সংশোধিত ওয়াকফ আইন প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ ঘিরে অশান্তি ছড়িয়েছে মুর্শিদাবাদের একাধিক এলাকায়। ধুলিয়ান, সুতি, শমসেরগঞ্জের মতো এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অশান্ত এলাকায় শান্তি ফেরাতে তৎপর হয় কলকাতা হাই কোর্টও। আদালতের নির্দেশেই মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। একই সঙ্গে টহল দিচ্ছে পুলিশও। যৌথ বাহিনীর অভিযানে ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ এলেও পরিবেশ এখনও থমথমে। রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষকে কমই দেখা যাচ্ছে। যদিও স্থানীয়দের একাংশের দাবি, কেন্দ্রীয় বাহিনী আসায় ভরসা পেয়েছেন তারা। অন্য দিকে, পুলিশও কড়া হাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে, ভুয়ো ছবি বা গুজবে কান না দেওয়ার বার্তা দিচ্ছে বার বার।
ওয়াকফ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই উত্তপ্ত মুর্শিদাবাদের একাংশ। হিংসার ঘটনা ঘটেছে শমসেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ানে। বেসরকারি সূত্রে খবর, হিংসার ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি খারাপ হতেই মুর্শিদাবাদ নিয়ে হস্তক্ষেপ করে হাই কোর্ট। আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে অশান্ত এলাকায়। বিএসএফ সূত্রে খবর, ১৫ কোম্পানি মোতায়েন রয়েছে মুর্শিদাবাদে। শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনী নয়, রাজ্য পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরাও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছেন। শনিবার রাতেই পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার। সূত্রের খবর, তিনি বিএসএফের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। এর পরেই জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নেমে রুটমার্চ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সঙ্গে রয়েছে পুলিশের বিশাল বাহিনীও।
অশান্ত পরিস্থিতিতে ধুলিয়ান, সুতি এবং শমসেরগঞ্জের অনেক বাসিন্দা ঘর ছেড়েছেন। গঙ্গা পেরিয়ে ও পারে মালদহের বৈষ্ণবনগরে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। প্রশাসনের তরফে তাঁদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে তাঁদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ শুরু করেছে পুলিশ। এই প্রসঙ্গে জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার সুপার আনন্দ বলেন, ‘‘অশান্তির কারণে যাঁরা ঘর ছেড়েছেন, তাঁদের সব রকম সাহায্য করছে পুলিশ। তাঁরা ঘরে ফিরে আসতে চাইলে সব রকম ভাবে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত রয়েছে পুলিশ।’’
গুজব বা ভুয়ো খবর রুখতে কিছু পদক্ষেপও করেছে পুলিশ। বিশেষ নির্দেশিকা জারি করে জানানো হয়েছে, রবিবার থেকে আগামী মঙ্গলবার রাত ১০টা পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকবে। শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, জেলা সংলগ্ন মালদহ এবং বীরভূমের বেশ কিছু এলাকাতে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধের কথা জানানো হয়েছে। তবে ফোনে কথা বলা যাবে, পাঠানো যাবে এবং এসএমএসও। সংবাদপত্রও পৌঁছোবে ওই সব এলাকায়। আগাম সতর্কতা হিসাবেই মালদহ এবং বীরভূমের কিছু এলাকায়ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে পুলিশের তরফে।
‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’
রবিবার সকাল থেকেই মুর্শিদাবাদের নানা প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছেন ডিজি। কখনও বৈঠক করেছেন বিএসএফের সঙ্গে, কখনও আবার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা সেরেছেন পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে। জেলার বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করে তিনি জানান, মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার কথা বলে ‘গুজবে কান না দেওয়ার’ বার্তাও দেন তিনি। স্থানীয়দের ‘নিশ্চিন্তে’ থাকার কথাও বলতে শোনা গিয়েছে পুলিশ আধিকারিকদের। শুধু তা-ই নয়, যদি কেউ কোনও সমস্যার সম্মুখীন হন, তবে অবিলম্বে পুলিশকে জানানোর বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
টহল দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী
উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরই মুর্শিদাবাদে পৌঁছে গিয়েছে বিএসএফ। সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত ১৫ কোম্পানি মোতায়েন রয়েছে মুর্শিদাবাদে। প্রয়োজনে রবিবার রাতে জঙ্গিপুর আরও পাঁচ কোম্পানি সিআরপিএফ নিয়ে আসা হতে পারে বলেই খবর বিএসএফ সূ্ত্রে। ওই সূত্র জানিয়েছে, মূলত ঝাড়খণ্ড (জামশেদপুর ও রাঁচী) থেকে জরুরি ভিত্তিতে বাহিনী আনা হচ্ছে মুর্শিদাবাদে। বাড়তি বাহিনী এসে পৌঁছোলে উপদ্রুত এলাকার পাশাপাশি আশপাশের এলাকাগুলিতেও চলবে রুটমার্চ। বাহিনী মোতায়েনের পর রবিবার জেলায় পৌঁছে গিয়েছেন বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের আইজি করণি সিংহ শেখাওয়াত। রাজ্য পুলিশের ডিজির সঙ্গে তিনি বৈঠকও করেছেন বলে খবর। রবিবার সকাল থেকেই বিভিন্ন অশান্ত এলাকায় টহলদারি শুরু করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। বিএসএফ ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ভিন্ন পদে কর্মরত ২৩ জন ‘দক্ষ’ পুলিশকর্তাকে ‘বিশেষ ডিউটি’তে পাঠানো হয় মুর্শিদাবাদে।
শাহের মন্ত্রককে চিঠি রাজ্যপাল বোসের
মুর্শিদাবাদের অশান্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দিলেন বাংলার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। রাজভবন সূত্রে খবর, শনিবার রাজ্যপালের নির্দেশে তাঁর দফতর থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্ত্রকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। রাজভবনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, মুর্শিদাবাদে ঘটে চলা ঘটনা প্রসঙ্গে গত কয়েক দিন ধরেই নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন রাজ্যপাল স্বয়ং। শুক্রবার এই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও বিশদে আলোচনা হয়েছে তাঁর। তার পরেই যাবতীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজভবন থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে দিল্লিতে। রাজভবনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ওই চিঠিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে রাজ্যপাল মুর্শিদাবাদে শান্তি ফেরানোর কথা বলেছেন।
রাজ্য পুলিশের ‘ফ্যাক্ট চেক’
রাজ্য বিজেপির সমাজমাধ্যমের পাতায় রবিবার কিছু টুকরো টুকরো অশান্তির ছবি একত্রিত করে পোস্ট করা হয়। সেই ছবিগুলির মধ্যে কোনওটিতে দেখা যাচ্ছে রাস্তায় আগুন জ্বলছে, কোনও ছবিতে আবার দেখা যাচ্ছে বিক্ষোভ চলছে। বিজেপির পোস্টে ঘটনাগুলি বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের সময়ের বলে দাবি করা হয়েছিল। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই নড়েচড়ে বসে রাজ্য পুলিশ। তাদের তরফে জানানো হয়, বিজেপির ওই পোস্টটি ‘ফেক’ (ভুয়ো)। ঘটনাগুলির বেশির ভাগ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বিরোধী আন্দোলনের সময়ের বলে দাবি পুলিশের এবং প্রায় সবই ভিন্রাজ্যের।
ইউসুফের ‘পোস্ট-বিতর্ক’
অশান্ত মুর্শিদাবাদ। তবে সেই খবর কি রাখেন বহরমপুরের তৃণমূল সাংসদ ইউসুফ পঠান? সেই প্রশ্নই ঘুরছে সমাজমাধ্যমে। বিতর্কের সূত্রপাত ইউসুফের পোস্ট করা একটি ছবিকে কেন্দ্র করে। গাছগাছালিতে ঢাকা শান্ত পরিবেশ। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে মনোরম বিকেলটিকে উপভোগ করছেন। চায়ের কাপে চুমুকও দিচ্ছেন। নিজের এমন একটি ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করতেই বিতর্কের আগুন দাবানলের মতো ছ়ড়িয়ে পড়ে। মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতিতে সাংসদের ‘আরামের বিকেল’-কে ভাল চোখে দেখেননি অনেকেই। নানাবিধ প্রশ্নবাণে তাঁকে বিদ্ধ করেছেন।
- সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আবহে গত শুক্রবার অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর, সুতি, শমসেরগঞ্জ-সহ কিছু অঞ্চলে।
- মুর্শিদাবাদের অশান্তির ঘটনার তদন্তে বুধবার ২০ সদস্যের সিট গঠন করে রাজ্য পুলিশ।
-
পর্যাপ্ত পুলিশ থাকলে নিয়ন্ত্রণে আনা যেত মুর্শিদাবাদের অশান্তি, নিয়ম মেনে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে রাজ্য? প্রশ্ন হাই কোর্টের
-
মুর্শিদাবাদের জোড়া খুনে সিবিআই তদন্তের আর্জি শুনল না ডিভিশন বেঞ্চও! ফেরত গেল সিঙ্গল বেঞ্চে
-
মানবাধিকার কমিশনের সামনে নয়, মুর্শিদাবাদের অশান্তির প্রতিবাদে ধর্নার জায়গা বদল করল হাই কোর্ট
-
মুর্শিদাবাদের জোড়া খুনে সিবিআই তদন্তের আবেদন শুনল না সিঙ্গল বেঞ্চ! পাঠানো হল প্রধান বিচারপতির কাছে
-
‘অ্যাক্টিং প্রাইম মিনিস্টার’কে বলব, অশান্তি না-বাধিয়ে সীমান্তে নজর দিন, মমতার নিশানা কি শাহের দিকে?