ভারতের জনতা— পিপল— বলে কি রাজনৈতিক ভাবে পরিণত কোনও শক্তি আদৌ আছে, এবং তারা কি স্ব-শাসনের অধিকারী? না কি ভারতের গণতন্ত্র একটি বিজাতীয় সাহেবি প্রতিষ্ঠান, আমরা যার যোগ্য নই?
সমস্যাটি নতুন নয়। প্রায় চল্লিশ বছর আগে পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন করেছিলেন, ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ কি আসলে ইউরোপীয় চিন্তা থেকে উৎপন্ন (‘ডেরিভেটিভ ডিসকোর্স’)? বঙ্কিম-গান্ধী-নেহরু ত্রয়ীর বিশ্লেষণ করে সেই সময়ে তাঁর উত্তর ছিল— হ্যাঁ, তা-ই; পরের দিকে সেই উত্তর তিনি খানিক বদল করেছেন। এই বইটি পড়তে পড়তে পার্থর সেই পুরনো বইয়ের কথা মনে পড়তে বাধ্য, কারণ নাজ়মুল সুলতান সেই যুগেরই পুনর্নির্মাণ করেছেন।
ওয়েটিং ফর দ্য পিপল: দি আইডিয়া অব ডেমোক্রেসি ইন ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকলোনিয়াল থট
নাজ়মুল সুলতান
২৫০০.০০
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
মূল তফাত হল, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তার প্রশ্ন ছেড়ে নাজ়মুল এনেছেন ‘পপুলার সভরেন্টি’— জনতার সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গ। জাতীয়তা থেকে জনতা— এই চলনের ফলে নতুন প্রশ্নের উৎপত্তি হয়: ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে জাতীয়তার সমস্যা অতিক্রম করে জনগণ নিজের অধিকারে সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে। রামমোহন থেকে আম্বেডকর পর্যন্ত এক শতকেরও বেশি ভারতীয় চিন্তকের পরিক্রমা করে নাজ়মুল সেই ‘জনতা’-র সন্ধান করেছেন।
বইটির শুরু উনিশ শতকের ‘উদারপন্থী’ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং তার মধ্যে ‘উন্নত’ ও ‘অনুন্নত’ মানুষের শ্রেণিবিভাগের বিশ্লেষণ দিয়ে: ইংরেজ নিজ দেশে যতটা উদার ভারতে ততটা নয়, ভারতীয় জনতা তাদের কাছে উন্নয়নহীনতা ও দারিদ্রের প্রতীক। এই ‘পিছিয়ে পড়া’ অবস্থার দোহাই দিয়েই বহু কাল ইংরেজ স্বরাজের দাবি নস্যাৎ করেছে; রামমোহনের মতো গোড়ার দিকের চিন্তকরা ইংরেজদের এই জাতীয় ধারণা বেশ খানিকটা মেনেও নিয়েছিলেন। তবে উনিশ শতকের শেষ দিকে, জাতীয় কংগ্রেসের গোড়ার দিকের চিন্তক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত ও দাদাভাই নওরোজি, এই চিন্তার শিকল ভাঙতে শুরু করেন। নাজ়মুলের ভাষায়, এঁরা সার্বভৌমত্ব (সভরেন্টি) এবং সরকার (গভর্নমেন্ট)-এর মধ্যে পার্থক্যে জোর দেন: ভারতীয়রা সরকারে যোগ দিলে তবেই আস্তে আস্তে স্বরাজের যোগ্য হয়ে উঠবে। স্বদেশি যুগের বিপ্লবী চিন্তকরা আবার এই ‘দাঁড়িয়ে থাকায়’ প্রস্তুত নন: অরবিন্দ, টিলক বা বিপিনচন্দ্র পাল সরকারের ক্ষমতা তখনই চান। কিন্তু নাজ়মুলের বিচারে যে জনতার উপর ভিত্তি করে সার্বভৌমত্ব সৃষ্টি হবে, স্বদেশি রাজনীতি সেই ‘উন্নত’ জনতার সন্ধান স্পষ্ট করে উঠতে পারেনি, কারণ অনুন্নয়নের সমস্যা সর্বত্রই।
সমস্যাটি অবশেষে ভাঙলেন গান্ধী, কারণ তিনি এই ব্রিটিশ-বর্ণিত উন্নয়নের মাপকাঠিতে গেলেনই না, জনস্রোতে মাঠ দখল করে ভারতীয় জনতার ক্ষমতা দখল করলেন। জনতার সার্বভৌমত্ব দাবি করায় এ এক আশ্চর্য ধাপ। তার উপর, নাজ়মুল দেখিয়েছেন যে, গান্ধী-যুগের তিন জন চিন্তক— ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রাধাকমল মুখোপাধ্যায় এবং চিত্তরঞ্জন দাশ— এই জনস্রোতের রাজনীতিতেও বহুত্বের একটা সন্ধান করলেন, যাতে ভারতের জনতার বৈচিত্র এবং বহুত্বের রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া যায়। কিন্তু এই বহুত্বের সন্ধান নাজ়মুলের চোখে ক্ষণস্থায়ী। নেহরু আবার উন্নয়নের মাপকাঠিতেই ভারতীয় জনতার একটা নতুন নির্মাণ করেন: কিন্তু সেই পুরনো ব্রিটিশ ধারণায় নয়। স্বরাজ যখন প্রায় হস্তগত, তখন উন্নয়ন নেহরুর হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্বারা ভবিষ্যতের ভারতীয় জনতাকে যথাযথ ভাবে উন্নত করে তোলা। এই ধারণার সমালোচক হিসেবে উঠে এসেছেন জিন্না এবং আম্বেডকর, যাঁদের চোখে নেহরুর ধারণা একমাত্রিক। নাজ়মুলের মতে, নেহরুর মতই ১৯৪০-এর দশকের পর থেকে দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়; জনতার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার উন্নয়নবাদ আজও আমাদের উত্তরাধিকার।
বইটির সবচেয়ে বড় গুণ হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বের আলোচনায় ভারতীয় চিন্তকদের নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা। নাজ়মুল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; তাঁর পরিসর মিল, রুশো, হেগেল। তার মধ্যে কেবল গান্ধী-নেহরু নয়, সুরেন্দ্রনাথ-চিত্তরঞ্জন-অরবিন্দ-ব্রজেন্দ্রনাথকে জায়গা করে দেওয়া সহজ কাজ নয়। নাজ়মুল তা করে বিরাট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সার্বভৌমত্ব এবং সরকারের পার্থক্যটি ধারাবাহিক ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে চমৎকার ভাবে, বিশেষ করে প্রথম দিকের অধ্যায়গুলিতে। ভারতীয় উপনিবেশ-বিরোধী চিন্তায় ‘জনতা’র গুরুত্ব নাজ়মুল স্পষ্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন, এবং উন্নয়ন-পন্থী ও উন্নয়ন-বিরোধী দুই স্রোতের বিচক্ষণ বিশ্লেষণ করেছেন।
তবে বইটির খানিক একরৈখিক চাল একটু বিচলিত করে। এখানেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুরনো কাজের সঙ্গে নাজ়মুলের মিল: দু’জনেই একটি উনিশ শতকীয় চিন্তা ধরে গান্ধীতে তার পরিবর্তন এবং নেহরুতে তার সমাধান পেয়েছেন। হ্যাঁ, নাজ়মুল তার মধ্যে বৈচিত্রের সন্ধান দেখিয়েছেন— যেমন ব্রজেন্দ্রনাথ-চিত্তরঞ্জন-রাধাকমলের বহুত্ববাদ— কিন্তু সে সব মতের পরাজয় ঘোষণা করেছেন দ্রুত, শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে কেবলই নেহরুর উন্নয়নবাদ এবং দেশভাগ। আমার মতে, নাজ়মুল খানিক তাড়াহুড়ো করে পরাজয় স্বীকার করেছেন: পঞ্জাব বা বাংলার মুসলিম রাজনীতি বা দক্ষিণের রাজনীতিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলে অন্য ছবি উঠে আসত। তাঁর কাজের কেন্দ্রে মূলত জাতীয় কংগ্রেসের চালিকাশক্তিরা— যদিও শেষ দিকে আম্বেডকর এবং জিন্না কিছু ক্ষণের জন্য উঠে আসেন— এবং বইটির বয়ান তাই কংগ্রেসি রাজনীতির ধারণাই মূলত অনুসরণ করেছে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন রয়ে যায় আধুনিক ভারতে জাতিত্ব ও জনতার সম্পর্ক নিয়ে। নাজ়মুল জাতি ও জনতার মধ্যে একটা পার্থক্য রচনা করেছেন, এমনকি দেশভাগের প্রশ্নটিকেও নতুন মোড় দিতে চেয়েছেন জনতার সার্বভৌমত্বের সমস্যা বলে (তাঁর ভাষায় ‘বাউন্ডারি প্রবলেম’)। এই দৃঢ় পার্থক্য-গঠনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি সন্দিহান, বিশেষত যখন অন্তত নাজ়মুলের বিশ্লেষণে, দুই প্রক্রিয়ারই ফল এক। বরং দেখা প্রয়োজন কখন জাতি ও জনতার ধারণার মধ্যে মিল ও অমিল ঘটে, এবং সেই সম্পর্কের মধ্যে রাষ্ট্র কী অনুঘটকের কাজ করে। হিন্দু পরিচিতির রাজনীতি থেকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশে পট-পরিবর্তন, শেষ পর্যন্ত সার্বভৌমত্বের সব দাবিতেই জাতি ও জনতার ধারণা মিশে থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy