Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
book review

জরুরি কথা, ছবির ভাষায়

পড়তে পড়তেই চার পাশের মেয়েদের নিয়ে লিখতে শুরু করে সে। এবং ক্রমে একা, কেবল একার জোরে হয়ে ওঠে নেপালের নারীকাহিনির এক জন গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র।

গ্রহণশীল: সমকামিতার প্রশ্নটি নারীবাদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ

গ্রহণশীল: সমকামিতার প্রশ্নটি নারীবাদের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:৫১
Share: Save:

নারীবাদের নানা ওয়েভ বা ঢেউ এখন তো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসের পড়াশোনার বিষয় হয়ে গেছে। এ দিকে, ইন্টারনেটে খোঁজ করলে জানা যায় ফোর্থ ওয়েভ অব ফেমিনিজ়ম বা চতুর্থ ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সময় গুনছি আমরা, কবে আসবে পাঁচ নম্বর ঢেউ। অনুমান চলছে, কী কী কথা জোর দিয়ে বলা হবে সেই আন্দোলনে, তা নিয়ে। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, নারীবাদ এখন একটি ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলন। যাঁরা এর মধ্যে অত্যধিক র‌্যাডিকালিজ়ম দেখতেন, এবং মনে করতেন ও-সবে বেশি মনোযোগ দেওয়ার দরকার নেই ছাত্রছাত্রীদের, তাঁরা হয়তো ভয়ানক হতাশ হবেন এ কথা শুনে। কিন্তু অধিকারপন্থী আন্দোলনগুলি যেমন নিজেরাই নিজেদের জন্য পাকা জায়গা করে নিয়েছে, নারীবাদ তাদের মধ্যেই পড়ে। এখন শত আপত্তি করলেও ইতিহাস থেকে তাদের উৎখাত করা কঠিন। বরং আজকের তরুণ এবং তরুণতর প্রজন্ম কী ভাবে সহজে বিষয়টি বুঝতে পারে— সমর্থন করুক আর না করুক— সেটাই ভাল করে ভাবার দরকার এখন।

এই লক্ষ্যটি সামনে রেখেই তৈরি হয়েছে এই বই, যার সমতুল্য কিছু আমাদের চেনাশোনা বইমহলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এ হল ‘গ্রাফিক বই’, নারীবাদী জীবন নিয়ে।

কাকে বলে নারীবাদী জীবন? যে মেয়েরা নিজেদের অধিকারের জোরে নিজেরা উঠে দাঁড়ায়, তাদের জীবন। নারীবাদ শেষ অবধি কোনও শুকনো তত্ত্ব নয়— নিজের প্রত্যয়ে নিজে বাঁচার অধিকার। এ বইয়ের গোড়ার কথাটাই হল, আন্দোলন, আইন পাশ— এগুলো কেন দরকার সেটা বোঝা এবং বোঝানোটা হল প্রাথমিক কর্তব্য। না হলে কোনও দিন আইন পাশ কিংবা সমাজ পরিবর্তনের জন্য অনেক মানুষ এক জায়গায় হতে পারে না। আর তা না হলে কাজগুলো হয়ও না। অ্যাক্টিভিজ়মের গোড়ার কথা আত্মবিশ্বাস। অন্যদের কাহিনি শুনতে শুনতে জানতে জানতে, তবেই তৈরি হতে পারে সেই আত্মবিশ্বাসের রাস্তা।

মুভমেন্টস অ্যান্ড মোমেন্টস: ইন্ডিজেনাস ফেমিনিজ়মস ইন দ্য গ্লোবাল সাউথ

সম্পা: সনিয়া এসমান, মায়া, ইঙ্গো শোনিং

১২০০.০০

জ়ুবান

এই বই অবশ্য সব দেশের মেয়েদের কথা বলে না— বলে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর কথা। অর্থাৎ এশিয়া-আমেরিকা-আফ্রিকা এই সব মহাদেশের দক্ষিণাংশ জুড়ে যে সব অনুন্নত দেশ, তাদের মেয়েদের কথা। বড় আর ভারী বই পড়তে যারা তত উৎসাহ বোধ করে না, কিন্তু নারীবাদ বিষয়টাকে বুঝতে চায়, তাদের কথা ভেবেই এই ‘গ্রাফিক গল্পের বই’।

তার মানে? নারীবাদের গল্পের বই? হ্যাঁ, ইতিহাস নয়, রাজনীতি নয়, এ হল এক-একটি দেশের এক-একটি মেয়ের জীবনের উপর ভর করা ছোট ছোট গল্পের সমাহার। হাতে আঁকা ছবির সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে সে সব গল্প। ছবিই বেশি, কথা কম। অল্প কথার মধ্যে দিয়েই গল্প এগোয়। মাঝেমধ্যে থাকে নেপথ্য তথ্য আর ইতিহাসের জন্যে আলাদা আলাদা ‘বক্স’। কথার চেয়ে ছবি বেশি। তাই ‘জানা’র আগেই ‘বোঝা’ হয়ে যায় নারী-অধিকার বিষয়টির অতীত, বর্তমান, এমনকি ভবিষ্যৎ।

কী করে তৈরি হল এ বই, সে গল্পও দারুণ। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার গ্যোটে ইনস্টিটিউট একটি কনফারেন্স আয়োজন করে, যাতে জড়ো হন নানা দেশের নারীবাদ-উৎসাহী সাংবাদিক, এনজিও কর্মী, চিত্রশিল্পী। এত সফল হয় সে সভা যে, তার পর বার্লিনে এর পরবর্তী মিটিং হয়, এবং স্থির হয় একটি বই তৈরি করতে হবে পরপ্রজন্মের জন্য, যাতে এক-এক সেকশনে থাকবে এক-এক দেশের মেয়েদের কথা: বলিভিয়া, ইকুয়েডর, পেরু, ব্রাজিল, তাইল্যান্ড, ফিলিপাইন্স, ভিয়েতনাম, নেপাল, এবং অবশ্যই ভারত!

এই যেমন শান্তি নামে নেপালের মেয়েটির কথা। ছোট থেকেই পড়ায় আগ্রহ, কিন্তু বাবা রাগ করে, মেয়েদের অত পড়া কিসের। বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটির, বাবার জোরাজুরিতে। স্বামী ওর পড়ার সাধ শুনে রেগে ওঠে, মন দিয়ে সংসার করতে বলে। মা হয় মেয়েটি। কিন্তু কখন যেন এ সবের ফাঁকে ফাঁকে লিখতে শুরু করেছিল সে। এক দিন তিষ্ঠোতে না পেরে বরের বাড়ি থেকে চলে যায় সন্তানকে নিয়ে। আইন পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তেই চার পাশের মেয়েদের নিয়ে লিখতে শুরু করে সে। এবং ক্রমে একা, কেবল একার জোরে হয়ে ওঠে নেপালের নারীকাহিনির এক জন গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র।

কিংবা ধরা যাক, চিলির মেয়ে মিলারে-র কথা। শহরের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে দেশগাঁয়ে গিয়ে সে ‘মাচি’ অর্থাৎ নদীর রক্ষাকর্ত্রী হয়ে যায়। বিদেশি কর্পোরেশন এবং দেশের ধনী ব্যক্তিদের পাল্লায় পড়ে যখন তাদের দেশমাটিনদীজঙ্গল উজাড় হয়ে উন্নয়ন হওয়ার জোগাড়, তখন কমিউনিটি থেকে এক-এক জনকে তুলে প্রশিক্ষিত মাচি করে তোলা হয়। তারা গিয়েনদীর ধারের জঙ্গলভূমি রক্ষা করার দায়িত্ব নেয়। পুলিশ তাদের ধাওয়া করে, তারা পালায়, কিন্তু এক ইঞ্চি পিছু হটে না। মাচি মিলারে এ ভাবেই পুলিশের হাত এড়িয়ে বড় হয়ে যায়, আর বড় হয় বিখ্যাত এক পরিবেশকর্মী হিসেবে। সাধারণ ঘরের সেই ছোট্ট মেয়ে আজ পরিবেশ আন্দোলনের পুরোধা নারী। এও আর এক অধিকারের লড়াই।

নারীবাদের নতুন ঢেউয়ের মূল কথাই হল: অন্যান্য অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে তবেই নারীবাদ আরও বেশি অর্থময়। বইটি এ ভাবে অনেকটা শিখিয়ে দেয়, এগিয়ে দেয় আমাদের। আক্ষেপের কথা, এমন একটা ভাল বইয়ের কিছু কিছু অংশ বড্ডই দুর্বল থেকে গেছে, বিশেষ করে ভারতের কাহিনিটি। তবে, নারীবাদ যেমন বলে, ‘একটি’ দৃষ্টান্ত থেকেই ক্রমে ‘অনেক’ তৈরি হয়ে ওঠে— সে রকমই, এমন একটি বই হাতে নিয়ে ভবিষ্যৎ বইজগতের সম্ভাবনা বিষয়ে রীতিমতো উদ্দীপিত লাগে।

অন্য বিষয়গুলি:

book review LGBTQ Homosexuality
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy