Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

সামান্য ক্ষতি

হয় ভয় পাও, নইলে ভয় দেখাও, এই হল কথা। তাই দরকার না থাকলেও ভয় দেখাতেই হয়। এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কী আছে? স্বাতী ভট্টাচার্যকথার নড়চড় হয়নি। যারা বলেছিল, ভোট দিতে গেলে দেখে নেব, তারা রাতে বাড়ি এসে ভাল মতোই দেখে গিয়েছে। যারা বলেছিল, যেতে হবে না, ভোট পড়ে যাবে, তারা বুথে যাওয়ার উপায় রাখেনি, দরকারও রাখেনি। ভোটার কার্ড কেড়ে রাখা, বুথের সামনের জটলার রক্তচক্ষু।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

কথার নড়চড় হয়নি। যারা বলেছিল, ভোট দিতে গেলে দেখে নেব, তারা রাতে বাড়ি এসে ভাল মতোই দেখে গিয়েছে। যারা বলেছিল, যেতে হবে না, ভোট পড়ে যাবে, তারা বুথে যাওয়ার উপায় রাখেনি, দরকারও রাখেনি। ভোটার কার্ড কেড়ে রাখা, বুথের সামনের জটলার রক্তচক্ষু। এজেন্ট অপহরণ, মারধর করে বার করে দেওয়া। কালিয়াচকে দেওয়াল-লেখকদের উপর গুলি, হাড়োয়ায় ভোটদাতাদের পায়ে ছররা গুলি, পুরুলিয়ার বলরামপুরে থেঁতলে খুন, বাঁকুড়ার শালতোড়ে হুমকি, ভাঙচুর, সন্দেশখালিতে ঘরে আগুন, কিছুই বাদ যায়নি। ভোট শেষ হওয়ার পরেও নেতাদের ধমকচমকের বিরাম নেই। অধিকাংশেরই দায় বর্তেছে তৃণমূলের উপর। তা নিয়ে প্রশ্ন করতে তৃণমূলের এক নেতা বলেছেন, “ক’টাই বা ঘটনা? শতাংশের হিসেবেই আসে না।”

কথাটা ভুল নয়। পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন এ বার। মারামারি করে হাসপাতালে বড় জোর কয়েক ডজন, ঘরছাড়া কয়েকশো, হুমকি, মারধর কয়েক হাজার। অনুপাতে যত্‌সামান্য। টিভি, খবরের কাগজ প্রতিটা ঘটনা বড় করে দেখিয়েছে, তা বেশ করেছে। ওটাই মিডিয়ার কাজ। তা বলে সত্যিই কি অনেক হিংসা ঘটেছে? ক’টাই বা অভিযোগ হয়েছে পুলিশের কাছে? দিনের শেষে ক’টা বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বিরোধীরা? ২০০৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনে সত্তরেরও বেশি প্রাণ গিয়েছিল। ২০০৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাসন্তীতে ভোট দিতে যাওয়ার অপরাধে চার আরএসপি সমর্থককে তাড়া করে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল। এ বার নিহত তিনটি, সে-ও পারিবারিক বিবাদে খুন কি না স্পষ্ট নয়। ক’টা ভাঙা পা, কাটা হাত, ফাটা মাথার হিসেব মিলেছে এ বছর? হাতের কড়েই গোনা হয়ে যাবে।

তা ছাড়া, আশি শতাংশ ছাড়িয়ে ভোট পড়েছে এ বার। ভোটের স্রোত কোন দিকে তা অতি স্পষ্ট, রিগিং-ছাপ্পা করেই জিতেছে শাসক দল, বিরোধীরাও এ-নালিশ জোর গলায় করতে পারেননি। ছাপ্পা ভোট দিতে স্বয়ং বিধায়করা কোমরে আঁচল জড়িয়ে নেমেছিলেন বটে, তবে সে ভোট ক’টাই বা? সামান্যই।

সামান্য ক্ষতি।

কাশীর মহারানি সেই যুক্তিতেই শীতের দিনে গঙ্গায় চান করে উঠে গরিবের ঝুপড়ি পুড়িয়ে গা গরম করেছিলেন। রাজা রাগ করলে উত্তর দিয়েছিলেন, গোটাকতক জিরজিরে কুটির পুড়িয়ে কীই বা ক্ষতি হয়েছে? ভুল তো কিছু বলেননি। কাশীতে নিশ্চয়ই ঢের বেশি গরিবের বাস ছিল। গঙ্গার ধারের ওই ক’টা কুটির শতাংশেই আসে না।

তাই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, ক্ষতিটা ঠিক কোথায়।

একটা উত্তর কাশীর রাজাই দিয়েছিলেন, রানিকে ফের কুটির গড়তে পাঠিয়ে। মানুষের কষ্ট না বুঝলে শাসক হওয়ার নৈতিক অধিকার থাকে না। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানী, দার্শনিকরাও বলছেন, আমাদের নীতিবোধের গোড়ায় আছে কল্পনাশক্তি। পোড়া কুটির গড়তে কেমন লাগে, কিংবা ভোট দিতে গিয়ে স্ত্রী-পুত্রের সামনে চড়-লাথি খেতে, তা অনুভব না করলে কাজটা ঠিক কি ভুল, বোঝা যায় না। রোয়ান্ডাতে টুটসিদের মারার সময় হুটুরা বলত ‘আরশোলা’। তাতে সহ-অনুভূতির দায় থাকে না। আমরা বলি ‘পাবলিক।’ কিন্তু টিভিতে এখন তাদের মুখ দেখা যায়, উদ্ভ্রান্ত ভয়ার্ত চোখ দেখা যায়। ভাঙা ঘর, ভাঙা হাত-পায়ের বেদনা টের পাওয়া যায়।

আর তার চেয়ে বড় আঘাত লাগে মর্যাদায়। চোখের সামনে এক নিরপরাধকে পাঁচ জন ধরে মারলে নিজের মধ্যে যে প্রবল গ্লানি হয়, সে তো ‘সামান্য’ নয়। কলকাতায় এক মহিলা কাউন্সিলরকে বিরোধী দলের হেনস্থার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে মার খেলেন এক পথচলতি যুবক। এমন সেধে মার অনেকেই খায়, ইচ্ছে করে। ভিতরের কষ্টটা থেকে মুক্তি পেতে। এমন ‘ভিতরের ক্ষতির’ কথা সম্প্রতি লিখেছেন কৌশিক সেন। আদর্শচ্যুতির ক্ষতি। স্বপ্নের নেতা নিজের জীবনকে একটা মানে দেয়। মানুষের উপর দাঁত-নখের আক্রমণে সেই মানেটা হারিয়ে যায়। সে ক্ষতি শুধু তাত্‌ক্ষণিক নয়। ফোঁটা ফোঁটা অ্যাসিড যেন ক্ষরণ হতে থাকে ভিতরে। সব উজ্জ্বল সাফল্যের কেন্দ্রে ফ্যাকাশে ব্যর্থতা।

কিন্তু নিজের মনের চৌহদ্দির বাইরে আরও বড় ক্ষতির কথা বলা দরকার। সে ক্ষতি সংস্কৃতির।

সংস্কৃতির কাজ সম্পর্ক নিয়ে, বলছেন সমাজতত্ত্বের লোকেরা। ‘কালচার’ মানে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির সম্পর্ক, আবার নানা সমষ্টির পরস্পর সম্পর্ক। নানা ধারণা, নানা দর্শন, আদর্শ, তার সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক, সে-ও সংস্কৃতিই নির্ধারণ করে। শেষ অবধি যা থেকে এক জন ধারণা তৈরি করে, সে কী পারে, কী পারে না। আমার কী করা চলে, আমি কী হয়ে উঠতে পারি, এই বোধ যা গড়ে তোলে, সেটাই সংস্কৃতি। গরিব মানুষ যদি মনে করে, দারিদ্র তার নিয়তি, পূর্বজন্মের কর্মফল, তবে আরও ভাল জীবনের জন্য তার চেষ্টা থাকে না। আবার যে দেশে মানুষ মনে করে ‘যে কেউ রাষ্ট্রপতি হতে পারে,’ সেখানে দারিদ্রকে মেনে নেওয়ার যুক্তি খুঁজে পায় না সে। দারিদ্রকে অনাবশ্যক বাধা মনে হয়। তাকে দূর করার ইচ্ছেটা জোরালো হয়ে ওঠে। কেউ যখন বলেন, ‘মেয়েরা আবার সবার সামনে গলা উঁচু করে কথা বলে নাকি?’ তিনি আর পাঁচ জনের সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্ক নির্দিষ্ট করছেন। এই সংস্কৃতি রাজনীতি বা জনজীবনের অন্য কাজে মেয়েদের নেতৃত্বের সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছে।

বঞ্চনা, অত্যাচার কেন বছরের পর বছর মানুষ মেনে নেয়? গবেষকরা বলছেন, সংস্কৃতি অভ্যাস তৈরি করে দেয়। অন্য পথ হাতের কাছে এলেও মনে হয়, ও আমার জন্য নয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক গ্রামে মেয়েরা পাট থেকে দড়ি বানাচ্ছিল। আঁশ ছাড়াতে হাত ছড়ে রক্ত বেরোচ্ছে। কেন সবাই ঋণ নিয়ে মেশিন কেনো না? ওদের উত্তর, “আমাদের এমনই হবে। হাত না কাটলে ভাত জুটবে না।” হয়তো স্বনির্ভর গোষ্ঠী বানিয়ে ঋণ পাওয়া কঠিন ছিল না। কিন্তু ওদের অন্য রকম চিন্তার অভ্যাস তৈরি হয়নি।

ভয় দেখানো, ভয় পাওয়া, দুটোই যে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এই ‘ভয়-দেখানোর সংস্কৃতি’ কিছু কিছু জায়গায় প্রায় স্থায়ী সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মঙ্গলকোট কেতুগ্রাম রায়না আরামবাগ হিঙ্গলগঞ্জ সন্দেশখালি শাসন ভাঙড় ঘনঘন সংঘর্ষে, কোনও এক দলের সম্পূর্ণ আধিপত্যে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। মনে করা হয়েছিল, এ হয়তো কোনও দলের, কোনও নেতার সংস্কৃতি। তিন বছরে স্পষ্ট, এটা এখন এ রাজ্যের সংস্কৃতি। যে কোনও বিরোধিতাকে, তার সম্ভাবনাকেও মেরে পুঁতে দেওয়ার অভ্যাস। অন্যকে মুখ খুলতেই না দেওয়ার অভ্যাস।

এ অভ্যাস মঙ্গলকোট-শাসন থেকে গোটা রাজ্যে ছড়াচ্ছে, রাজনীতি থেকে অন্যত্রও। সমস্যার আঁচ পেলেই স্কুলে ভাঙচুর করেন অভিভাবকরা, হাসপাতালে রোগীর স্বজন, রেলে-বাসে যাত্রীরা। এই ক্রোধ, এই কথা শুনবার অনিচ্ছা, এ সবই আমাদের সংস্কৃতিতে চারিয়ে যাচ্ছে। অভ্যাস সংস্কৃতি তৈরি করছে, সংস্কৃতি তৈরি করছে আরও অনেক মানুষের অভ্যাস। কথা শোনার, কথা বলার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে না। হয় ভয় পাও, নইলে ভয় দেখাও, এই হল কথা। তাই দরকার না থাকলেও ভয় দেখাতেই হয়।

এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কী আছে?

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial swati bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE