ক্ষুদিরাম বসু। মজফ্ফরপুর জেলে তোলা ছবি।
ইতিহাসের মূল সূত্র নানা তথ্য, নথি। গবেষকদের কাছে যার মূল্য অসীম। অথচ বহুব্যবহৃত গ্রন্থাগার বা লেখ্যাগারের বাইরে পড়ে থাকা নানা তথ্য অনেক সময়ই নজর এড়িয়ে যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের এমনই বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি অবহেলায় পড়ে রয়েছে আলিপুর জজ কোর্ট-এর ‘স্মরণীয় বিচার সংগ্রহ’-এ। গবেষকদের চোখে পড়লে সে সব হয়তো নানা ঐতিহাসিক বিতর্কে আলোকপাত করতে পারত।
যেমন প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যু-রহস্য। প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছিলেন, না কি ব্রিটিশের হাতে খুন হয়েছিলেন, সে ধন্দ আজও কাটেনি। আলিপুর জজ কোর্টের সংগ্রহালয়ে পড়ে আছে মৃত্যুর পর প্রফুল্লর সামনের ও পাশের দিকের দুষ্প্রাপ্য ছবি। খাটিয়ার সঙ্গে দেহটি বেঁধে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে তোলা হয়েছিল সেই ছবি। তাতে গুলির ক্ষত পরিষ্কার। ভালই বোঝা যায় নাক ও বাঁদিকের কান দিয়ে রক্ত বেরোনোর দাগ বা ঠোঁটের ডান দিকের ক্ষতটি। রক্ত গড়িয়ে পড়ার কোনও চিহ্ন নেই, অতএব ধরে নেওয়া যায়, ছবি দুটো মৃত্যুর বেশ পরে রক্ত জমাট বাঁধার পর তোলা হয়েছিল। এই ছবি প্রফুল্লর মৃত্যু রহস্য উন্মোচনে গবেষকদের কতটা সহায়ক হতে পারে, তার সাম্প্রতিক নজির নির্মলকুমার নাগের প্রফুল্ল চাকী: নিহত নায়ক (বুনোহাঁস)।
সংগ্রহালয়ে তিনটি ঘরের আনাচেকানাচে এমন অনেক নিদর্শন। অনাদরে পড়ে আছে ক্ষুদিরাম বসু মামলার নানান নথি। মজফ্ফরপুরের ধর্মশালা থেকে প্রফুল্ল ‘দীনেশচন্দ্র রায়’ ছদ্মনামে বারীন ঘোষকে (‘সুকুদা’ সম্বোধনে) সাংকেতিক ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে কিংসফোর্ডের কথা বলতে গিয়ে লেখেন, ‘আজও বর দেখি নাই। তবে বাড়িটা একরকম দেখা হইয়াছে। বরের বাড়ি সব মন্দ নহে।’ ক্ষুদিরাম মামলায় সে চিঠি পেশ করা হয়েছিল। রয়েছে ক্ষুদিরামের ধরা পড়ার ছবি, ফাঁসির আগের ছবি, তাঁর ধরা পড়ার টেলিগ্রাম, প্রফুল্লর মৃতদেহের সদগতির জন্য তার, দেহ শনাক্তকরণের জন্য এসপি-র পাঠানো টেলিগ্রাম, জেলে বসে ক্ষুদিরামের নানা লেখা বা প্রফুল্ল চাকীর মৃতদেহ শনাক্ত করার বিষয়ে ক্ষুদিরামের বিবৃতি, ক্ষুদিরামের স্বাক্ষর ইত্যাদি। কিংসফোর্ড হত্যার জন্য অকুস্থলের যে মানচিত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটিও পড়ে আছে এক কোণে। মামলায় এগুলিই ছিল সরকারপক্ষের হাতিয়ার। প্রফুল্ল চাকীর দেহতল্লাশিতে পাওয়া গিয়েছিল মোকামা-হাওড়া পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট, সেটি দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। এই মামলায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় মজফ্ফরপুরের ধর্মশালার ম্যানেজার কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলার কাগজপত্রও রয়েছে এখানে।
নথিগুলি এক বাতিল দেরাজে বন্দি হয়ে পড়েছিল বহু দিন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আলিপুরের অতিরিক্ত জেলা জজ পিয়ারিলাল দত্ত নতুন কিছু করার জন্য আইনজীবী কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত মুখোপাধ্যায় ও মৌ চট্টোপাধ্যায়কে উদ্যোগী হতে বলেন। তখন আলমারিটি নজরে আসে। ফৌজদারি আইনজীবীদের সাহায্যে ঝানু চোর দিয়ে সেই আলমারির তালা খোলা হয়। তাতেই মেলে গুরুত্বপূর্ণ সব মামলার নথি। সে সব নিয়েই তৈরি হয় ‘স্মরণীয় বিচার সংগ্রহ’ (উদ্বোধন: ১৫ অগস্ট ১৯৯৮)।
ধরা যাক রাইটার্স বিল্ডিংসে অলিন্দ যুদ্ধের মামলাটি। এখানে রয়েছে বিনয়-বাদল-দীনেশ ব্যবহৃত মানচিত্র, মৃত সিম্পসন ও বিপ্লবীদের ছবি, সুরতহাল রিপোর্ট-সহ নানা নথি। এ সব কাজে লাগিয়ে অলিন্দ যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হবে না? বিপ্লবীদের জন্মদিন মৃত্যুদিনে মাল্যদানেই আমাদের কাজ শেষ?
কলকাতা ও আশপাশের বহু বাড়ি বিপ্লবী কার্যকলাপের ঘাঁটি ছিল। এই নথি ঘেঁটে সেগুলির তালিকা তৈরি হয়। সে সব বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমান বাসিন্দারা সেই সব ইতিহাস কিছুই জানেন না। আছে ‘নবশক্তি’, ‘সন্ধ্যা’, ‘হিন্দুস্তান’, ‘যুগান্তর’, ‘বন্দেমাতরম’ প্রভৃতি পত্রিকার সংখ্যা, যেগুলি কোনও না কোনও মামলায় প্রদর্শিত হয়। এ সব পত্রিকা গ্রন্থাগারেও দুর্লভ। ‘লিবার্টি’ পত্রিকা প্রকাশের দায়ে প্রেসে খানাতল্লাশিতে বাজেয়াপ্ত মুদ্রণ প্লেট বা রাজাবাজার বোমার মামলায় ব্যবহৃত বোমার খোলটিরও দেখা মেলে এখানে।
আলিপুর বোমার মামলার নথি, অর্ডার শিট, সাক্ষ্য, অরবিন্দ ঘোষের লিখিত জবাব, অতিরিক্ত দায়রা বিচারক সি পি বিচক্রফ্ট-এর রায় এখানে ফাইলবন্দি। ঘরে ঢুকলেই হঠাৎ যেন পিছিয়ে যেতে হয় সেই মামলার শুনানির সময়ে। পিছনের সারিতে অরবিন্দ, তার আগে পর পর বসে আছেন নলিনীকান্ত গুপ্ত, সুধীরকুমার সরকার, শিশিরকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমুখ। সে দিনের অনুসরণে বিভিন্ন সারিতে অভিযুক্ত বিপ্লবীদের ছবি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যে চেয়ারে বসে সওয়াল করতেন বা বিচারক বিচক্রফ্টের বসার জায়গা বা সেই সময়ে ব্যবহৃত আসবাব, সবই আজও অক্ষত।
১৯৪০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি হরিশ পার্কে বক্তৃতা দিয়ে মামলার কবলে পড়েন সুভাষচন্দ্র বসু। মিউজিয়মে রয়েছে তাঁর সই করা ওকালতনামা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, অসুস্থতার রিপোর্ট, অন্তর্ধানের পর কোর্টে দাখিল করা তাঁর সম্পত্তির হিসেব। এক একটি আলমারি স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এদের আয়ু আর কত দিন, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কমল বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, বেশ কয়েক বছর আগে মিউজিয়ম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় অনুদান এসেছিল। রাজ্য সরকারের ‘ম্যাচিং গ্র্যান্ট’ না পাওয়ায় সে অনুদান ফেরত চলে যায়।
স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে মুখরিত হয় শহর। কিন্তু এ শহরেরই এক প্রান্তে অবহেলায় পড়ে আছে স্বাধীনতা আন্দোলনের এমন সব গুরুত্বপূর্ণ নথি। ফি-বছর স্বাধীনতা দিবসে কিছু অনুষ্ঠান হয় সংগ্রহালয় চত্বরে। সে সময় কিছু মানুষ উঁকিঝুঁকি দেন আলমারি শোকেসের ধুলোমাখা কাচে। ব্যস, এইটুকুই। বিচারের বাণী সত্যিই এখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy