Advertisement
১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
book review

Book Review: কাশ্মীরে সমাধানসূত্র মিলবে কি?

কোনও বহুমাত্রিক গুরুতর সমস্যাকে বুঝতে হলে নানা দিক থেকে বিচার করা দরকার। লেখক সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন বিশেষ দক্ষতায়।

ব্যবধান: নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজর উপত্যকায়। শ্রীনগর, ২০০৮।

ব্যবধান: নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজর উপত্যকায়। শ্রীনগর, ২০০৮।

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২২ ০৮:৩৮
Share: Save:

কাশ্মীর অ্যাট দ্য ক্রসরোডস: ইনসাইড আ টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি কনফ্লিক্ট
সুমন্ত্র বসু
৬৯৯.০০

পিকাডর ইন্ডিয়া

দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে কাশ্মীর সমস্যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে শুধু সংঘাত তৈরি করেছে তা নয়, ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। স্বাভাবিক ভাবেই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যায় গ্রন্থ রচিত হয়েছে, এবং গবেষকরা রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইতিহাস ও সমাজবিদ্যার নানা আঙ্গিকে কাশ্মীর সমস্যার ব্যাখ্যা করেছেন। স্বভাবত প্রশ্ন জাগে যে, কাশ্মীরের উপর আর একটি বই থেকে আমরা নতুন কী পাব? সমাজবিজ্ঞানে অভিনবত্ব বা নতুনত্বের ধারণাটা জটিল। সেই বিতর্কে না গিয়েও এটুকু বলা সমীচীন হবে যে, চিরাচরিত বিষয়ে নতুন ব্যাখ্যা সম্ভব, নিত্যনৈমিত্তিক পটপরিবর্তনের নিরিখে পুরনো ব্যাখ্যার নবমূল্যায়ন দরকারি।

সুমন্ত্র বসু দীর্ঘ দিন ধরে কাশ্মীর চর্চা করে আসছেন। আলোচ্য বইটি তাঁর পুরনো সিদ্ধান্তসমূহকে আরও সমৃদ্ধ করেছে নতুন তথ্যের আধারে। হালে প্রকাশিত কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে লিখিত নানা গ্রন্থের মধ্যে সুমন্ত্রের বইটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী, সমালোচনাধর্মী, স্পষ্টভাষী ও নির্ধারক উপাখ্যান। নিবিড় গবেষণার ফলস্বরূপ লেখক কাশ্মীর সমস্যার নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভারত-পাক সম্পর্ক, দীর্ঘস্থায়ী অভ্যুত্থান, কাশ্মীরের সীমিত স্বায়ত্তশাসনের অবসান, পরিবর্তিত আঞ্চলিক তথা আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির চালচিত্র ও কাশ্মীর সঙ্কটের আবর্তে চিনের ভূমিকা।

কোনও বহুমাত্রিক গুরুতর সমস্যাকে বুঝতে হলে নানা দিক থেকে বিচার করা দরকার। লেখক সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন বিশেষ দক্ষতায়। গ্রন্থটির সারসংক্ষেপে আছে তিনটি প্রধান যুক্তি। প্রথমত, ভারত ও পাকিস্তানের নানাবিধ সমস্যায় নির্মিত ও বিশ্ব ভূ-রাজনীতির অকল্পনীয় জটিলতায় আবদ্ধ কাশ্মীর সমস্যার দ্রুত মীমাংসা ও শান্তি স্থাপন অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, ভারতের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উত্থান ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির মধ্যে কাশ্মীরকেন্দ্রিক বয়ান লক্ষণীয়। এর ফলে ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনীতি কাশ্মীর সমস্যাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে, যা পূর্বে গৃহীত নীতির থেকে একেবারে ভিন্ন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী, পাক গুপ্তচর, উগ্র জেহাদি গোষ্ঠী— এরাই কাশ্মীর রঙ্গমঞ্চের প্রধান কুশীলব; কাশ্মীরি জনসাধারণ এখানে ব্রাত্য। তৃতীয়ত, বহুমাত্রিক জটিলতা কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে সুপ্ত রাখবে না— কাশ্মীরের রাজনীতি নানা কলহে লিপ্ত, যা বিশ্ব-রাজনীতির সামনে এক অশনিসঙ্কেত বহন করছে। হয়তো এই বিবাদের তীব্রতা বৃদ্ধি এক আন্তর্জাতিক সঙ্কট তৈরি করবে ভবিষ্যতে। আর সেই বিরোধ থেকেই জন্ম নেবে শান্তির রাস্তা। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর তিন রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ কখনওই কাম্য নয়। তার থেকে অনেক জরুরি কূটনীতির মধ্যে দিয়ে এই সমস্যার হাল খোঁজা। দেশীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি এই কূটনীতির কাঠামো নির্মাণ করবে। ভারত, পাকিস্তান ও চিন— কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আশাব্যঞ্জক অবস্থায় নেই, গ্রন্থের মূল সূত্রের সঙ্গে এই নেতিবাচক সিদ্ধান্তই সঙ্গত। লেখকের নিজের বিবরণের মধ্যে শান্তির সম্ভাবনা বিশেষ নেই।

আমি চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব। প্রথমত, বইটির অনেকটা জুড়ে আছে আধুনিক কাশ্মীরের ইতিহাস, যার সঙ্গে পাঠকের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। সুমন্ত্র দেখিয়েছেন কী ভাবে পাকিস্তান ও ভারতের রাষ্ট্রতন্ত্র কাশ্মীরের রাজনীতি ও সামরিক অনুশাসনের বিভেদকে ক্রমাগত ঘোলাটে করেছে। পাকিস্তান চিনকে কাশ্মীর ভূখণ্ডের একাংশ প্রদান করাতে আইনি ও রাজনৈতিক জটিলতা আরও বেড়েছে। লেখক মনে করিয়েছেন কাশ্মীরের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের উদারমনস্কতার কথা। কিন্তু গত ৭৫ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বাতাবরণ বিঘ্নিত করেছে প্রতিনিয়ত। কাশ্মীরের রাজনীতিতে সোজা-সরল নৈতিক হিসাব চলে না। উপত্যকার মুসলিম নাগরিকরা যেমন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে যন্ত্রণা পেয়েছেন, তেমনই হিন্দু পণ্ডিত সম্প্রদায়ের মানুষ বিতাড়িত হয়েছেন জেহাদি উগ্রপন্থীদের রোষে। কাশ্মীরকে শান্ত করতে গেলে যে সাম্প্রদায়িক পুনর্মিলন প্রয়োজন, তার রাজনৈতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করার মতো উদারপন্থী সমাজ কোথায়? লেখক যদি এই সামাজিক পুঁজির অভাবের উপর আর একটু জোর দিতেন, জানা ইতিহাসের মধ্যে থেকে অজানা কথা বেরিয়ে আসত হয়তো।

দ্বিতীয়ত, সুমন্ত্র কাশ্মীর অভ্যুত্থানের একটি বিশদ ও সবিস্তার আলোচনা করেছেন, সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা আমরা জানি। লেখকের সিদ্ধান্তে, এ হল ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ ও কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাকামীদের রাষ্ট্রলোভী জাতীয়তাবাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের অবশ্যম্ভাবী ফল। কাশ্মীর অভ্যুত্থান এখানে জাতীয়তাবাদের সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি। কিন্তু উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজের রাজনৈতিক কল্পনা জাতীয়তাবাদকে অতিক্রম করেছে কি? আমি মূর্ত বা বাস্তব রাজনৈতিক রূপের কথা বলছি না— অনুমান বা কল্পনার স্তরেও বিকল্পের সন্ধান কোথায়? সারা দেশের প্রধান ধারার রাজনৈতিক শক্তির কাশ্মীর অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে যে মোটের উপর ঐকমত্য, তার অন্য কোনও ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।

কিন্তু এই বইয়ের সব থেকে আকর্ষণীয় অংশ নিঃসন্দেহে শেষ দু’টি পরিচ্ছেদ। তার ‘দ্য হিন্দু ন্যাশনালিস্ট অফেন্সিভ’ শীর্ষক অধ্যায়টি নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাশ্মীর নীতি ও সামগ্রিক রাজনৈতিক অভিমুখের কঠোর সমালোচনা। ২০১৯ সালের অগস্টে বিজেপি সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক অধিকারটি প্রত্যাহার করে। এর ফলে কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ লোপ পায়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল প্রবর্তনের মধ্যে দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরকে তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভেঙে ফেলে— যথাক্রমে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ। নিমেষে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ রূপান্তরিত হয় কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রদেশে। সুমন্ত্র আলোচনা করেছেন এই অধিকার হারানোর ব্যাপ্তি, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নেমে আসা সঙ্কট, রাজনৈতিক সমালোচনার কারাবাস ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠরোধ। কেন এই দিক পরিবর্তন? সরকার ও বিজেপি দলের ধারাভাষ্যে এর লক্ষ্য, কাশ্মীর ও ভারতের মধ্যে সমদর্শিতা। সুমন্ত্রের পাল্টা যুক্তি, মুসলিম-অধ্যুষিত প্রদেশের স্বাধিকার হিন্দু জাতীয়তাবাদী একমাত্রিক রাষ্ট্র পরিকল্পের পরিপন্থী।

পরিশেষে, সুমন্ত্র কাশ্মীরকে নিয়ে এসেছেন আজকের ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে। লেখক যথার্থ ভাবে দেখিয়েছেন, কেন কাশ্মীর সঙ্কটের নানাবিধ জটিলতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত। চিনের উত্থান তার আগ্রাসী মনোভাবকে বর্ধিত করেছে। গালওয়ান হোক বা ডোকলাম, ভারত ও চিনের সীমান্ত সংঘর্ষ আজ খবরের শিরোনামে। চিনের ‘ওবর’ নীতি পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভূখণ্ডকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ভূ-রাজনীতির স্বার্থে, ভারত, পাকিস্তান, চিন ও আমেরিকা কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্য নির্মাণ করতে চলেছে। সেই ভারসাম্যের চরিত্র কী হবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে। নেহরুর ভূত ছাড়ালেও, কাশ্মীর যে এশিয়ার আন্তর্জাতিক রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা অস্বীকার করি কী ভাবে? এই যুক্তিতে সুমন্ত্রর প্রদর্শিত সমাধানসূত্রটি দুর্বল। আয়ার্ল্যান্ড ও কাশ্মীরের তুলনা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে, কিন্তু কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারে ভিন্ন মাত্রার। আপসহীন জাতীয়তাবাদী সত্তা সরিয়ে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে এলওসি-কে নমনীয় সীমান্তে পরিণত করে পোক্ত শান্তি সম্ভব কি না, এই প্রশ্নের আগে কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক অনন্যতাকে অনুধাবন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সুমন্ত্র তাঁর রাজনৈতিক বোধকে অতিমাত্রায় প্রাধান্য না দিলেই ভাল করতেন। কিন্তু এটা কোনও বড় সমালোচনা নয়। লেখক একটি নির্ভীক উপাখ্যান উপহার দিয়েছেন, যার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy