Advertisement
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
পুস্তক ১...

ভ্রান্তিবিলাস থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন

ইনটারোগেটিং পলিটিক্স অ্যান্ড সোসাইটি: টোয়েন্টিয়েথ-সেঞ্চুরি ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, সুরঞ্জন দাস। প্রাইমাস বুকস, ৯৫০.০০। লিখছেন জয়ন্ত সেনগুপ্ত।এই বইয়ের লেখক অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস শুধু অগ্রণী ঐতিহাসিক এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদক্ষ উপাচার্যই নন, আমার সাক্ষাৎ মাস্টারমশাইও বটে। আন্দাজ তিন দশক আগে এক অতীব সঙ্গত কারণে তিনি আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন, আমার অকালপক্ক যৌবনের ইতিহাসে সে ঘটনা এক জ্ঞানচক্ষু-উন্মিলক ও যুগান্তকারী চপেটাঘাতের সমতুল।

মেটিয়াবুরুজ। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯২

মেটিয়াবুরুজ। ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯২

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

এই বইয়ের লেখক অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস শুধু অগ্রণী ঐতিহাসিক এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদক্ষ উপাচার্যই নন, আমার সাক্ষাৎ মাস্টারমশাইও বটে। আন্দাজ তিন দশক আগে এক অতীব সঙ্গত কারণে তিনি আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলেন, আমার অকালপক্ক যৌবনের ইতিহাসে সে ঘটনা এক জ্ঞানচক্ষু-উন্মিলক ও যুগান্তকারী চপেটাঘাতের সমতুল। এ হেন মাস্টারমশাইয়ের বইয়ের আলোচনায় ঘরোয়া নিয়ম বা ‘হাউজ স্টাইল’ মেনে তাঁকে প্রথম নামে চিহ্নিত করতে হবে, এ জন্য আমার যারপরনাই কুণ্ঠা রয়েছে। আশা করি মাস্টারমশাইও তাঁর স্বভাবসিদ্ধ স্নেহে আমার সেই অনিচ্ছাকৃত স্খলনকে ক্ষমা করবেন।

বইটির এগারোটি প্রবন্ধের মধ্যে বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে রয়েছে পাঁচটি প্রবন্ধ, যার বক্তব্য নতুন নয়, সুরঞ্জনের বহুপঠিত বই কমিউনাল রায়ট্স ইন বেঙ্গল, ১৯০৫-১৯৪৭-এর সুবাদে যে বক্তব্য আমরা জানি। ধর্মবোধ বা ধর্মীয় চেতনা আর সাম্প্রদায়িক অভিজ্ঞানের মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক, ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীচেতনা (‘কমিউনিটি কনশাসনেস’) যে ভারতীয় সমাজে বরাবরই ছিল, তার সঙ্গে ধর্মীয় সমন্বয়বাদের (‘সিনক্রেটিজম’) কোনও বিরোধ ছিল না, বিশ শতকের প্রথম তিন দশকের বাংলার বিভিন্ন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাতেও এই গোষ্ঠীচেতনার স্বতঃস্ফূর্ততা এবং প্রায়শই তার মধ্যে শ্রেণিচেতনার স্বাক্ষর ছিল লক্ষণীয়, এই বক্তব্য সুরঞ্জনের গবেষণার সুবাদেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু, তিরিশ আর চল্লিশের দশক থেকেই এই স্বতঃস্ফূর্ততার জায়গা নিতে শুরু করে জমায়েত আর জিগিরের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা এক সংগঠিত সাম্প্রদায়িকতা, অবশ্যম্ভাবী ভাবেই যা দাঙ্গার চরিত্রেও নিয়ে আসে এক অমোঘ পরিবর্তন। দেশভাগের ছায়া ঘনিয়ে আসা বাংলায় এর পর থেকে আমরা দেখব সংগঠিত এবং নেতাদের হুকুমবরদার দাঙ্গাবাজদের, যারা এখন থেকে হয়ে দাঁড়াবে সাম্প্রদায়িকতার অগ্রসৈনিক। সুরঞ্জনের মতে এই সাম্প্রদায়িকতা উপনিবেশবাদের অবদান, ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষের সনাতন গোষ্ঠীচেতনাকে ভেঙেচুরে যে নতুন অভিজ্ঞানের কাঠামো তৈরি করে, তার মধ্যেই এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আঁতুড়ঘর। ক্রিস বেইলির মতো যে ঐতিহাসিকরা মনে করেন সাম্প্রদায়িকতা প্রাক্-ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজেও প্রোথিত ছিল, তাঁদের সঙ্গে সুরঞ্জনের মূলগত পার্থক্য এখানেই।

এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই, উপরন্তু আজও অতি প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অব্যবহিত পরে মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ সহ দক্ষিণ-পশ্চিম ও পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যে দাঙ্গা হয়, তার পিছনে প্রধান চালিকাশক্তি যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নয়, বরং প্রোমোটার-পুলিশ-রাজনীতিকের ত্র্যহস্পর্শে গড়ে-ওঠা এক জমি-দখলের ষড়যন্ত্র সুরঞ্জনের এই চমকপ্রদ বক্তব্য ‘মডার্ন এশিয়ান স্টাডিজ’ পত্রিকায় বহু আগেই পড়েছি, কিন্তু এখনও আধুনিক ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বহু দাঙ্গার চরিত্র বোঝার জন্যই এই বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। মোটের উপর সুরঞ্জনের গবেষণা আমাদের বোঝায়, দাঙ্গা মানেই সাম্প্রদায়িক নয়, ‘সাম্প্রদায়িক’ একটি অভিধা মাত্র। তার আড়ালে অহরহ লুকিয়ে থাকে শ্রেণিগত বিরোধ, জমায়েতের রাজনীতি, ব্যবসায়িক অভিসন্ধি, গুন্ডাবাজি, মাস্তানি, জবরদখল ইত্যাকার নানাবিধ ফন্দি। নিজের ধান্দাতেই সে সব ফন্দি নিত্যনতুন ফিকির খোঁজে; মওকা বুঝে হিন্দু, মুসলিম, শিখ যে কোনও গোষ্ঠীর উলুখাগড়া গোছের লোকদের লেলিয়ে দেয় একে অন্যের উপর, আর সেই সব সুপরিকল্পিত মারণযজ্ঞের সমস্ত প্যাঁচপয়জার না বুঝেই আমরা তাদের উপর বিছিয়ে দিই ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’-র নামকম্বল। সুরঞ্জন এই ভ্রান্তিবিলাস থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন।

ঔপনিবেশিক ও সমসাময়িক ভারতে ইতিহাস চর্চার রাজনীতি যার মাধ্যমে চলেছিল এবং এখনও চলে অতীতের দখল নেওয়ার লড়াই-- সম্পর্কে সুরঞ্জনের প্রবন্ধটি ঠিক আজকের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ সম্পর্কে আগে অনেক লিখেছেন রোমিলা থাপার, মাজিদ সিদ্দিকি, বিনয় লাল। সেই ধারারই উত্তরসূরি এই প্রবন্ধ, আধুনিক ভারতের ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের অবশ্যপাঠ্য। এর পরের তিন-চারটি প্রবন্ধে রয়েছে ঔপনিবেশিক ভারতের শেষ তিন দশকে বাংলার রাজনীতিতে জঙ্গি প্রতিবাদের প্রকরণটির সুলুকসন্ধান। সেই সন্ধানে বার বার উঁকি মেরে যায় নিম্নবর্গের মানুষজন, বেকার ছোকরা থেকে শ্রমিক, বস্তিবাসী, কখনও বা নিছক লুটেরা। লক্ষণীয়, সুরঞ্জন এঁদের সরাসরি ‘সাবঅলটার্ন’ না বলে বলেছেন ‘সাবর্ডিনেট সোশ্যাল গ্রুপস’, এঁদের রাজনীতি নিয়ে তাঁর গবেষণায় ছাপ ফেলে যায় এরিক হব্সবম, জর্জ রুদে, রিচার্ড কব বা সুমিত সরকারের মতো ঐতিহাসিকদের কাজ। রণজিৎ গুহ-উত্তর সাবঅলটার্ন স্টাডিজ ঘরানার ঐতিহাসিকদের সঙ্গে তাঁর প্রধান তফাত হল, নিম্নবর্গত্বকে আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্করহিত এক নিরালম্ব ক্ষমতাহীনতা বলে দেখতে তিনি আদৌ রাজি নন, তাদের রাজনীতিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কবিযুক্ত এক স্বতঃচালিত শক্তি হিসেবে বিচার করতেও নয়।

রাজনৈতিক ইতিহাসকে সামাজিক বিবর্তনের এক বহতা দলিল হিসেবে দেখেন যে-ঐতিহাসিকরা, সুরঞ্জন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। এই ধারার সব থেকে চমকপ্রদ নিদর্শন বাংলার গুন্ডাদের নিয়ে এ বইয়ের শেষ প্রবন্ধ দুটি, যেখানে সুরঞ্জন পুলিশের বিরল নথি ঘেঁটে দেখিয়েছেন, কী ভাবে ঔপনিবেশিক সরকার বিভিন্ন গরিবগুর্বো, বেরোজগার, প্রান্তিক ও ছিন্নমূল মানুষের উপর দেগে দেয় ‘চরিত্রগত অপরাধপ্রবণতা’র শিলমোহর। আর স্বাধীন ভারতের পুলিশবাহিনীও আত্মস্থ করে চলে সেই ডিসকোর্সকেই। তার ফলে এই ছাপ্পা হয়ে ওঠে দুরপনেয়, ‘গুন্ডা’র জীবনচরিতের ট্র্যাজেডিটিকে বোঝা হয়ে ওঠে না আর। ১৯৯৬-এর এক যৌথরচিত নাতিদীর্ঘ বইয়ে আমাদের সামাজিক ইতিহাসের আখ্যানে ‘অপরাধী’দের এই অনুচ্চারিত ইতিহাসকে ঠাঁই দেওয়ার ডাক প্রথম দেন সুরঞ্জন। কিন্তু এতই গুরুত্বপূর্ণ ও বিরল এই ধরনের গবেষণা, যে এ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বইয়ের দাবি তাঁর কাছে থেকেই যায়।

এ সব সত্ত্বেও অবশ্য বইটির একটি গঠনগত সমস্যা হল, যে হেতু প্রবন্ধগুলির বেশির ভাগই বিভিন্ন জার্নালে বা সম্পাদিত বইয়ে আগে প্রকাশিত এবং প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় এখানে সংকলিত হয়েছে, তার ফলে অনেকগুলির গোড়াতেই বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্পর্কে প্রবন্ধগুলিতে-- সুরঞ্জনের তত্ত্বকাঠামোর চুম্বক ভাষ্যটি একই ভাবে পুনরাবৃত্ত হয়েছে, মনে হয়েছে এ তো একটু আগেই আগের প্রবন্ধেই পড়লাম। ১৯৯০ সালের ‘সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট’ থেকে পুনর্মুদ্রিত বইয়ের প্রথম প্রবন্ধের এক জায়গায় (পৃ. ৩) মুদ্রণপ্রমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না, এটিও পাঠকের এক সমস্যা বটে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে অনুরূপ একটি পূর্বলিখিত প্রবন্ধে সুরঞ্জনের আক্ষেপ যে, চল্লিশের দশকের বাংলায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে যে বিস্তারিত আলোচনা তিনি তাঁর বইয়ে করতে পারেননি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের নতুন ফাইল দেখে সেই আলোচনা তিনি এখানে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সময়াভাবে সেই সব ফাইল দেখে ওঠা গেল না। এই খেদোক্তি ১৯৯৪ সালে অর্থবহ হলেও, ২০১৪ সালে তা আর ঠিক প্রত্যাশিত বলে মনে হয় না।

আজ থেকে একুশ বছর আগে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জেরে মুম্বইয়ের দাঙ্গার মারণযজ্ঞের অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন লিখেছিলেন ‘প্রপ্যাগান্ডা অ্যান্ড দি লেজিটিমাইজেশন অব কমিউনাল আইডিওলজি: প্যাটার্নস অ্যান্ড ট্রেন্ডস ইন বেঙ্গল, ১৯০৫-১৯৪৭’ নামের প্রবন্ধ, যা এখানে পুনর্মুদ্রিত। তার শেষে লেখকের এক সতর্কবাণী (পৃ. ৩১), ‘‘If we have to counter communalism today we need to develop an effective anti-communal propaganda, highlighting the essential cultural unity of India, not in terms of the traditional dictum of ‘unity in diversity’ but on the basis of ‘diversity in unity.’’’ এ অবশ্য আমাদের সবারই সতত মনের কথা। কিন্তু, বিশেষ করে ভারতীয় গণতন্ত্রের এই দেবীপক্ষে, আশায় বুক বেঁধে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, ‘বেশ, দেখাই যাক না।’

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সচিব ও সংগ্রহাধ্যক্ষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review jayanta sen gupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE