অগ্রন্থিত প্রবন্ধসংগ্রহ
পূর্ণেন্দু পত্রী
৩০০.০০
বাণীশিল্প
স্বল্পায়তন, ১৯০ পৃষ্ঠার এই বইতে ‘প্রথম সম্বর্ধনা, প্রথম মানপত্র’ নিবন্ধটি বেশ চমকপ্রদ। পথের পাঁচালী মুক্তির পর বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রী (ছবিতে) গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি। তরুণ লেখক, শিল্পীরা ঠিক করেছেন— কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে সত্যজিৎ রায়কে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। পরিচালক রাজি, কিন্তু মানপত্র কী হবে? কলেজ স্ট্রিটে পূর্ণেন্দু তখন যেখানে থাকতেন, সে বাড়িতেই ছিলেন এক জ্যোতিষী। হলদেটে কাগজে কোষ্ঠী-ঠিকুজি এঁকে, তার পর সেটিকে দিনকয়েক ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে পুরনো তুলট কাগজের চেহারা দেওয়া হত। তরুণ শিল্পী সে ভাবেই তৈরি করলেন কাগজ। মানপত্রের বয়ান তাঁরই লেখা। এ বার সরু তুলির ডগায় অক্ষরগুলির ফাঁকফোকরে টেনে দেওয়া হল উইয়ে কাটার মতো দাগ। এ যেন বহু যুগের ও-পার থেকে আসা শ্রদ্ধাঞ্জলি। নিবন্ধকার জানিয়েছেন যে কান, বার্লিন, ভেনিসে বিশ্ব জয়েরও আগে এই শহরের তরুণদের উদ্যোগে সেটিই সত্যজিৎকে প্রথম গণসংবর্ধনা। কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতিতে মা কী ছিলেন, কী হইয়াছেন তা নিয়ে দুঃখবিলাসে লাভ নেই।
এই বইযের চারটি প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায়ের দীর্ঘ ছায়ার উপস্থিতি। সত্যজিতের সৌজন্যেই যে আইজ়েনস্টাইনের দ্য ফিল্ম সেন্স বইটি প্রথম কলকাতার বাজারে আসে, জানিয়েছেন লেখক। আবার কখনও সত্যজিৎ পূর্ণেন্দুকে বলেন, ঘরে বাইরে-র শেষ দৃশ্য তিনি সাদা-কালোয় তুলবেন। প্রথমে হয়তো নিখিলেশের ঘরের আলমারি কালো হয়ে গেল। তার পর পিতলের ফুলদানি। ট্র্যাজেডির চূড়ান্ত মুহূর্তে এই ভাবে তিনি রং থেকে রংহীনতায় পৌঁছে যাবেন। আবার বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের উল্টো দিকে পথের পাঁচালী-র হোর্ডিংয়ে কেন থাকত জল রঙের বাস্তবতা, আর পরশ পাথর-এ সাদা-কালোর কিউবিজ়ম, বুঝিয়েছেন লেখক। পাঠকের আলস্য ও গতানুগতিক চিন্তাভাবনাকে ধাক্কা মেরে জানিয়েছেন, আম আঁটির ভেঁপু-র ঢের আগে সত্যজিৎ করে ফেলেছেন সিগনেট প্রকাশিত টুনটুনির বই, খাই খাই বা রাজ কাহিনী-র প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ। প্রতিটিই আলাদা রকম। মুগ্ধ অতিকথন এড়িয়ে কাজের কথাটা বলতেও ছাড়েননি; নিজে লেখক হওয়ার পর সত্যজিৎ তাঁর নিজের বইয়ের জন্য যে সব প্রচ্ছদ এঁকেছেন, সেগুলি ‘অভ্যস্ত দক্ষতার মামুলি ফসল মাত্র’। তর্কশীল গুরুদক্ষিণার সশ্রদ্ধ মালা গাঁথতে গাঁথতেই পূর্ণেন্দু জানিয়ে দেন, “বিদেশি সমালোচকরা অনেক সর্বনাশ করেছে আমাদের। সত্যজিৎকে না বুঝে আর বেশি বুঝিয়ে।”
সম্ভবত সত্যজিৎকে এ ভাবে আত্মস্থ করেছিলেন বলেই বামপন্থী পূর্ণেন্দুর শিল্পভাবনা অন্য রকম। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে নিজের তৈরি ছবি ছোট বকুলপুরের যাত্রী-র জন্মবৃত্তান্তে বলেছেন, শেষ দৃশ্যের আবহসঙ্গীত নিয়ে যখন তিনি ওই রকম চুলছেঁড়া ভাবনায় ব্যস্ত, তখনই অন্য আলো। কোনও জয়ধ্বনি নয়, বরং দিবাকর আর আন্নার গল্পটা জুড়ে দিতে হবে আরও পাঁচ জনের ত্রস্ত অভিজ্ঞতার সঙ্গে। পূর্ণেন্দু তৃতীয় পুরুষে লেখেন, “অগত্যা যুবকটি প্রায় মরিয়া আবেগেই বেছে নিল বেঠোফেনের নাইন্থ সিম্ফনিকে।”
‘বঙ্কিমচন্দ্রের আকবর’ প্রবন্ধটিও গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৭৫ সালে বঙ্গদর্শন-এ বঙ্কিম প্রবল ক্ষোভে লেখেন, “যে আকবর বাদশাহের আমরা শতমুখে প্রশংসা করিয়া থাকি, তিনিই বাঙ্গালার কাল।” টোডরমলের নীতিতে জমির রাজস্ব বেড়েছে, এবং বাড়তি টাকাটা বাংলার কাজে লাগছে না, সটান চলে যাচ্ছে দিল্লির রাজকোষে। হাল আমলের হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় এ বার উক্তিটা কেটেছেঁটে বঙ্কিমকে সুবিধেমাফিক বাঙালি বা হিন্দু, যে কোনও জাতীয়তাবাদের পুরোধা ভাবতে পারে। কিন্তু পূর্ণেন্দু পাশাপাশি জানান, এই প্রবন্ধের ঢের পরে রাজসিংহ, সীতারাম লেখা হয়েছিল। তা হলে? পূর্ণেন্দুর সিদ্ধান্ত, গোটাটাই প্রতিভার স্ববিরোধিতা। নিজের চিন্তাকে নানা ভাবে সম্প্রসারণ করতে চাইতেন বলেই বঙ্কিম সাম্য প্রবন্ধ লিখেও তা ছাপার পর প্রত্যাহার করেন। কৃষ্ণচরিত্র-এর প্রথম ভাগে যা লিখেছিলেন, গ্রন্থাকারে তা আমূল পরিবর্তিত। স্বভাবসিদ্ধ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বঙ্কিম সেই বইয়ের ভূমিকায় লেখেন, “জীবনে আমি অনেক বিষয়ে মত পরিবর্তন করিয়াছি... কে না করে?” বাঁধা গতের বাইরে, স্ববিরোধী পদচারণাতেই প্রতিভার সিদ্ধি।
পূর্ণেন্দু অগ্রন্থিত প্রবন্ধসংগ্রহ-এ সত্যজিৎ থেকে বঙ্কিম হয়ে তলস্তয়কে ছুঁয়ে আমাদের কখনও নিয়ে যান স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এভন’এ শেক্সপিয়রের বাড়িতে, কখনও দাঁড় করিয়ে দেন লুভ্র মিউজ়িয়ামে রোদাঁ-র গ্যালারির সামনে। আজও প্যাশনের সংরাগে, আকুতিতে জীবন্ত বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য— “তোকে আমরা কী দিইনি শক্তি? ঝমঝমাঝম মাদল হয়ে বাজবি বলে তোকে দিয়েছি চাইবাসার প্রত্যেকটা ফ্লুরোসেন্ট রাত।... শুধু তোর জন্যই জিরোতে দিইনি হাওড়া স্টেশনে দূরপাল্লার কোনও ট্রেনকে।” বাংলা ভাষায় অনন্য এই শ্রদ্ধার্ঘ্যের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয় শক্তিরই লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি এলেজি— “অনন্ত নক্ষত্র আজ খেলা করে আকাশের বুকে/ আমি যেন টের পাই/ আমি যেন দেখে যেতে পারি/ তোমাদের কঠিন অসুখে/ তোমরা ঔষধপত্র পেয়েছিলে কি না ঠিকঠাক।”
আমাদের পূর্বসূরিরা যাবতীয় তর্কশীলতা নিয়েও বিষয়ের প্রতি কী রকম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, বৃহৎ বাঙালি কী ভাবে এক নিশ্বাসে রোদাঁ থেকে রিলকে হয়ে লোকশিল্পকে নিয়ে আসত আতপ্ত সংরাগে, এ বই তারই প্রমাণ। কে না জানে, ভাল বইয়ের গুরুত্ব তার আয়তনে নয়, বিষয়ের প্রকাশে ও বিষয়ীর মগ্নচৈতন্যে।
গৌতম চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy