ইতিহাসবিদ অনুরাধা রায়ের জ্ঞান চর্চার মুখ্য বিষয় সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস ও তার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। যাঁরা তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা আলোচ্য বইটির শিরোনাম থেকেই বুঝতে পারবেন যে এটি তাঁর অনুসৃত গবেষণাকর্মেরই একটি নতুন ও সম্প্রসারিত ভাষ্য। যাঁরা সে ভাবে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁরাও এ বিষয়ে একমত হবেন যে, চর্চিত বিষয়বস্তুটির গুরুত্ব এক দিকে যেমন অনস্বীকার্য, অপর দিকে সংস্কৃতি ভাবনার তাত্ত্বিক অনুশীলনের কাজটিও কিন্তু রীতিমত কঠিন একটি বিষয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাই বামপন্থী সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান হিসেবে স্বীকৃত হলেও এই ধারাটির কোনও যথার্থ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সে ভাবে হয়নি। এই পর্বের মূল্যবান দলিল সংকলন শিপ্রা সরকার, ধনঞ্জয় দাস, সুধী প্রধান প্রমুখ অনেকটাই করে দিয়ে গেছেন এবং সেই সুবাদে তিরিশ ও চল্লিশের দশকের বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনেক তথ্য এখন আমাদের নাগালে এসেছে। প্রয়োজন ছিল এই তথ্যভাণ্ডারের একটি যথার্থ তাত্ত্বিক আলোচনা। এই কঠিন কাজটি অনুরাধা খুব পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে প্রয়াসী হয়েছেন। বইটির জোর এখানে।
পরিশিষ্ট সহ মোট সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটির একটি বড় অংশে আলোচিত হয়েছে ইউরোপ থেকে আহরিত মার্কসবাদ, বিশেষত মার্কসবাদের সোভিয়েত ভাষ্য, সামগ্রিক ভাবে বাম, অ-বাম সব বুদ্ধিজীবীকেই কতটা প্রভাবিত করেছিল। মার্কসবাদের বিজ্ঞানমনস্কতার ভাবনা ও রুশ বিপ্লবের সাফল্য ও আদর্শের অভিঘাত পরাধীন ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষের একাংশের মতো বুদ্ধিজীবী মহলকেও প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছিল। সবাই যে মার্কসবাদের পক্ষে ছিলেন তা যেমন নয়, তেমনই আবার মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের ভাবনাকে অগ্রাহ্য কিংবা উপেক্ষা করাও সম্ভব ছিল না। নানা মত, নানা স্বরের সংশ্লেষে তৈরি হয়েছিল মার্কসবাদ চর্চার একটি বৌদ্ধিক পরিমণ্ডল, যেখানে শামিল হয়েছিলেন নির্মলকুমার বসু, বিনয় সরকার, ধূর্জটিপ্রসাদ, শিবরাম চক্রবর্তী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ রায়, অমরেন্দ্রপ্রসাদ মিত্র, গোপাল হালদার, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ একনিষ্ঠ মার্কসবাদী। ‘পরিচয়’, ‘অরণি’-র ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য (প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়)। তবে রবীন্দ্রনাথকে এই বিতর্কে শামিল করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় (পৃ ১৮)। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র নির্মাণের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি তিরিশের দশকে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও মহাযুদ্ধের জেরে যুদ্ধবিরোধী, ফ্যাসিবিরোধী যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বকে উদ্বেলিত করেছিল, বাংলার বাম সাংস্কৃতিক জগতে তার প্রভাবও ছিল যথেষ্ট।
যদিও বইটির আলোচনার প্রেক্ষিত তিরিশ ও চল্লিশের দশকের বাংলায় বাম সাংস্কৃতিক চর্চা, সামগ্রিক ভাবে শিল্প, সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে মার্কসবাদী পরম্পরায় বিভিন্ন সময়ের তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়েও বেশ কিছু কথা কয়েকটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে। এর ফলে পাঠক নিশ্চয়ই লাভবান হন, কিন্তু কিছু সমস্যাও তৈরি হয়। লুকাচ, আডোর্নো, বেনইয়ামিন, আলথুসের প্রমুখের বক্তব্য আলোচিত হয়েছে বেশ কিছু জায়গায়, আর তার ফলে পাঠকের মনে এঁদেরকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা বিতর্কগুলি সম্পর্কে জানবার একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়, যেমন, ব্লখ-লুকাচ, লুকাচ-ব্রেখট, আডোর্নো-বেনইয়ামিন বিতর্ক। কিন্তু এই বিতর্কগুলির কোনও স্পষ্ট আভাস বইটিতে মেলে না। আরও একটি সমস্যা, এই তত্ত্বগুলির সঙ্গে তিরিশ-চল্লিশের বাংলায় মার্কসীয় ঘরানায় পুষ্ট সংস্কৃতি ভাবনার যোগসূত্রটি স্পষ্ট নয়, কিংবা স্পষ্ট নয় বঙ্গীয় মার্কসবাদকে বোঝার ক্ষেত্রে এই সব তত্ত্বের তাৎপর্যের বিষয়টি।
তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যেখানে অনুরাধা বুঝতে চেয়েছেন শিল্পসাহিত্য বিষয়ে সমকালীন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন যে লাইন বাতলে দিয়েছিল সেটি কতটা প্রভাবিত করেছিল এখানকার বাম বুদ্ধিজীবী মহলকে। এই লাইন, যা প্রায় ফতোয়ার রূপ ধারণ করেছিল চল্লিশের দশকের শেষ পর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নে, তিরিশ-মধ্য চল্লিশ পর্বে তার দাপট ছিল তুলনায় কম। সেই সঙ্গে অবশ্য স্মরণ করতে হয় এই পর্বে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশীর ভূমিকা, যিনি পার্টি লাইনের একনিষ্ঠ অনুগামী হয়েও সংস্কৃতির জগতে এই ধরনের কোনও লাইন চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। এই কারণে আলোচ্য পর্বটিতে দেখা যায় দুই বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গির সহাবস্থান। অনুরাধা দেখিয়েছেন (চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়) শিল্পের স্বকীয়তা বনাম পার্টি-আনুগত্য, শিল্পের নিজস্বতা বনাম যান্ত্রিক, একরৈখিক নির্ধারণবাদ— এই বিতর্কে সে দিন শামিল হয়েছিলেন এক দিকে যেমন বিষ্ণু দে, সুশোভন সরকার, নীরেন্দ্রনাথ রায়, নরহরি কবিরাজ প্রমুখ নরমপন্থী, অপর দিকে তুলনায় অপেক্ষাকৃত কট্টরপন্থীদের মধ্যে ছিলেন সরোজ দত্ত, ভবানী সেন, চিন্মোহন সেহানবিশ ও তাঁদের অনুগামীরা। এই বিতর্ক যখন দানা বাঁধছিল, তখন বাম মহলে সংস্কৃতির প্রশ্নে প্রামাণ্য ভাষ্যটি ছিল প্রচলিত সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি, যেটি আদ্যন্ত যান্ত্রিকতা ও একরৈখিকতার ভাবনায় পুষ্ট, এবং যার ফলে মার্কসবাদ পর্যবসিত হয়েছিল এক ধরনের সংকীর্ণ শ্রেণিনির্ধারণবাদে, এবং এই ভাবনাই বহুলাংশে গ্রাস করেছিল কট্টরপন্থীদের। কিন্তু অনুরাধা দেখিয়েছেন, তার মধ্যেও ব্যতিক্রমী কণ্ঠ ছিল এবং তার খোঁজ রাখতেন নীরেন রায়ের মতো কেউ কেউ। সোভিয়েত নন্দনতত্ত্ববিদ মিখাইল লিফশিৎস-এর দ্য ফিলজফি অব আর্ট অব কার্ল মার্কস ১৯৩৮ সালে ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হওয়ার পরে পরেই নীরেন্দ্রনাথের লেখায় তা ধরা পড়েছে (পৃ ১৩৩)। জদানভতন্ত্রের উত্থান তখনও হয়নি এবং সেই কারণে প্রথমে সন্দেহভাজন ও পরে সোভিয়েত পাটির্ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়েও মস্কোতে বসে লিফশিৎস ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী গেওর্গ লুকাচ মার্কসীয় অভিজ্ঞানে বুর্জোয়া ঐতিহ্যের কদর করতে সাহসী হন। ট্রটস্কির লিটারেচার অ্যান্ড রেভলিউশন-এর ইংরেজি ভাষ্য প্রকাশিত হয় ১৯২৫-এ। কৌতূহল রয়ে গেল, ব্যতিক্রমী এই অতিমূল্যবান রচনাটির কোনও হদিশ কি নীরেন্দ্রনাথের কাছে ছিল? একটি তথ্যগত বিভ্রান্তির কথা এখানে বলতে হয়। একাধিক জায়গায় বলা হয়েছে (পৃ ১০৯, ১১২) যে, তিরিশের দশক থেকে যে যান্ত্রিক একরৈখিকতার ভাবনা বুদ্ধিজীবীদের এক বড় অংশকে অতি-বামপন্থার ভাবনায় আচ্ছন্ন করেছিল, তার মূলে ছিল জদানভীয় ভাবাদর্শের প্রভাব। জদানভতন্ত্রের উত্থান ও তার জাঁকিয়ে বসা এর সবটাই কিন্তু ঘটেছিল চল্লিশের দশকের শেষ পর্বে, তার আগে নয়।
বইটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। অনুরাধা দেখিয়েছেন যে তিরিশ-চল্লিশ কালপর্বে মার্কসবাদের আবেদন এতটাই প্রবল ছিল যে অ-মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেও তাঁদের মতো করে মার্কসবাদকে একটি প্রায়োগিক বিষয় হিসেবে দেখেছিলেন। ইতিহাস ও সভ্যতার অগ্রগতি, জাতপাত ও ধর্ম, নারীবিষয়ক ভাবনা, অর্থনীতিঘটিত প্রশ্নের বিচার-বিশ্লেষণে আগ্রহী হয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী, নির্মলকুমার বসু, প্রফুল্লকুমার সরকারের মতো অনেকেই। আবার অনিলচন্দ্র রায়, গোপাল হালদার, সরোজ আচার্য, শিবরাম চক্রবর্তী, ধূর্জটিপ্রসাদ, অমলা দেবী প্রমুখের রচনার দীর্ঘ, চমৎকার বিশ্লেষণ করে অনুরাধা দেখান যে, তত্ত্বগত ভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি তাঁরা উত্থাপন করেছিলেন সেগুলি ছিল এ রকম: মার্কসবাদ বিজ্ঞান না নৈতিক আদর্শ? মার্কসবাদ কি এক ধরনের নিয়তিবাদকে প্রশ্রয় দেয়? মার্কসবাদ কি একটি বিদেশি পরধর্ম? মার্কসবাদ কি নিছকই বস্তুতান্ত্রিক জাগতিক স্বার্থের আলোচনাতেই নিজেকে সীমিত রাখে? ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্ককে সাম্যবাদ কী ভাবে বিচার করে?
চিন্তাশীল পাঠকমহলে বইটি সমাদৃত হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এই বিষয়ে আগ্রহী আগামী দিনের গবেষকদের বইটি পথ দেখাবে। অনেক পরিশ্রম করে, প্রচুর বইপত্র ঘেঁটে অনুরাধা বইটি লিখেছেন। তাই একটি গ্রন্থপঞ্জির অন্তর্ভুক্তি বিশেষ প্রযোজনীয় ছিল। ওঁর পরবর্তী কাজের অপেক্ষায় রইলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy