সেই সব লাল-নীল-হলুদ-সবুজ প্রচ্ছদওয়ালা চটি বই। পড়ার বইয়ের বাইরের বই, কিন্তু দিব্যি সেঁধিয়ে থাকত পড়ার বইয়ে। জ্যালজেলে পাতার চটি বইয়ে আন্তর্জাতিক ড্রাগন, কালনাগিনী, বাজপাখি, ব্ল্যাকপ্যান্থার, কালো নেকড়ে এই সব রহস্যময় রঙিন চরিত্ররা স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি কিশোরদের চোখে কুহকের জাল বিস্তার করত। সেই কুহকের জাল ছবি আঁকিয়েদের রেখায় মাকড়শার জাল— গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি আর তার সহকারী রতনলাল কখনও সেই জালের অন্তরালে, কখনও বাইরে। রহস্য সমাধানে ও দস্যু শিকারের কাজে তারা ব্যস্ত। দেশেবিদেশে তাদের অবাধ গতি। কী ভাবে যে
তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেত তার বাস্তব বিবরণের ধার দিয়েও লেখক যেতেন না। পাঠকের চোখের সামনে দীপক ও রতন থাকত, আর থাকত চলমান যানটি। দীপক ও রতন ভাবত কম, কাজ করত বেশি। ছোট ছোট বাক্যে, তত্সম সাধু শব্দ আর অতত্সম শব্দ পাশাপাশি সাজিয়ে শ্রীস্বপনকুমার তাঁর দুরন্ত গতিময় কাহিনি বানিয়ে তুলতেন। ‘প্রেতলোকের বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস যেন নেমে এল অকলঙ্ক স্বর্গীয় নির্মলতার মাঝে’, ‘রাত তখন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজে’, ‘হ্যান্ডস আপ। মাথার ওপর হাত তোল শয়তান। পালাবার চেষ্টা করলে গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব’ এই সব বাক্য পড়লেই বোঝা যেত ইনি হচ্ছেন এক ও অদ্বিতীয় স্বপনকুমার। তাঁর ভাল নাম যে সমরেন্দ্র পাণ্ডে, শ্রীভৃগু নামে যে তিনি জ্যোতিষচর্চার বই লেখেন, ডা. এস এন পাণ্ডে নামে লেখেন বাংলায় প্র্যাকটিস অফ মেডিসিন জাতীয় বই, এই সব তথ্য অধিকাংশ পাঠকেরই ছিল অজানা। দেব সাহিত্য কুটীর, অক্ষয় লাইব্রেরি ছাড়া এই বই যাঁরা ছাপতেন সেই রাজেন্দ্র লাইব্রেরি, যোগমায়া লাইব্রেরি, সচদেব পুস্তকালয়ের মতো প্রকাশকরা তো জাতে কুলীন নন। আহিরিটোলা, ক্যানিং স্ট্রিট, পার্বতী ঘোষ লেনের সেই সব প্রকাশক যে সাংস্কৃতিক পণ্যটি উত্পাদন করতেন তাকে দেখে ‘বটতলার বই’-এর কথা মনে পড়ত।
আশির দশকের পর থেকে এই বইয়ের পাঠকপ্রিয়তা কমল। শুধু যে এর জন্য ফেলুদা দায়ী তা নয়। স্বপনকুমারের উপাদান নামকরা লেখকরাও নিয়ে নিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবুর গল্পও কি অনেক সময় স্বপনকুমারের চাল ব্যবহার করেনি! ‘পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক’-য় কাকাবাবু হিমালয়ে যাদের মোকাবিলা করলেন তারা কেমন করে যেন সেখানে মাটির নীচে লোহার পাত দিয়ে গোপন আস্তানা বানিয়েছিল! কাকাবাবুর অনেক লেখায় কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন এলাকায় দুষ্কৃতীদের সুড়ঙ্গময় বাড়ির বিবরণ আছে। পাবলিক লাইব্রেরি গুলে খাওয়া সুনীলের সঙ্গে স্বপনকুমারের রচনার উপাদানগত মিল থাকতে পারে— কিশোর বাঙালির মন পেতে একই পদে সুনীল রান্না চাপিয়েছেন, তবে পদের বিন্যাসে ও বাহারে তিনি অনেক বেশি পাককুশল। আর সুনীলের সব কাকাবাবু মোটেই স্বপনকুমারীয় নয়।শ্রীস্বপনকুমারের গোয়েন্দাকাহিনির পাঠক কারা? দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত বিশ্বচক্র সিরিজের বইয়ের ওপর লেখা থাকত ‘কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য’। এই ঘোষণা অকারণ ছিল না। অপরাধের সঙ্গে নারী ও যৌনবাসনার যোগাযোগ অনিবার্য। কিশোরপাঠ্য বাংলা অ্যাডভেঞ্চার-গোয়েন্দাকাহিনির লেখকরা এই জাতীয় উপাদান কিন্তু সযত্নে পরিহার করতেন। সত্যজিতের ফেলুদা-কাহিনিতে ক্রাইম তাই মূলত কতগুলি চেনা ছকের মধ্যে ঘোরাফেরা করে— মূর্তি চুরি, আংটি চুরি, লুকনো ধনসম্পদ অনুসন্ধান এই রকম কয়েকটি বিষয়ের পুনরাবৃত্তি। তবে সত্যজিত্ কখনও তথ্যে ফাঁক রাখেন না। লালমোহনবাবু যে রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের লেখক সেই শিহরণ জাগানো সিরিজে নানা ঘটনার সমাবেশ। লেখার গুণে পড়ার মুহূর্তে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন মাথা তুলতেই পারে না। বইয়ের কাটতিতে কখনও তাই ঘাটতি পড়ে না। এই অসম্ভব সিরিজ সাহিত্যের বিরুদ্ধেই তো ফেলুদার ‘সু-সাংস্কৃতিক’ জেহাদ। লালমোহনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সিরিজ-সাহিত্যের শুদ্ধিকরণ। শ্রীস্বপনকুমার এদিক থেকে ফেলুদার পালটা শিবিরের লোক। দুয়ের জাত পৃথক, কৌলীন্যের বিচারেও একের সঙ্গে অপরের তুলনাই চলে না। শ্রীস্বপনকুমার আবার পুরোপুরি জটায়ু নন। ‘আয়েশা এমন স্বরে রতনকে ডাকল যে রতনের যেন নেশা ধরে গেল’, ‘ফ্রান্স ডান্স শেষ হতেই বল ডান্স শুরু হয়ে গেল’ জটায়ু এই পথে কলম ছোটাননি। দেব সাহিত্য কুটীর তাই পড়ুয়াদের গোত্র নির্দেশ করে দিয়েছিলেন-- কলেজ স্টুডেন্টদের জন্য। সিংহের চোখে চাপ দিলে ঘর ঘর করে গোপন সুড়ঙ্গমুখ খুলে যায়, মাটির তলার ঘরে দস্যুরা গোপন মিটিং করে, দুর্দান্ত বাজপাখি ভারতে তার সাম্রাজ্য বিস্তারে উত্সাহী— এক রকম হিন্দি ছবিতে সত্তর আশির দশকে এমন কাণ্ড চলচ্চিত্রায়িত, স্বপনকুমারের চটি বইগুলিতে এই সব পরিবেশিত। সেখানে কলকাতার ভূগোলটিও বড় আজব। জায়গাগুলির নাম-ধাম একই আছে, তবে বাস্তবের সঙ্গে চেহারা চরিত্রের তেমন মিল নেই।
বাঙালির অ্যাডভেঞ্চার ও রোমাঞ্চ কাহিনি উপভোগের সামগ্রিক ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গেলে স্বপনকুমারে চোখ রাখা জরুরি। স্বপনকুমারের চটি বইগুলিকে গুচ্ছ করে লালমাটি খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছে— নিকট অতীতের বাঙালি পাঠকমনকে বুঝতে ও খুঁজতে খণ্ডগুলি সাহায্য করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy