Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
book review

আয়ের অভাব, উপায়েরও অভাব

কারারুদ্ধ অবস্থায় স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারকে দু’-চার কথা শুনিয়ে দিয়েছেন, এমন লোক কম নেই।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২১ ০৯:৪১
Share: Save:

লিভিং ওয়ার্ল্ড অব দি আদিবাসিজ় অব ওয়েস্ট বেঙ্গল— অ্যান এথনোগ্রাফিক এক্সপ্লোরেশন
কুমার রাণা, মানবেশ সরকার, শুভ্রা দাস, মুখলেসুর রহমান গায়েন
প্রতীচী ইনস্টিটিউট, এশিয়াটিক সোসাইটি

কারারুদ্ধ অবস্থায় স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারকে দু’-চার কথা শুনিয়ে দিয়েছেন, এমন লোক কম নেই। কিন্তু ‘দেশদ্রোহী’ পাদরি আদিবাসীদের জমি-জঙ্গলের অধিকার, সুবিচার পাওয়ার দাবিতে যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলো তেমন শোনা গেল না। হয়তো পশ্চিমবঙ্গের মতো বিরোধী রাজ্যেও সে কথাগুলো নিরাপদ নয় বলে। যেমন, এক দশকে (২০০৭-২০১৭) অরণ্যভূমির স্বত্বের জন্য ১ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি আবেদন জমা করেছেন বাংলার আদিবাসীরা। পেয়েছেন ৪৪ হাজার, বলছে এই রিপোর্ট। স্বত্বহীন আদিবাসীদের জঙ্গল থেকে বার করে দেওয়ার যে নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট এক বার দিয়েছিল, তা কখনও রূপায়িত হলে বাংলারই কয়েক লক্ষ আদিবাসী গৃহহীন, জীবিকাহীন হবেন। আর রাজনৈতিক বন্দিদের কথা? গত দশ বছরে সাতজনের জেলেই মৃত্যু হয়েছে, তাদের তিনজন আদিবাসী।

বরং ‘কৃষিকর্মন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের দিকে দেখা যাক। প্রতীচীর গবেষকরা পেশা নিয়ে প্রশ্ন করলে অধিকাংশ সাঁওতাল বলেছেন, “আমরা চাষি।” আসলে তাঁরা অধিকাংশই খেতমজুর। জনগণনা (২০১১) দেখিয়েছে, জমির মালিকানা রয়েছে বাংলার মাত্র ১২ শতাংশ আদিবাসীর (ভারতে ৩৫ শতাংশ)। উন্নয়নের পরিবর্তে ঘটেছে অবনমন— পঞ্চাশের দশকে ২৮ শতাংশ আদিবাসী নিজের জমি চাষ করতেন। আজ তাঁদের অনেকের সন্তান ভূমিহীন। যাঁরা জমির মালিক, তাঁদেরও জমির পরিমাণ এত ছোট (গড়ে তিন বিঘারও কম), জমির মান এমন মন্দ (৩২ শতাংশের জমিতে সেচ রয়েছে) এবং আর্থিক সঙ্গতি এত কম (মাত্র চার শতাংশ আদিবাসী চাষি অন্যের জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করতে পারেন) যে, চাষের ফসল পেট চালাতেই চলে যায়— মাত্র ১১ শতাংশ আদিবাসী পরিবার নিজেদের খাবারের প্রয়োজন মিটিয়ে ধান বিক্রি করতে পারেন।

আদিবাসী ভোটের নকশা খুঁজে বঞ্চনার হদিস মেলা কঠিন। ইশারা মেলে সাঁওতালি গানে— “নদীর ধারে পাকল ফসল, কিকিরোর দাড়ি গজাল, কোকোরোর দাড়ি গজাল, তারাই খেল সবটুকু ফসল।” কিকিরো, কোকোরো কল্পিত দুই পাখি, ইঙ্গিত আড়তদার ও ব্যবসায়ীর দিকে। দারিদ্র শুধু আয়ের অভাব নয়, উপায়ের অভাব। যে দাম দেবে না, তার কাছেই ফসল বিক্রি করতে হয়। যে রেশন দোকানমালিক কম মাল দেয়, তার দোকানেই গিয়ে দাঁড়াতে হয়। যে শিক্ষক বিদ্রুপ করে, তার কাছেই পাঠাতে হয় সন্তানকে।

রিপোর্টের দুটো স্তর। প্রথম স্তরে আছে সমীক্ষা করে পাওয়া পরিসংখ্যান, যা দিয়ে সমাজের মানচিত্র তৈরি করা যায়, যার তিন অক্ষ: স্থান, কাল, পাত্র। যেমন এই ছবিটা— স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীরা শিক্ষায় এগিয়ে ছিলেন ভারতের গড় হারের চাইতে, আশির দশকে সমান হল, তার পর পিছিয়ে পড়লেন। পুরুষদের চাইতেও বেশি পিছিয়ে মেয়েরা। এ রাজ্যে ষাটের দশকে আদিবাসীদের সাক্ষরতায় ‘জেন্ডার গ্যাপ’ যা ছিল (৯ শতাংশ), এখন তার চাইতে বেশি (২০ শতাংশ)। উন্নয়নের সাপ-লুডো খেলায় মেয়েরা দু’বার পড়েন সাপের মুখে— এক বার বর্ণব্যবস্থার, আর এক বার পুরুষতন্ত্রের। তাই এগোতে গিয়ে পিছিয়ে যান।

সিঁড়িও কি নেই? আছে বইকি, কিন্তু বড্ড ছোট, বলছে রিপোর্ট। অন্যান্য ছেলেমেয়ে যত উঁচু ক্লাসে ওঠে, তত বেশি টিউশন নেয়। আদিবাসীদের উল্টো— প্রাক্-প্রাথমিকে যত পড়ুয়া ‘প্রাইভেট মাস্টার’-এর কাছে পড়ে (৪৭ শতাংশ), উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পড়ে তার কম (১০ শতাংশ)। এ শুধু বাপ-মায়ের সাধ্যের অভাব নয়, প্রান্তিক এলাকায় শিক্ষকের অভাব। লোধাশুলি, আকড়বাইদে জন্ম বলে আরও পিছু হটতে হয় লোধা বা শবর কন্যাদের। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত আসনে পৌঁছয় ক’জন, যেখানে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তফসিলি জনজাতির মাত্র আট শতাংশ পৌঁছতে পারছে? ২০১৮ সালেও?

দ্বিতীয় স্তরে প্রতীচীর রিপোর্টটি সংখ্যাকে অতিক্রম করে প্রবেশ করে আদিবাসীর অনুভূত বিশ্বে। সেখানে আমরা শিক্ষায় ‘ব্যর্থতা’ বুঝতে গিয়ে পাই এক আদিবাসী কিশোরীকে, যাকে গয়লার দুধে জলের অনুপাত বার করতে দিলে সে হেসে কুটিপাটি হয়। দুধ তো দুধ, জল তো জল, দুধে আবার কোন বোকা জল মেশায়? কিংবা, ‘দু’বেলা যথেষ্ট খেতে পান?’ বললে যে আদিবাসীরা অক্লেশে বলেছেন ‘হ্যাঁ’, তাঁদের সঙ্গে আর একটু গল্প করে দেখা গিয়েছে, সেই খাদ্য কেবল ভাত। ডাল কদাচিৎ, আনাজ বা ফল যা নিজেরা ঘরের কাছ থেকে তুলে আনা যায়, দুধ-দইয়ের প্রশ্নই নেই।

পরিসংখ্যানকে ঘিরে এমন ছোট ছোট সংলাপ, খেদোক্তি, রসিকতা, বিলাপ, উন্নয়নের খতিয়ানকে অর্থপূর্ণ করেছে। স্রেফ সূচকে ছকে ফেলার ঝুঁকি এই যে, মানুষগুলো হয়ে যায় এক-একটা ‘অবস্থান’। তখন ‘নীচে’ থাকাটাই কিছু লোকের পরিচয় বলে মনে হতে থাকে। শিক্ষা কম, অপুষ্টি বেশি, রোজগার সামান্য— ওরা মিড ডে মিল পায় না? রেশন নেয় না? একশো দিনের কাজ করে না? তার মানে রাতদিন মহুয়া খেয়ে পড়ে থাকে। এই অলস, মদ্যপ, সতত-নৃত্যরত আদিবাসীর ‘স্টিরিয়োটাইপ’ হল সত্যকে আড়াল করার আচ্ছাদন। কেন দেব, ওরা তো চায় না! ওরা অমনই।

এর বিপরীতে আমরা পাই কুনি মাহলিকে। মহুয়া কুড়োনোয় মজা বেশি, তাই যখন মহুয়া ঝরে, তখন জোর করে না পাঠালে ছোটরা ইস্কুলে যেতে চায় না। তাই ফুল কুড়োনোর সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের তাড়া দিয়ে স্কুলে পাঠাতে হয় কুনিকে। পড়াশোনা শিখে ছেলেমেয়ে ধনী হবে, এমন স্বপ্ন কুনি দেখেন না। “একটু লেখাপড়া শিখলে এতটা লজ্জার জীবন হবে না ওদের”, গবেষকদের বলেছেন কুনি। বহু আদিবাসী পরিবার এখনও সাবানের বদলে ছাই বা বালি দিয়ে কাজ সারে; কিংবা সাত ঘণ্টার পরিশ্রমে সাত হাজার শালপাতা দিয়ে তৈরি-করা থালার গোছার দাম ৮৬ টাকা— এ কি শুধু আদিবাসীদের লজ্জা? আদিবাসীদের গড়ে ছ’হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে আবাস যোজনার বাড়ির জন্য, উপযুক্ত কার্ড থাকলেও রেশনে চিনি পান না ৬৫ শতাংশ, এর মানে কী? প্রাক্‌-কথনে অমর্ত্য সেন মনে করিয়েছেন, আদিবাসীদের দুর্দশা শুধু তাঁদের টাকার অভাব বা বৃহত্তর সমাজের পক্ষপাতিত্বের কারণে নয়, পরিষেবা বণ্টনে আদিবাসীর প্রতি সরকারের অবহেলাও তার কারণ।

হিংসার নিকৃষ্টতম রূপ হল দারিদ্র, বলেছিলেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। সম্পদবঞ্চনা আর বিচারবঞ্চনা, একই অন্যায়ের দুই পিঠ। ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীর জমি হয়ে যাচ্ছে খনি, সুন্দরবনে হচ্ছে ভেড়ি। চোখের জল শুকোলে কেউ যদি স্ট্যান স্বামীর অসমাপ্ত কাজের দিকে তাকাতে চান, এই রিপোর্ট কাজে লাগতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Adivasis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy