Advertisement
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
পুস্তক ১...

কবির বীণায় যেন কোয়ান্টামের সুর

রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন/ এক অমীমাংসিত সংলাপ, সম্পাদনা: সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়। সাহিত্য সংসদ, ৫০০.০০রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন/ এক অমীমাংসিত সংলাপ, সম্পাদনা: সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়। সাহিত্য সংসদ, ৫০০.০০

মুখোমুখি। বার্লিনে আইনস্টাইনের ফ্ল্যাটে আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৬। এটিই দুই মনীষীর প্রথম প্রকাশিত (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৬) আলোকচিত্র। বই থেকে

মুখোমুখি। বার্লিনে আইনস্টাইনের ফ্ল্যাটে আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৬। এটিই দুই মনীষীর প্রথম প্রকাশিত (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৬) আলোকচিত্র। বই থেকে

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মাত্র দশ মিনিটের কথোপকথন। মোটেই শিষ্ট ছিল না সেই বাক্যালাপ। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট এক হলঘরে দুই জগদ্বিখ্যাত মনীষীর তর্ক পরিণত হয়েছিল রীতিমত ঝগড়ায়। চিৎকার, পাল্টা চিৎকারে। এতটাই যে, এক জন নাকি উত্তেজিত হয়ে হাতে তুলে নেন ফায়ারপ্লেসে আগুন খোঁচানোর দণ্ড (পোকার), আর তেড়ে যান অন্য জনের দিকে। কারা এই দু’জন? প্রবাদপ্রতিম দুই দার্শনিক কার্ল পপার এবং লুডভিগ হ্বিটগেনস্টাইন।

হ্যাঁ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক পপার বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়ে এসেছিলেন কেমব্রিজের কিংস কলেজে। বক্তৃতার আয়োজক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মরাল সায়েন্স ক্লাব। দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ও ছাত্রদের সাপ্তাহিক সান্ধ্য আলোচনার সংগঠন। যার প্রেসিডেন্ট আবার হ্বিটগেনস্টাইন। ওদিন সন্ধ্যায় পপারের বক্তৃতা শুনতে অনেকের সঙ্গে হাজির ছিলেন বারট্রান্ড রাসেল। বক্তৃতা শুনতে, না মজা দেখতে?

হয়তো দ্বিতীয় উদ্দেশ্যেই। কারণ, বক্তৃতা যে বাদানুবাদে মোড় নেবে, তা অনুমান করা শক্ত ছিল না। রাসেল তাঁর গুরু হলেও, দার্শনিক হিসেবে খ্যাতিতে তাকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন হ্বিটগেনস্টাইন। বিশেষত তরুণ ছাত্রমহলে। কারণ, যে কোনও তরুণ তুর্কির মতো হ্বিটগেনস্টাইনের মতবাদও ছিল ভীষণ র্যাডিকাল। তিনি বলতেন, দর্শনশাস্ত্রে প্রবলেম বা গভীর সমস্যা বলে কিছু নেই। যা আছে, সে সব নেহাতই কিছু পাজ্ল। ভাষার মারপ্যাঁচে তৈরি সামান্য কিছু ধাঁধা। এ হেন দাবি মানে দর্শনশাস্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত। অন্য দার্শনিকদের গাত্রদাহের কারণ। ওই শাস্ত্রের প্রথম সারির পণ্ডিত হিসেবে পপার তাই বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়ে তৈরি হয়েছিলেন হ্বিটগেনস্টাইনকে উচিত শিক্ষা দিতে। ভাষণে প্রমাণ করে ছাড়বেন যে, দর্শনের সমস্যা শুধু শব্দের কচকচি নয়। কিন্তু বক্তৃতা শুরু হতেই দুই জিনিয়াসে তর্কাতর্কি। উত্তপ্ত বাদানুবাদ। তারপর নাকি হ্বিটগেস্টাইনের পোকার হাতে পপারকে শাসানো। এবং নাকি দড়াম করে দরজা বন্ধ করে সভাকক্ষ ত্যাগ।

ওই ‘নাকি’ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। হ্বিটগেনস্টাইন-পপার বাদানুবাদ স্বাভাবিক। কিন্তু আগুন-গরম পোকার সহযোগে শাসানো? সত্যিই ঘটনা কি গড়িয়েছিল অতদূর? দর্শনের ছাত্ররা আজও কৌতূহলী ৭০ বছর আগের ওই বৃত্তান্তে। দশ মিনিটের ওই তর্ক নিয়ে আজও লেখা হয় বই।

হবেই। দুই মতের সংঘাত, তায় আবার উচ্চগ্রামে; সবার উপরে তর্কের বিষয়, যা কি-না কূট। বিখ্যাত দুই ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎও এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত। দুই জিনিয়াসের আলাপচারিতা সব সময় আকর্ষণীয় না-ও হতে পারে। এই যেমন দুই সাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্ত এবং জেমস জয়েস মুখোমুখি। এক জন আরেক জনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ট্রাফল (মুলোজাতীয় মিষ্টি খাদ্য) ভালবাসেন? জবাব: হ্যা।ঁ ব্যস, কথোপকথন শেষ। অথবা ধরা যাক, সুইজারল্যান্ডের গণিতজ্ঞ লিওনার্ড অয়লার এবং ফরাসি দার্শনিক দেনি দিদের-এর সাক্ষাৎ। আস্তিক আর নাস্তিকে মোলাকাত। মুখোমুখি তর্ক। অয়লার বললেন, এ প্লাস বি টু দি পাওয়ার এন ডিভাইডেড বাই এন ইজ ইকুয়াল টু এক্স। সুতরাং, ঈশ্বর আছেন। জবাব দিন। দিদের কুপোকাত, কারণ তিনি গণিতে অজ্ঞ। বিতর্ক শেষ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন বিংশ শতাব্দীর দুই জিনিয়াস। এই দুই বিস্ময়-প্রতিভার সাক্ষাৎ আমাদের কৌতূহলের বিষয়। ওঁদের কথোপকথন ছিল না হ্বিটগেনস্টাইন-পপারের বাক্য-বিনিময়ের মতো উত্তপ্ত, প্রুস্ত-জয়েসের প্রশ্নোত্তরের মতো তুচ্ছ, কিংবা অয়লার-দিদের-র মাঝে হেঁয়ালির মতো অর্থহীন। বরং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিস্বরূপ দুই মনীষীর মোলাকাতজনিত মত-বিনিময়, যা কি না ৮৪ বছর আগের ঘটনা, তা আজও যে-কোনও চিন্তাশীল মনের খাদ্য। এখনও তা উঠে আসে আলোচনায়। নানা প্রসঙ্গে বারবার। রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইন: এক অমীমাংসিত সংলাপ ওই কথোপকথনের ওপর জরুরি আলোকপাত। পরিপ্রেক্ষিত নানা ভাবে বিশ্লেষণে এবং দুই মনীষীর আলোচ্য বিষয়ের ওপর একাধিক প্রাবন্ধিকের টীকা-ভাষ্যে এই সংকলন গ্রন্থটিকে মূল্যবান করে তুলেছেন গবেষক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়। কবে, কোথায়, কত বার সাক্ষাৎ হয়েছিল কবি ও বিজ্ঞানীর, সে ব্যাপারে তথ্যের নানা অসংগতি যেমন তুলে ধরেছেন তিনি, তেমনই দেখিয়েছেন ওঁদের কথালাপের একাধিক মুদ্রিত বয়ানের পার্থক্য। এমন জট ছাড়ানোর কাজ রীতিমত শ্রমসাধ্য।

কী কী বিষয় আলোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন? এক কথায় গূঢ়, কূট নানা প্রশ্নে আবর্তিত হয়েছিল ওঁদের বার বারের কথালাপ। প্রাথমিক পরিচয়ে দুজনে কবি ও বিজ্ঞানী হতে পারেন, কিন্তু মূলত ওঁরা দার্শনিক। ওঁদের খোঁজ রীতিমত গভীরে। জার্মান যুব আন্দোলনের উৎস সন্ধান, প্রযুক্তির অগ্রগতি মানবজীবনে আশীর্বাদ না অভিশাপ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীত ও চিত্রশিল্পে শব্দ সুর সঙ্গতি রেখা ও রঙের ভূমিকা এ রকম সব প্রশ্নে ওঁরা চিন্তিত। তবে, যে বিষয়ে ওঁদের তর্ক এগিয়েছিল বহু দূর, যে বিষয়টা গত ৮৪ বছরে ভাষ্যকারদের নজর কেড়েছে প্রভূত পরিমাণে, তা হল সত্যের স্বরূপ। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাস্তব অবস্থা। তা কি মানুষের চেতনা-নিরপেক্ষ হিসেবে বিরাজমান? না কি সেই বাস্তবতা ওই চেতনারই নির্মাণ মাত্র?

কথালাপে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষা। ‘মাই মেমরিজ অব আইনস্টাইন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়, আর আমি জার্মান ভাষা জানি না। দোভাষীর পক্ষে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না।’ নিজের অজান্তে কথাবার্তায় ভাবের আদান-প্রদানে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। তাঁর বক্তব্যে ‘পারফেক্ট ম্যান’ ‘ডিভাইন ম্যান’, ‘সুপ্রিম ম্যান’, ‘ইউনিভার্সাল বিইং’ কিংবা ‘ইউনিভার্সাল মাইন্ড’ ইত্যাদি জটিল ধারণা আমদানি করে। এ কারণে কারও কারও মতে, আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ আলাপ যেন দুই গ্রহের কথোপকথন। কেউ কারও বক্তব্য বোঝেননি।

তবু ওঁদের বাক্য-বিনিময় আকর্ষণীয়। দুটি কারণে। কথাবার্তায় ওঁরা দাঁড়িয়ে নিজ নিজ মেরুতে। যেন ঘোষণা করছেন জাতি-ধর্ম। কবির দাবি, সত্য চেতনা-নিরপেক্ষ নয়। তা মানুষের নির্মাণ। এ ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারেন কবি? তিনি যে স্রষ্টা। শব্দে-শব্দে নির্মাণ করেন সত্য। আর বিজ্ঞানী? অন্তত আইনস্টাইন মনে করেন, তিনি দ্রষ্টা বই কিছু নন। নিজস্ব গুণাবলি নিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আপনি বিরাজমান। গবেষকের কাজ সে সব গুণের সন্ধান। হায়, আইনস্টাইনের এই বিশ্বাস যে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে বিজ্ঞানের নতুন শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তা যে বলে দিয়েছে, দৃশ্য থেকে দর্শক আলাদা নয়। দর্শক শনাক্ত না করলে দৃশ্য অবাস্তব। এ হেন বক্তব্য যে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি আইনস্টাইনের, তা বলাই বাহুল্য। তাই তিনি তাঁর জীবনীকার আব্রাহাম পায়াসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমরা না দেখলে চাঁদটা কি আকাশে নেই? কবি আর বিজ্ঞানীর তর্কের দ্বিতীয় আকর্ষণ ঠিক এইখানে। কবির বীণায় যেন কোয়ান্টামের সুর।

এ ব্যাপারে অনেকের ভাষ্য পড়তে পড়তে মনে পড়ছে এক জনের কথা। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। যিনি বলতেন, বিজ্ঞানে জিনিয়াস হয় না, শিল্প-সাহিত্যের হয়। আইজাক নিউটন জিনিয়াস নন, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার জিনিয়াস। কেন? মহাকর্ষ আর কেউ খুঁজে পেতেনই। কোপারনিকাস কেপলারের পর ফিজিক্স ওদিকেই এগোচ্ছিল। কিন্তু শেক্সপিয়ারের সনেট আর কেউ লিখতেন না।

কান্ট ঠিক বলেছিলেন কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE