ভারতে শুদ্ধ জীবনযাত্রার অন্যতম ‘রোল মডেল’ হিন্দু ঘরের বয়স্ক বিধবারা। ‘ছোঁয়ানেপা’ এড়াতে তাঁরা সব সময়ে কেমন কাঁটা হয়ে থাকতেন, তার গল্প পাওয়া যায় কল্যাণী দত্তের ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইটিতে। “গেরস্তের শোবার ঘরে বিছানা মাদুর সতরঞ্চি পর্দা, সব এঁটোকাঁটা হয়ে যায় মায় দরজার কড়াটি পর্যন্ত। তক্কে তক্কে থেকে কোন ফাঁকে এঁরা লাফিয়ে বা ডিঙিয়ে কোনও সময় ঘরে ঢুকে কাঠের পিঁড়েয় উঁচু হয়ে বসতেন।” এমন প্রাণপণ চেষ্টায় যিনি পবিত্র থাকতেন, তাঁরই আবার “পায়ে লম্বা লম্বা ফাটা, জল ঘেঁটে ঘেঁটে হাত-পায়ে হাজা, অদ্ধেক সময় ভিজে কাপড়ে থাকার জন্য সর্দিজ্বর লেগেই থাকত।” বহু রকম এঁটো-সগড়ি মানতেন, কিন্তু শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতি, আর ছেলের জন্মবারে নখ কাটা বারণ, তাই হাতে-পায়ে লম্বা নখ, পরনের কাপড়খানি আধময়লা। এঁরা জমিদার ঘরের বিধবা, বলছেন কল্যাণী। তাঁরা মলিন, রুগ্ণ থাকতেন অভাবে নয়, সংস্কারবশে।
সমাজ-পরিবারের চোখে যা ‘শুচি’, তার সঙ্গে যে পরিচ্ছন্নতা, সুস্বাস্থ্যের তেমন কোনও যোগই নেই, ‘স্বচ্ছ ভারত’ তৈরির পথে এটাই এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ দেশের এত মানুষ এখনও কেন টয়লেট ব্যবহার করছেন না, তা খুঁজতে গিয়ে এই কারণটাই ক্রমশ আর সব কারণকে ছাপিয়ে উঠছে। গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের গ্রামের মানুষ গবেষকদের বলেছেন, বাড়ির কাছে টয়লেট থাকাটাই তো নোংরা। অন্য দিকে, খোলা মাঠে যাওয়ার অনেকগুলো সদ্গুণ দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। যে খোলা মাঠে যায় সে অলস নয় নিয়ম করে ভোরে ওঠে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, উন্মুক্ত পরিবেশ, খোলা হাওয়া পছন্দ করে। সে সতেজ, স্বাস্থ্যবান, প্রাণবন্ত। অর্থাৎ বহু দিনের সংস্কার, অভ্যাস যা বলছে, সরকারি প্রকল্প বলছে তার ঠিক উল্টো। তাই প্রকল্প যত টয়লেট তৈরি করছে, তত ব্যবহার হচ্ছে না। গবেষকরা নানা রাজ্যে গ্রামের মানুষের সঙ্গে বিশদে কথাবার্তা বলে জানছেন, যে সব বাড়িতে টয়লেট আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি (৫৬%) পরিবারের অন্তত এক জন সদস্য বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন কাজ সারতে। বলাই হয়, ‘বড় বাইরে’ আর ‘ছোট বাইরে।’
কংগ্রেস সরকারের ‘নির্মল ভারত’ প্রকল্পের সময়ে চিন্তাটা ছিল এই রকম: আহা গরিব মানুষ, বাড়িই নেই, টয়লেট পাবে কোথায়। ওদের টয়লেট বানিয়ে দাও, নিশ্চয়ই ব্যবহার করবে। অতএব রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় টয়লেট নির্মাণ তৈরি শুরু হল। কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে, জোগান যতই বাড়ুক, চাহিদা বাড়ছে না। বরং জোগান-দেওয়া টয়লেট অব্যবহারে, অনাগ্রহে অকেজো হয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গেই যে ১০৭৭ গ্রাম পঞ্চায়েত ‘নির্মল গ্রাম’ বলে ঘোষিত হয়েছিল, সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ বাড়িতেই টয়লেট আর কাজ করছে না। ফের এই সব গ্রামে অন্তত ১৪ লক্ষ টয়লেট তৈরি করতে হবে। ফলে বিজেপি-র ‘স্বচ্ছ ভারত’ পরিকল্পনায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে টয়লেট গড়া নয়, টয়লেট ব্যবহার।
টয়লেট থাকতেও কেন ব্যবহার হয় না, তা নিয়ে নানা আলগা গল্প হাওয়ায় ভাসে। যেমন, গরিব মানুষ একটা বাড়তি ঘর পেলে বরং তাতে ছাগল-মুরগি রাখবে, খড়বিচুলি রাখবে, টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করবে কেন? কিংবা, সরকারি টয়লেটের এমন খারাপ দশা, ব্যবহারই করা যায় না। কিংবা, জলই নেই, টয়লেট ব্যবহার করবে কী করে? এগুলো কিন্তু ধোপে টেকে না তেমন। ধরুন জলের কথাই। পশ্চিম ও উত্তর ভারতে ‘মাঠে যাওয়া’ লোকেদের মধ্যে সমীক্ষায় মাত্র ৩ শতাংশ বলেছেন, জল না থাকা টয়লেট এড়ানোর কারণ। যে সব বাড়িতে পাইপবাহিত জল আসে, সেখানেও বাড়ির টয়লেট ব্যবহারের হার অন্যদের প্রায় সমান। এ রাজ্যের বীরভূমে ৬৫ শতাংশ মানুষ বলছেন, তাঁদের বাড়ির ভিতরে অথবা কাছে জলের উৎস রয়েছে। অথচ প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন। গোটা ভারতেও এই ছবি: বাড়ির কাছে জল থাকলেও লোকে ছুটছে মাঠে। অথচ আফ্রিকায় সাহারার নীচের গরিব দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের চেয়ে ঢের কম লোক বাড়ির কাছাকাছি জল পান, কিন্তু উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন ঢের কম লোক। ভারতের গ্রামে ৬০ শতাংশ বাইরে যাচ্ছেন, সেখানে ও সব দেশে ৩৫%।
দারিদ্রকেও দায়ী করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিশ্চয় ভারতের চেয়ে ধনী নয়। সেখানে মাত্র চার শতাংশ মানুষ মাঠে যান। ভারত সরকার যে টয়লেট গরিবদের দেন, ইঁট-সিমেন্টের নির্মাণ থাকায় তা নাকি বাংলাদেশে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি অনেক টয়লেটের চেয়ে বেশি দামি। আবার ভারতেই মুসলিমরা গড়ে হিন্দুদের চেয়ে গরিব হলেও, তাঁদের টয়লেট ব্যবহারের হার বেশি। গ্রামীণ হিন্দু পরিবারের ৭৭ শতাংশ বাইরে মলত্যাগ করেন, মুসলিমদের ৫৫ শতাংশ। বাড়িতে সরকারের দেওয়া টয়লেট থাকা সত্ত্বেও বাইরে যান ৪০ শতাংশ হিন্দু, মাত্র ৭ শতাংশ মুসলিম। কেন এই তফাত?
কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডায়ান কোফি পাচ্ছেন সেই শুচিতার ধারণার গ্যাঁড়াকল। যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে অস্পৃশ্যতার ভূত। টয়লেটের লাগোয়া নিকাশি নেই বহু বাড়িতে, ব্যবহার করতে হয় সেপটিক ট্যাঙ্ক। হিন্দুদের চোখে ট্যাঙ্ক সাফাই ‘ছোট জাত’-এর কাজ, যাঁদের তাঁরা সহজে বাড়ির কাজে ডাকতে চান না। দেখা গিয়েছে, ভারতে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি টয়লেটের সেপটিক ট্যাঙ্ক সাধারণ ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক বড় হয়, যাতে দীর্ঘ দিন পরিষ্কার না করলেও চলে। বহু স্কুলে টয়লেট তৈরি হয়ে পড়ে আছে, সে-ও এই মানসিকতা থেকেই। শিক্ষকদের প্রশ্ন, পরিষ্কার করবে কে? ‘ছোট’ কাজটিতে শামিল হতে তাঁদের বড় আপত্তি। যে স্কুলে টয়লেট ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও ঝাড়ুটি হাতে ধরছেন। ‘কে করবে’ প্রশ্নটা আর রাস্তা আটকে দাঁড়াতে পারে না।
যা ছিল ‘বড় বাইরে’, তাকে ‘বড় ভিতরে’ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ মানুষ মারা যদি পাপ হয়, তা হলে মাঠে যাওয়ার চেয়ে বড় পাপ বোধহয় আর কিছু নেই। এই একটা কাজ যে কত শিশুর মৃত্যু ডেকে আনছে, আরও কত শিশুকে রোগা, বেঁটে করে রাখছে, গবেষকরা তার নতুন নতুন সাক্ষ্য বার করে আনছেন। এ দেশে প্রতি বছর ৪০ লক্ষ শিশু উদরাময়ে মারা যায়। কয়েক কোটি অনবরত পেটের রোগে ভোগে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, যেখানে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের অভ্যাস যত বেশি, সেখানে শিশু-অপুষ্টির হারও বেশি। মল থেকে ছড়ানো জীবাণুতে বার বার পেট খারাপ, তা থেকে এক রকম দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি তৈরি হচ্ছে। না হলে আফ্রিকার গরিবতর দেশের শিশুরা কী করে ভারতীয় শিশুদের চেয়ে লম্বা হয়? গবেষকরা অনেক মাপজোক, হিসেবনিকেশ করে বলছেন, ভারতে টয়লেট ব্যবহার বাড়লে শিশুরা আরও বেশ কিছুটা লম্বা হত। আর সুপুষ্ট, লম্বা শিশুরা লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে পারে আরও ভাল, সে-ও প্রমাণিত।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে’। সে কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। কলুষের আশঙ্কায় ঘরে ছোট জাতকে ডেকে এনে ঘর অশুচি করার ভয়ের শেষ পরিণতি: সন্তানের রোগ, মৃত্যু। আর গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের পিছিয়ে পড়া। কী হবে তোমার মঙ্গলে গিয়ে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে, যদি শিশুদের বাঁচাতে না পারো? কী হবে আমেরিকা-চিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, যদি বাংলাদেশ-কিনিয়ার কাছে হেরে বসে থাকো?
এই প্রশ্নগুলো ‘স্বচ্ছ ভারত’ তুলবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। ‘নির্মল ভারত’-এও টয়লেট ব্যবহারের প্রচারকে খাতায়-কলমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাজের বেলায় তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল টয়লেট তৈরির প্রকল্প। তাতে নেতা-অফিসার-ঠিকাদার চক্রের পোয়াবারো এই মুহূর্তে ভারতে প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ ‘মিসিং টয়লেট’ রয়েছে। মানে, হিসেবের খাতায় সেগুলো আছে, বাস্তবে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এও দেখা যাচ্ছে, মানুষের আচরণ বদলানোর কাজকে গুরুত্বের বিচারে এক নম্বরে রেখেও কাজের বেলায় বরাদ্দ কেবল ১৫ শতাংশ টাকা। তাড়া পড়ছে দিনে ৪৮ হাজার টয়লেট নির্মাণে। ক্রমাগত টয়লেট জোগান না দিয়ে, কী ভাবে টয়লেটের চাহিদা বাড়ানো যায়, সেটা চিন্তা না করলে ফের একগাদা টাকা বাজে খরচ হবে ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের নামে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy