Advertisement
২৭ জানুয়ারি ২০২৫
Book Review

‘কিন্তু মুখের পাথরছবি আছে’

তিন দশক আগে কবি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে খুব সযত্ন এক বিশেষ সংখ্যা তৈরি হয়ে উঠেছিল অনুষ্টুপ পত্রিকার উদ্যোগে। কবির ব্যক্তিত্বের একটা রেশ লেগেছিল সেখানে।

সুমন্ত মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:০৫
Share: Save:

শঙ্খ ঘোষ চলে গেছেন— তিনি যে ছিলেন, আমাদের সবার হয়ে, সব কিছুর মধ্যে ছিলেন, সেটাই যত দিন যাচ্ছে, অভাবনীয় বোধ হচ্ছে। গত তিন বছরে কত পত্রিকায় কত অজস্র লেখা আমরা পড়লাম! কিন্তু সব মিলিয়ে একটা আদল তো আজ পর্যন্ত গড়ে উঠল না! পরিচিত এই বইয়ের নতুন প্রকাশ তাই আমাদের খানিকটা হলেও উদ্‌গ্রীব করেছে। যদিও ‘শঙ্খ-ভাবনার অনুষ্টুপ সংকলন’, এই রকম অর্থহীন বাক্য কী ভাবে কোনও বইয়ের নাম হতে পারে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

তিন দশক আগে কবি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে খুব সযত্ন এক বিশেষ সংখ্যা তৈরি হয়ে উঠেছিল অনুষ্টুপ পত্রিকার উদ্যোগে। কবির ব্যক্তিত্বের একটা রেশ লেগেছিল সেখানে। বাষট্টি বছরের শঙ্খ ঘোষকে উৎসর্গ করে প্রথম বড় মাপের সেই বিশেষ সংখ্যায় কনিষ্ঠ লেখক ছিলেন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পার হওয়া অভীক মজুমদার। ক্লাস থেকে সবেমাত্র বেরিয়ে এসে লেখা মাস্টারমশাই শঙ্খর ক্লাস-বিবরণে তখনও ধোঁয়া উঠছে। আর জ্যেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ছিলেন বোধকরি অশোক মিত্র। তাঁর আশঙ্কা ছিল, শঙ্খ ঘোষ থাকা সত্ত্বেও বাংলা কবিতার গঙ্গাপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত। সব মিলিয়ে সে এক জলজ্যান্ত ছোট কাগজ।

শঙ্খ ঘোষের সমসাময়িক কবিরা— অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাঁদের স্বভাবসম্মত দু’টি নিবন্ধ। অশ্রুকুমার সিকদার, কুমার রায়, অমিয় দেব, শিশিরকুমার দাশ, শেফালী মৈত্র, বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের মতো আরও অনেকের লেখায় খানিকটা হলেও ধরা দিয়েছিল সদ্য ষাট বছর পেরোনো শঙ্খ ঘোষের নানা রঙের ছবি। সন্তোষ মুখোপাধ্যায় আর অনিল আচার্য ছোট পত্রিকার চরিত্রমতো বেশ কিছু তর্কেরও ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। যেমন কবি শৈলেশ্বর ঘোষের লেখায় এক-একটি বাক্যে নাকচ হয়ে গিয়েছিলেন পঞ্চাশের খ্যাতনামা কবিরা। অরুণেশ ঘোষের নেওয়া দুর্লভ সাক্ষাৎকারে আমরা দেখেছিলাম মৃদুভাষী শঙ্খর অস্ত্রচালনা— “সবাই জানেন, ধনতান্ত্রিক সমাজের নিশ্চিত এক নিয়ম হিসেবে সাহিত্য এখন পণ্য হয়ে গেছে। আর পণ্যের নিয়মে প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞাপন, লাভ এবং ক্ষতির বৃত্তের মধ্যেই ঘুরছে লেখার জগৎ। অনেকেই এর বাইরে দাঁড়াতে চান… তাহলেও ওই উজ্জ্বল বৃত্তের ঘূর্ণি দ্রুত আকর্ষণ করে সবাইকে, দ্রুত ছুঁতে চায় তারা সেই ফলটাকে। লোভ এবং মত্ততা চারিদিকে ছড়ানো আছে।”

শঙ্খ-ভাবনার অনুষ্টুপ সংকলন/ নিঃশব্দের শিখা শঙ্খ ঘোষ

সম্পা: সন্তোষ মুখোপাধ্যায়

৭০০.০০

অনুষ্টুপ

এমনই ‘ফল দ্রুত ছুঁতে চাওয়া’ কিছু মানুষের বিচার কবির মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সব বহুপঠিত লেখা থেকে আজকের দিনের সাধারণ পাঠক জেনেছেন— প্রতিটি পুরস্কার কমিটিতে শঙ্খ ঘোষের বন্ধুরা ছিলেন, প্রতিটি সিলেবাস কমিটিতে তাঁর প্রিয় ছাত্ররা আছেন। অথচ অরুণেশকে বলা গোটা সাক্ষাৎকারেই ছড়িয়ে ছিল এই রকম অনেক বাক্য: “পুরস্কারের সঙ্গে আমারও নাম যুক্ত হলো… প্রতিষ্ঠান আর প্রলোভনের হাতবাড়ানো নানা দিক থেকে এগিয়ে আসতে চায় তখন, প্রতি মুহূর্তে সতর্ক না থাকলে নিজের বিষয়ে কতগুলি মূর্খ ধারণা তৈরি হবার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়।” আর “গলিত এই সমাজটাই তো সেই প্রতিষ্ঠান। ভিতরে থেকেও বাইরে থাকতে পারি কতটা, লেখক বা শিল্পীর সব সময়ের পরীক্ষাই হচ্ছে সেইটে।”

এই সাক্ষাৎকারের প্রথম প্রকাশের সময়ই শঙ্খ ঘোষ স্বধর্মে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বিচার-বিবেচনার বেশ খানিকটা বাইরে চলে গিয়ে বহু মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছেন। আমরা যা হতে চাইছি, অথচ প্রতি দিনের কিমাকার জীবনযাপনে ধরতে পারছি না সহজ পথে, সেটাই ওঁর কাজে কথায় লেখায় বলায় আঘাতে আঘাতে মুখাবয়ব পেয়ে গেল সবার সামনে। হারিয়ে গেল সেই সব সাময়িকের আঁচড়, কিন্তু মুখের পাথরছবি আছে অমলিন।

এই মুখ ঠিক একার মিথ্যে লেগে থাকা মুখ নয়, অনেকের মুখের চলমান প্রবাহ। কী ভাবে হল এমন? বাইরে থেকে এক জন-দু’জনের আলগা মন্তব্যে তার হদিস মিলবে না। অনেকের নানামুখী অভিজ্ঞতাপুঞ্জ আর ক্রমাগত বিশ্লেষণ আজকের পাঠককে পৌঁছে দিতে পারে সম্পাদক যাকে ‘শঙ্খ ভাবনা’ বলছেন তার কাছাকাছি।

অনুষ্টুপ এ কাজটা একই সঙ্গে পেরেছে এবং পারেনি। ১৯৯৪ সালে বাষট্টি বছরের কবিকে নিয়ে প্রথম বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা করতে পেরেছে। সেই সুসম্পাদিত পত্রিকাকে গ্রন্থরূপ দিয়েছে। গত পঞ্চাশ বছরের বাংলায় সব দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক জন মানুষের অর্ধেক কর্মজীবনের একটা নানামুখী ইতিহাস তৈরি করতে পেরেছে। আর পারেনি বাকি ইতিহাসের খোঁজে যথার্থ উদ্যোগ করতে। সম্পাদনা কাজটা বাকি থেকে গেল, হয়ে উঠল মৃত্যু-পরবর্তী ‘অবিচুয়ারি’র সঙ্কলন।

এই বইটির তাই দুটো অংশ। একটি ত্রিশ বছর আগের লেখা পরিকল্পিত প্রবন্ধগুচ্ছ। অপর ভাগে ‘সম্পাদকের বিস্তার’। এই বিস্তারেও অবশ্য পাওয়া গেল শ্রাবন্তী ভৌমিকের ‘বাবা যখন ছোট’ কিংবা সোমেশ্বর ভৌমিকের ‘খালি চেয়ার’-এর মতো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। আত্মজনের দৃষ্টি কিংবা পারিবারিক স্মৃতি পাঠকের কাছে খুব দরকারি। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের লেখাটি পড়ে মনে হল, তিনি আটপৌরে ভাষায় কী অপূর্ব দু’টি সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন। অনিল আচার্যের লেখাটিও আমাদের জানায়, কত দূর সপ্রশংস সহিষ্ণুতায় অনুষ্টুপ-এর অগ্রগতির পথে ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দিতেন শঙ্খ ঘোষ। ভুল অবশ্য আছে এই বইটির সারা শরীরেই। মুদ্রিত জীবনপঞ্জিতে কবির চলে যাওয়ার তারিখটি দ্রুত ঠিক করা দরকার। তবে, এই লেখাগুলি পড়তে পারার জন্য অনুষ্টুপ-কে কৃতজ্ঞতা জানাতেই হবে। যদিও তাদের কাজ আরব্ধ হয়েই রইল।

কোথায় গুরুত্ব এই দুরূহ অথচ সকলের সমীপবর্তী কবির? এই প্রশ্নের একটা সদুত্তর দিয়েছেন দার্শনিক আগামবেন। তাঁর মনে হয়েছে, প্রকৃত রাজনৈতিক কাজের দায় ভাষার মধ্যেই তীব্র ভাবে ধরতে পারা সম্ভব। যদিও সে দায় সবার, তবু, না-থাকা মানুষের হয়ে কবিরাই তা টের পান। এ কাজের ভার কেউ চাপিয়ে দেয় না। আজকের দিনে আর কোনও রাজনীতির অস্তিত্ব বা সম্ভাবনা নেই। কারণ একমাত্র ভাষার কাব্যিক তীব্রতার মধ্যে দিয়েই গরহাজির মানুষ উপস্থিত হয়। আমাদের বাঁচায়। আমরা বুঝতে পারি, কী ভাবে কবি শঙ্খ ঘোষের কথায়ও কবিতায় ভাষা প্রতি দিনের তীব্রতাকে জড়িয়ে নিয়ে সবাইকে ডেকে নিতে পারত যার যার কাজে। অনুষ্টুপ-এর কাজ তাই আর একটি নতুন খণ্ডে তাদের হারিয়ে যাওয়া উদ্যোগ নিয়ে উপস্থিত হওয়া। পাঠক তার আশা করে থাকবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Review Shankha Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy