য অসংগতির পটভূমিতে এক-একটি গল্পের ছায়াকে নতুন রূপ দেওয়ার অনবদ্য কাজটাই আসলে ছিল মৌলিক। মনে পড়ে, ভূমেন্দ্র গুহরায়কে এক বার কথায় কথায় জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘তুমি কি কুম্ভীলকবৃত্তির কথা বলছ?... তুমি যে সমাজে বাস করো, সে সমাজের ভাষাও তোমার জিভে চলে আসে।... তুমি যদি অ্যাডগার অ্যালান পোর, ইয়েটসের, কিটসের বা এলিয়টের সমাজে বাস করো, তোমার জিভে কী ভাষা আসবে? সেই ভাষাই চলে আসে জিভে। তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলে না।’
সহজ কথায়, কুম্ভীলকবৃত্তি মানে, অন্যের রচনা নকল করে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া। পরশুরামের বেলায় এই অপবাদটা যে কোনও ক্রমেই খাটে না, তা দেখাতে গিয়ে দীপকবাবু চারটি রঙ্গরচনা নিয়ে কথা বলেছেন— চিকিৎসা-সংকট, উলট-পুরাণ, আনন্দীবাঈ, রাজমহিষী। এগুলোতে নাকি যথাক্রমে উইলিয়াম কেন, রাজনারায়ণ বসু, জার্মান নাট্যকার ইউলিউস বাউআর এবং পি জি ওডহাউস-এর ছায়া অথবা প্রভাব ফুটে উঠেছে। সাহিত্য সৃষ্টির কাজে ছায়া থাকে, পরিচিত কাঠামোর পুনর্বিন্যাস থাকে আর, এমনকী, পূর্বসূরিদের প্রভাব তো থাকেই। পরশুরামের রচনাগুলোতে তা কীভাবে এসেছে, কোথায় তার সূত্র, কী তার পরিণতি, এ-সব নিয়েই দীপকবাবুর গবেষণা। তা করতে গিয়ে তাঁকে নতুন ও পুরনো রচনার সাদৃশ্য-অসাদৃশ্য দেখাতে হয়েছে। তাঁর অনুপুঙ্খ আলোচনা পাঠককে ঋদ্ধ করবে। আর সেই সঙ্গে দেখিয়ে দেবে, পরশুরামের রচনায় রসোল্লাস কীভাবে কালের সীমানা ছাড়িয়ে রসোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
‘ইউ ক্যানট ভ্যালু হিম আলোন; ইউ মাস্ট সেট হিম, ফর কনট্রাস্ট অ্যান্ড কমপ্যারিজন, অ্যামং দ্য ডেড’— এলিয়ট-এর এই কথাগুলোই বোধহয় দীপকবাবুর গবেষণার ভিত্তিপ্রস্তর। সে-কথাই তাঁর বইটির ভূমিকায় শঙ্খ ঘোষ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। বইটির প্রচ্ছদ থেকে মুদ্রণশিল্প পর্যন্ত আপাদমস্তক পরিমিত যত্ন ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ল না, আজকের বাংলা প্রকাশনায় যা হয়তো ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy