দিগ্দর্শক: পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধনে জওহরলাল নেহরু। ডিসেম্বর, ১৯৫৯
নেহরুর জীবনীকার হিসাবে, বিশ্লেষণে না হোক, তথ্যনিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখনও সর্বপল্লি গোপাল অদ্বিতীয়। তাঁর তিন খণ্ডে নেহরুর জীবনী বহুপঠিত, অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত একটি ক্ষীণকায় পুস্তিকা— দ্য মাইন্ড অব জওহরলাল নেহরু। সেখানে গোপাল লিখেছিলেন, একটি নির্দিষ্ট সময়কালের ইতিহাসে কোনও ব্যক্তির যতখানি প্রভাব পড়ে, ভারতের ইতিহাসে নেহরুর প্রভাব বিবিধ কারণে তার চেয়ে বেশি। সেই পর্বটির নাম ‘নেহরু যুগ’, গোপাল এমন দাবি করেননি। আলোচ্য বইটিতে লেখিকা নির্দেশ করেছেন, নেহরুর মৃত্যুর পর রজনী কোঠারির একটি নিবন্ধে প্রথম ব্যবহৃত হয় ‘নেহরুভিয়ান এরা’ কথাটি। বর্তমান বইয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন এই ‘নেহরু যুগ’-এর ধারণাটিই— লেখিকার মতে যা নেহরু সম্বন্ধে সাতটি মিথ বা অতিকথন, সেগুলিকে বিশ্লেষণ করে তিনি নেহরুকে ‘ডিমিস্টিফাই’ করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ, যুগের উপর তাঁর অনুপাতের চেয়ে বেশি প্রভাবের ধারণাটিকে নেড়েচেড়ে দেখেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ‘অতিমানব নেহরু’র ধারণাটি যেমন তাঁর দল ব্যবহার করেছে, তেমনই ব্যবহার করছেন বিরোধীরা— ভারত সম্বন্ধে প্রতিটি নেতিবাচক কথার জন্যই আঙুল তুলেছেন নেহরুর দিকে, যেন ভারত আর নেহরু সমার্থক।
যে সাতটি অতিকথনকে বিশ্লেষণের জন্য বেছেছেন শারম্যান, সেগুলি হল— ১) নেহরু স্বাধীন ভারতের স্থপতি; ২) নেহরুর নেতৃত্বে ভারত নিষ্পক্ষ বিদেশনীতি অনুসরণ করেছিল; ৩) ভারতে যথার্থই ধর্মনিরপেক্ষতার আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; ৪) নেহরু সমাজতন্ত্রের সাধনা করেছিলেন; ৫) নেহরুর আমলে ভারত ‘স্ট্রং স্টেট’ ছিল; ৬) ভারতে সফল ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; এবং ভারত চালিত হয়েছিল নেহরু-দৃষ্ট আধুনিকতার লক্ষ্যে। প্রতিটি প্রশ্নকেই প্রায় সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন শারম্যান। কিন্তু, তাঁর আলোচনায় দু’টি পৃথক বিশ্লেষণ— এক দিকে, নেহরু কেমন ভাবে নিজেকে, এবং ভারতীয় রাজনীতিতে নিজের উত্তরাধিকারকে দেখেছিলেন, এবং অন্য দিকে, নেহরুর উত্তরাধিকারীরা কী ভাবে নেহরুকে দেখাতে চেয়েছিলেন— জড়িয়ে গিয়েছে বারে বারে। প্রথম অধ্যায়েই শারম্যান লিখেছেন, “কেউ বলতে পারেন, নেহরু নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন চারটি ভূমিকায়: পৃষ্ঠপোষক, মধ্যস্থতাকারী, শিক্ষক ও প্রতীক।” প্রথম তিনটি ভূমিকায় যে নেহরু নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন, দেখতে পছন্দ করতেন, তা নিয়ে তিলমাত্র সংশয় নেই। কিন্তু, প্রতীক? নেহরু নিজেকে সে ভূমিকায় দেখেছিলেন, এমন কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ কি রয়েছে? লেখক তেমন প্রমাণ দাখিল করেননি।
এই বইয়ে নেহরুর আপাত-স্ববিরোধগুলিকে দেখা হয়েছে, কিন্তু কোন সূত্র ধরে দেখলে সেগুলির যৌক্তিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, তার সন্ধান করা হয়নি। নেহরু-চর্চার সেই সূত্রটি হল একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা, যে ভাবনার ভিত্তি হল পাশ্চাত্য আধুনিকতা-নির্ভর গণতন্ত্র। এই কথাটি অবশ্য ‘নেহরু স্কলারশিপ’-এ অনুপস্থিত নয়— শারম্যান তাঁর আলোচনাকে সে দিকে নিয়ে যাননি, এই মাত্র। অন্য কোনও তথ্যসূত্রের প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র নেহরুর সিলেক্টেড ওয়ার্কস ধারাবাহিক ভাবে দেখলেই স্পষ্ট হয়, স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের গতিপথ নির্ধারণের দায়িত্বটি মূলত তাঁর কাঁধে এসে পড়বে, এ কথাটি নেহরুর কাছে যত স্পষ্ট হয়েছে, ততই তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের আধুনিকতা।
শারম্যান একটি নবনির্মিত বাঁধের প্রসঙ্গে নেহরুর একটি বহু-উদ্ধৃত বাক্যকে আধুনিকতা সম্বন্ধে তাঁর অবস্থানের সূচক হিসাবে ব্যবহার করেছেন— “এই হল নতুন ভারতের মন্দির, যেখানে আমি উপাসনা করি।” কোনও একটি বাক্যকে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে চ্যুত করে, এবং অন্য বিবেচনা বর্জন করে সেই উদ্ধৃতিকেই একটি বৃহত্তর অবস্থানের প্রতীক হিসাবে দেখার মধ্যে ইতিহাসবোধের যে অভাব রয়েছে, কোনও গবেষণাধর্মী কাজে সেই অভাব পীড়াদায়ক। সত্যিই কি আধুনিকতা বলতে নেহরু শুধু বুঝতেন প্রযুক্তিগত উন্নতিকে, পরিকাঠামোর মাহাত্ম্যকে? এমন দাবি অবান্তর, কারণ নেহরু ‘আধুনিকতা’ বলতে কী বুঝতেন, তার ব্যাখ্যা যেমন তাঁর নিজের লেখাতেও বহু বার রয়েছে, তেমনই রয়েছে পরবর্তী সময়ের গবেষকদের কাজেও। সেই আধুনিকতা যেমন বাঁধ আর কারখানায় সীমিত নয়, তেমনই— শারম্যান যেমন দেখিয়েছেন, তার ঠিক বিপ্রতীপ— ‘আধুনিক’ ভারতের শরীর থেকে ‘প্রাগাধুনিক’ ভারতের যাবতীয় চিহ্ন মুছে ফেলার আগ্রহেও আবদ্ধ নয়।নেহরুর কাছে আধুনিকতা ছিল প্রথমত প্রতিষ্ঠানের আধুনিকতা— সেখানে গণতন্ত্র যেমন একটি প্রতিষ্ঠান, আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন তেমনই এক প্রতিষ্ঠান, আবার উচ্চশিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে বিজ্ঞানচেতনা
নির্মাণ, প্রযুক্তিগত উন্নতিও সেই আধুনিক প্রতিষ্ঠানেরই রূপ। নেহরুর জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটিকেও আধুনিকতার লেন্সে দেখা বিধেয়। স্বাধীন রাষ্ট্রকে যে জাতির পরিচয়ে গাঁথতে চেয়েছেন নেহরু, তা নির্দিষ্ট ভাবেই ধর্ম, ভাষা বা প্রাদেশিক খণ্ডতাকে অতিক্রম করে রাষ্ট্র-পরিচালিত উন্নয়ন কর্মসূচিকে জাতির সংজ্ঞা হিসাবে দেখতে চায়। এক অর্থে, এই দেখাটি সময়ের দাবি— ধর্মের ভিত্তিতে খণ্ডিত পরিসরকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইলে এ ছাড়া আর উপায়ান্তর ছিল না। কিন্তু, অন্য ভাবে দেখলে, নেহরু জাতির যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করছেন, সেটি আসলে তাঁর আধুনিকতার প্রকল্পের অঙ্গাঙ্গি— ধর্ম বা জাতের মতো ‘প্রাগাধুনিক’ পরিচিতিকে অতিক্রম করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আধুনিক পরিচিতিকে জাতির সংজ্ঞা হিসাবে ব্যবহার করা। ভেবে দেখলে, শারম্যান এই বইয়ে যে সাতটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেগুলোর সবই আসলে এই ‘আধুনিক’ ভারতের দিকে যাত্রার এক-একটি পদক্ষেপ।
এই দিক থেকে দেখলে নেহরুর স্ববিরোধগুলি আসলে সেই আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ছোট-বড় সমঝোতা বলে প্রতিভাত হবে। আলোচ্য বইটিতে লেখক নেহরুর সমাজতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এখানে স্পষ্ট বলা দরকার যে, নেহরুর আমলেও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা যে চরিত্রে সমাজতন্ত্রী ছিল না, সে কথা অন্তত চল্লিশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত— রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অপ্রকাশিত গবেষণা সন্দর্ভটি সেই আলোচনার বড় উদাহরণ। নেহরু নিজেও বহু প্রসঙ্গে, বহু পরিসরে জানিয়েছেন, কোনও পুঁথিগত ‘বাদ’-এর প্রতি তাঁর আনুগত্য নেই, যে পথে ভারতের উন্নয়ন (অর্থাৎ, আয়বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের জীবনযাপনের গুণগত মানোন্নয়ন, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বর্তমানের চেয়ে বেশি সুযোগ তৈরি করা— নেহরুর আধুনিকতার সংজ্ঞা যে উন্নয়নের কথা বলে) সম্ভব, তিনি সেই পথেরই পথিক। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মহামন্দা-উত্তর দুনিয়ায় ভারতে তৈরি হয়েছিল বহু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা— তার মধ্যে ঔপনিবেশিক সরকারের আধিকারিকদের তৈরি পরিকল্পনা যেমন ছিল, ছিল দেশীয় রাজ্যের দেওয়ানের তৈরি পরিকল্পনা, নেহরুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির উদ্যোগ, তেমনই ছিল গান্ধীবাদী পরিকল্পনা, আবার বিশিষ্ট শিল্পপতিদের ‘বম্বে প্ল্যান’। অর্থাৎ, আর্থিক পরিকল্পনা বিবেচিত হয়েছিল উন্নয়নের ‘টুল’ বা আয়ুধ হিসাবে, সমাজতন্ত্রের বাহন হিসাবে নয়।
কিন্তু, সমাজতন্ত্রের অতিকথন প্রতিষ্ঠা করার জন্য যদি প্রশ্ন তোলা হয় যে, নেহরু কেন যাবতীয় বেসরকারি উৎপাদন-প্রকরণকে রাষ্ট্রায়ত্ত করলেন না, অথবা কেন তাঁর সরকার এমন ক্ষেত্রে লগ্নি করল যেখানে বেসরকারি পুঁজি এমনিতেও যাবে না, তা হলে সমঝোতাকে স্ববিরোধিতা বলে ভুল করা হবে। নেহরু একাধিক বার বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্তকরণের কথাটিকে ভাবতে হবে সীমিত আর্থিক সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখে— যে শিল্প ইতিমধ্যেই আছে, সেগুলিকে রাষ্ট্রীয় দখলে আনার বদলে নতুন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা অনেক বেশি জরুরি। বণিকসভার ভাষণে তিনি বলেছেন যে, রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব পুঁজিপতি শ্রেণিকেও নিতে হবে— রাষ্ট্রের সঙ্গে পুঁজির সম্পর্কটি সেখানে বৈরের নয়, সহযোগিতার।
এই অবস্থানকে নিশ্চিত ভাবেই প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু, লেখক যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, অর্থাৎ নেহরুর ‘ভারতীয় সমাজতন্ত্র’ পুঁজিপতিদের উন্নয়নের ট্রাস্টি বা অছি হিসাবে দেখেছিল, নেহরুর ভাবনার পরিসরে অন্তত সেটি দাঁড়ায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যে-হেতু নেহরুর আধুনিকতার প্রকল্পের একটি কেন্দ্রীয় উপাদান, তার পরিচালনার অধিকার রাষ্ট্র ব্যতীত আর কারও হাতে থাকতে পারে না। এই প্রসঙ্গে আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের (ইম্পিরিয়ালিজ়ম, ন্যাশনালিজ়ম অ্যান্ড দি ইন্ডিয়ান ক্যাপিটালিস্ট ক্লাস, ১৯২০-১৯৪৭) অবস্থানটি উল্লেখযোগ্য: ভারতীয় পুঁজিপতিদের কোনও অংশই নেহরুকে তাঁদের শ্রেণিস্বার্থের প্রতিনিধি হিসাবে দেখেননি। “উভয় (নেহরু এবং ভারতীয় পুঁজিপতি) পক্ষ (পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে) ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন দু’টি বিপরীতমুখী উদ্দেশ্যে। পুঁজিপতিরা ভারতের বামপন্থী জাতীয়তাবাদী কর্মসূচির কিছু উপাদানকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এর অর্থ যেমন এই নয় যে, তাঁরা নিজেদের লক্ষ্য পরিবর্তন করে সমাজতন্ত্রের সাধনা করছিলেন, তেমনই নেহরু তাঁর উন্নয়ন কর্মসূচিতে পুঁজিপতিদের সহযাত্রী করার জন্য নিজের বামপন্থী কর্মসূচির সুর খানিক নামিয়ে এনেছিলেন মানে এই নয় যে, তিনি পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠাকেই নিজের লক্ষ্য করে তুলেছিলেন।”
নেহরুকে বুঝতে গেলে তাঁর এই সমঝোতাগুলিকে বোঝা জরুরি। দেখা প্রয়োজন, আধুনিক রাষ্ট্রনির্মাণের প্রকল্পে এই সমঝোতাগুলি কতখানি কেন্দ্রীয় ছিল। এই বইয়ের মূল খামতি সেই অনুসন্ধানের পথে না হাঁটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy