Advertisement
E-Paper

ভাষার দাবিতে সরব ইতিহাস

স্বাধীনতার আগে কত ব্যাপক ছিল বাংলা ভাষার জন্য এই আবেগ, তার অনেক প্রমাণ ছড়িয়ে আছে সেই সময়ের বাংলা পত্রপত্রিকায়।

শিরোনামে: ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রথম পৃষ্ঠা।

শিরোনামে: ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রথম পৃষ্ঠা।

তিস্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:১১
Share
Save

ভাষা আন্দোলনের যে কোনও সাধারণ বর্ণনায়, এমনকি ইতিহাস বইতেও, চোখ বুলালে একটা আশ্চর্য ধাঁধা চোখে পড়ে। দেশভাগ হয়ে গেল, হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের নামেই ভাগ হল, আর তার পরেই পূর্ব পাকিস্তানে ভাষার ভিত্তিতে শুরু হল আন্দোলন। অর্থাৎ যেই-না ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি হয়ে গেল, তার পরেই এল ভাষার দাবি, যা শেষ পর্যন্ত পৌঁছল ভাষার ভিত্তিতে ভাগাভাগির আন্দোলনে। ধাঁধাটা হল, ইসলামি দেশ হিসাবে পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার পরেই কি তা হলে বাংলা ভাষার কথা মনে পড়ল বাঙালি মুসলমানের? তার আগে কি তাঁরা বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি?

সাম্প্রতিক ইতিহাস গবেষণা অবশ্য ইতিমধ্যে এই ধাঁধার সমাধান বার করেছে। একাধিক গবেষক দেখিয়েছেন, বাঙালি মুসলমানের বাঙালিত্বের দাবি মোটেই ১৯৪৭-পরবর্তী নয়, তার আগে থেকেই তার বাঙালি সত্তা যথেষ্ট দৃঢ়। কিন্তু গবেষণা-জগতের বাইরে ভাবনাচিন্তার পরিসরে এই আলোচনা এখনও তত শোনা যায় না, বরং প্রশ্ন শোনা যায়, কোথায় ছিল বাংলা ভাষার জন্য বাঙালি মুসলমানের এই আবেগ। প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে এই দুই খণ্ডের বই বিশেষ কাজে লাগতে পারে। ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ নয়, ‘পূর্ববঙ্গের’ ভাষা আন্দোলন নামটির জন্য সঙ্কলক আলাদা ভাবে অভিনন্দনযোগ্য।

স্বাধীনতার আগে কত ব্যাপক ছিল বাংলা ভাষার জন্য এই আবেগ, তার অনেক প্রমাণ ছড়িয়ে আছে সেই সময়ের বাংলা পত্রপত্রিকায়। এমনকি মুসলিম পত্রিকা বলে যেগুলি খ্যাত নয়, সেখানেও উঠে এসেছিল এমন আলোচনা। এই যেমন, ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকায় একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে বলা হয়েছে: “একটা কথা উঠেছে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নাকি হবে উর্দু। বাংলা ও আসামের যে যে অংশ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হচ্ছে, তার চার কোটি অধিবাসীদের মধ্যে বাংলা যারা বলে না কিংবা বাংলা যাদের মাতৃভাষা নয়, তেমন লোকের সংখ্যা হাজারে এক জনেরও কম। যেখানে প্রায় সকল অধিবাসীরই মাতৃভাষা বাংলা, সেখানে একটা স্বতন্ত্র ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করে ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, যেমন করেছিল আমাদের ইংরেজ প্রভুরা।”

পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলন: সংবাদপত্রের ভূমিকা ও ইতিহাস (১ম ও ২য় খণ্ড)

সুকুমার বিশ্বাস

৯৫০.০০ (দুই খণ্ড একত্রে)

নয়া উদ্যোগ

কেবল পত্রিকার লেখায় নয়, আনুষ্ঠানিক ভাবে সভা করে দ্বিখণ্ডিত বাংলা প্রদেশের দুই অংশেই বাংলাকে প্রধান ভাষা রাখার জন্য সওয়াল করা হয়েছিল— স্বাধীনতা ও দেশভাগের আগেই। তুলনায় কম-জানা এই তথ্য তুলে এনেছেন গ্রন্থকার। কলকাতার দারভাঙা ভবনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়: পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় যেন বাংলাকেই ‘medium of instruction’ রাখা হয়, এবং ‘court language’ রাখা হয়।

আরও পিছিয়ে গিয়ে এই বই মনে করিয়ে দিয়েছে যে উনিশশো ত্রিশের দশকেও বার বার বাংলা ভাষাকে বাঙালি মুসলমানের অন্যতম উত্তরাধিকার হিসাবে দেখা হয়েছিল। বলা হয়েছে, ভাষার সঙ্গে ধর্মের কোনও সংযোগ থাকার কথা নেই। বলা হয়েছে, ইসলামি ধর্মগ্রন্থ আরবি আর উর্দুতে লেখা হয়ে এসেছে বলে এ কথা মনে করা উচিত নয় যে বাংলার অনুসারী হলেই ইসলামের প্রতি কম শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়।

প্রথম খণ্ডের প্রাথমিক পর্বে এই আলোচনার পরই দ্বিতীয় অধ্যায় পত্রপত্রিকায় ধরে রাখা ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে। এত রকম পত্রিকার উদ্ধৃতি সমাহার দুর্লভ প্রাপ্তি, যদিও তার থেকে যে আখ্যানটি বেরিয়ে আসে, তা আমাদের এত দিনে পরিচিত। একই কথা প্রযোজ্য এই খণ্ডের আটচল্লিশ-উত্তর কাল বিষয়ক অধ্যায়ে, এবং দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম অধ্যায় ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং দ্বিতীয় অধ্যায়বাহান্ন-উত্তর কাল সম্পর্কে। নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি এই বিষয়ে আগ্রহীদের কাছে একটি বিশেষ জরুরি প্রাপ্তি। শেষে একটিই কথা। যে কোনও সঙ্কলন সুসম্পন্ন হয় সঙ্কলকের নিজদৃষ্টিভঙ্গি সন্নিবেশনের সুযোগ-সম্বলিত মুখবন্ধে। এই দিকে আর একটু মনোযোগ কাম্য ছিল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Language Movement

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}