মহারথী: মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায়।
আর্ট সিনেমা অ্যান্ড ইন্ডিয়াজ় ফরগটেন ফিউচার্স: ফিল্ম অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন দ্য পোস্টকলোনি
রোচনা মজুমদার
৬৯৯.০০
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস
ভারতীয় ছবি নিয়ে অ্যাকাডেমিক প্রকাশনায় বেশ কিছু দিন বলিউড নামক এক বিষয় প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল। ক্রমশ ছবিটা বদলে যাচ্ছে মনে হয়। এর একটা কারণ, যাকে বলিউড বলা হচ্ছিল, তার নিজের পরিবর্তন; এবং অন্য দিকে মরাঠি, মালয়ালম, কন্নড় ইত্যাদি ভাষায় নতুন চলচ্চিত্রের উত্থান। গত কয়েক বছরে আঞ্চলিক ভাষার ছবি নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। এর পাশাপাশি এ দেশের আর্ট ফিল্মের কথা আলোচনায় ফিরে আসছে। নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতীয় ছবির অ্যাকাডেমিক চর্চায় প্রায় সবাই ব্যস্ত ছিলেন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নিয়ে। আর্ট ফিল্ম বা ফিল্মের শিল্পরূপ নিয়ে এঁরা শুধু যে ভাবা বন্ধ করে দিলেন তা-ই নয়, তেমন ভাবনাকে ‘এলিটিস্ট’ বলে দাগিয়ে দিলেন। এ সবের প্রতিক্রিয়াতেই কিছুটা যেন আমাদের আর্ট ফিল্মের পুনর্মূল্যায়নে উৎসাহী হয়েছেন গবেষকেরা। রোচনা মজুমদারের বই বা সুধা তিওয়ারির (অপ্রকাশিত) গবেষণা ভারতীয় ‘নিউ সিনেমা’ বা ‘নিউ ওয়েভ’-এর প্রাতিষ্ঠানিক পটভূমি, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, পাবলিক বিতর্কের নানা জরুরি খুঁটিনাটি নতুন করে তুলে এনে ঐতিহাসিক মূল্যায়নের পথ তৈরি করে দিয়েছে।
রোচনার আলোচনার পরিধি আরও বিস্তৃত। তিনি ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫১-র ফিল্ম এনকোয়্যারি কমিটির রিপোর্ট, তার ঠিক পরে-পরে স্বাধীন সরকারের নানা উদ্যোগ, ফিল্ম ফিনান্স কমিটির কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস তৈরি করেছেন। মৃণাল সেনের ভুবন সোম (১৯৬৯) থেকে যে নিউ ওয়েভের সূচনা বলে ধরা হয়, মূলত তার অনুষঙ্গেই আমাদের লেখালিখিতে আর্ট ফিল্ম কথাটার প্রচলন। রোচনা সময়টাকে আরও ছড়িয়ে পথের পাঁচালী থেকে শুরু করে সত্তর দশক অবধি আলোচনা বিস্তৃত করেছেন। বিশদ আলোচনার জন্যে বেছে নিয়েছেন সত্যজিৎ, ঋত্বিক ও মৃণালের তিনটি ট্রিলজি। বহু দিন ধরে এই চলচ্চিত্র-পর্ব নিয়ে নানা কথা বলা হয়েছে। তার সবটা ছাপা নেই, বা ছাপা হলেও ইংরেজিতে লভ্য নয়। এই বইতে সেই সব
কথা যেমন অনেকটা ধরা আছে, তেমনই নতুন তথ্য, নিজস্ব পাঠ ও বিশ্লেষণ রয়েছে। লেখক ইতিহাসবোধ আর ঐতিহাসিকতার প্রশ্ন সামনে রেখেছেন, যেটা আর্ট ফিল্মের আলোচনায় তেমন করে পাওয়া যায় না। ওঁর মতে, আমাদের আর্ট ফিল্ম বর্তমানের ইতিহাস রচনা করেছে। অন্য দিকে, ফিল্ম সোসাইটি ইত্যাদির চর্চা নাগরিক রুচি গঠনের কাজে শিক্ষামূলক ভূমিকা নিয়েছে। এই দুই ক্ষেত্রেই লেখক উত্তর-ঔপনিবেশিকতাকে বিশ্লেষণের মূল কাঠামো হিসাবে রেখেছেন।
প্রথম তিনটি অধ্যায়ে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক-পেডাগজিক প্রেক্ষাপট। এর কিছুটা আগে নানা জার্নালে প্রকাশিত, এখানে তাকে আরও সংহত রূপ দিয়েছেন লেখক। ভারতে চলচ্চিত্র সচেতনতা তৈরিতে মারি সিটন-এর মতো ব্যক্তির ভূমিকা, ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সাংস্কৃতিক রাজনীতি ইত্যাদি এই অধ্যায়গুলিতে বিবৃত। এর সঙ্গে ‘এপিলোগ’ নামক শেষ অধ্যায় মিলিয়ে পড়লে পাঠক আর্ট ফিল্ম প্রকল্পের এক জরুরি প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস পাবেন, যার সঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে দেশগঠনের ইতিহাস ওতপ্রোত। অর্থনৈতিক উদারীকরণের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা-উত্তর নানা উদ্যোগের মতো আর্ট ফিল্মের প্রকল্পও পিছু হটে যায়। এক সময়ে ওই চলচ্চিত্রে যে ভবিষ্যৎ-কল্পনা প্রোথিত ছিল, লেখকের মতে এর আগেই তা অপসৃত হয়।
ছবির আলোচনায় প্রথমে এসেছে ঋত্বিক ঘটকের দেশভাগ ট্রিলজি। যে ভাবে ঋত্বিক বর্তমানের মধ্যে ইতিহাসগত বা পৌরাণিক অতীতের সংবেদন নিয়ে এসেছেন, তাকে লেখক বিকল্প ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখছেন। মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার আর সুবর্ণরেখা-য় সময়, ওঁর মতে, ‘কুইয়ার টাইম’ হয়ে উঠেছে। কখনও সেটা হয়েছে সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে, কখনও সাহিত্য অবলম্বন করে। এই উপাদানগুলি সুপরিচিত। রোচনা এদের প্রয়োগে দেখছেন স্বাধীন দেশের উন্নয়ন আর ক্রমপ্রগতির গল্পে অন্য কাল-কল্পনার অবতারণা।
ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১ আর পদাতিক নিয়ে রচিত মৃণাল সেনের কলকাতা ট্রিলজিকে দেখা হয়েছে ছবিগুলি ঘিরে সমকালীন বিতর্কের প্রেক্ষিতে। রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের স্বরূপ নিয়ে ফিল্ম সোসাইটির প্রকাশনায় যে উত্তেজনা সে সময় তৈরি হয়েছিল, মৃণাল সেন ছিলেন তার কেন্দ্রে। রোচনা দেখিয়েছেন, মৃণালের ছবিতে ক্ষুধা এবং ক্ষোভ, এই দুই থিম কী ভাবে পুনরাবৃত্ত হয়েছে। যৌবন সেখানে এমন এক দশা যা বর্তমানের ফাঁসে আটকে আছে, ভবিষ্যতের দিকে কোনও পর্বান্তরের আশ্বাস নেই।
মৃণাল সেনের ছবিতে এই সঙ্কট যদি প্রধানত তরুণ চরিত্রের মধ্যে ধরা পড়ে, সত্যজিৎ রায়ের শহর ট্রিলজিতে (প্রতিদ্বন্দ্বী, জন অরণ্য, সীমাবদ্ধ) তা গোটা বাস্তবতাকেই গ্রাস করেছে। লেখকের মতে, সত্যজিতের প্রথম পর্বের ছবিতে ‘হিস্টরিসিস্ট’ এবং প্রগতিবাদী এক ইতিহাসচেতনা রয়েছে যা সত্তর দশকে এসে অপসৃত। পরিচালক ইতিহাস রচয়িতার ভূমিকা ছেড়ে এথনোগ্রাফারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নানা খণ্ড দৃশ্য-শব্দে শহরের যে ছবি তৈরি হয়, তা কোন সামাজিক অবয়ব নেবে সেটা অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তাকে ছবিগুলি স্বীকৃতি দিয়েছে। নতুন পুরনো কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক ফর্মুলাতেই আস্থা রাখতে না পেরে বিবর্তনের গল্প ছেড়ে, লেখকের মতে, সত্যজিৎ বর্তমানের ঘন-বিবরণ রচনা করেছেন।
ভারতীয় ছবির ইতিহাস পাঠকের জন্য প্রয়োজনীয় বই লিখেছেন রোচনা। নতুন তর্কের সূত্রপাত ঘটানোও ভাল বইয়ের একটা কাজ। একটা তর্ক হয়তো উঠবে, উত্তর-ঔপনিবেশিকতার যে সার্বিক প্রেক্ষাপট উনি ব্যবহার করেছেন, তা নিয়ে। স্বাধীনতার পরে আসছে বলেই সময়টাকে পোস্টকলোনিয়াল বলা হচ্ছে না। আর্ট ফিল্মের অনুশীলনে লেখক ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়ার যে দায় দেখছেন, তা উপনিবেশ পর্বের থেকে-যাওয়া চিহ্নের বা উত্তরাধিকারের দিকে নির্দেশ করে। কিন্তু শাসনতন্ত্রে, রাষ্ট্রনির্মাণে বা উন্নয়নের বয়ানে ঔপনিবেশিকতার দায় যে ভাবে বর্তেছে, সেই ভাবে সৃজনমূলক কাজে কেন বর্তাবে— এই প্রশ্নটা মনে আসে। সত্যজিৎ যখন বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্করের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছেন, ঋত্বিক রবীন্দ্রনাথ বা বিষ্ণু দে-র সঙ্গে সংলাপে রত হচ্ছেন, মৃণাল সেন চার দশকের ছোটগল্প অবলম্বন করে ক্ষুধা আর ক্ষোভের ধারাবাহিকতা তৈরি করছেন, ঠিক কী অর্থে এঁদের কাজে উত্তর-ঔপনিবেশিক দায় বর্তায়? যখন সরাসরি নিজেদের সময়ের দলিল তৈরি করেছেন, তখনও এঁদের চেতনায় ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার ছাপ অনেক সময় গৌণ বলেই মনে হয়। আরও একটা কথা মনে আসে। সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের ছবিতে যে প্রকৃতি বা নিসর্গ মাঝে মাঝে কাহিনির হাত ছাড়িয়ে সামনে চলে আসে, তা এক অঞ্চলের ঐশ্বর্যের কথা বলে। রোচনা একেই বোধ হয় ‘বিশ্ব’-এর বদলে ‘গ্রহ’-এর নিরিখে ভাবার কথা বলেছেন। এই ছবির দেশকে ‘পোস্টকলোনি’ বললে জিনিসটাকে কি ছোঁয়া যায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy