নির্মাণ: অপুর সংসার-এর শুটিং। অপু-ট্রিলজির অনুরক্ত ছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত। সত্যজিৎ রায় সোসাইটি
চিদানন্দ দাশগুপ্তের গদ্যসংগ্রহ সম্পাদনায় শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাগুলির বিন্যাস করেছেন কাল নয়, বিষয় অনুসারে। ফলে রচনাগুলির ব্যাপ্তি চিদানন্দবাবুর লেখালিখি শুরুর থেকে তাঁর মৃত্যুর কিছু বছর আগে অবধি। এতে যেমন নতুন আর পুরনো লেখার স্বাদ পাশাপাশি আস্বাদন করা যায়, লেখকের মনন ও প্রজ্ঞার বিবর্তনেরও হদিস মেলে। এই বইটি সাতটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত, যদিও তাতে মোটামুটি তিনটি বৃহৎ আলোচনার ধারা লক্ষ করা যায়: চলচ্চিত্র আন্দোলন (ও ফেস্টিভ্যাল)-এর এ-কাল ও সে-কাল; সত্যজিৎ রায় ও তাঁর সিনেমাজগৎ; বাংলা ছবির হাল (ও বেহাল) হকিকত।
প্রথমেই বলতে হয়, এই গদ্যসংগ্রহে যা খুব স্পষ্ট তা হল সিনেমা নামের জটিল সমবেত অথচ ক্ষণিক নিত্য-পরিবর্তনীয় শিল্পের প্রতি চিদানন্দের আনুগত্য ও অনুরাগ। সিনেমাকে বোঝা এক জিনিস, ভালবাসা আর এক। চলচ্চিত্রের মান ও সৌষ্ঠব নিয়ে তিনি যেমন ভাবিত, আবার অধিকাংশ ছবি ঠিকমতো চলচ্চিত্র হয়ে উঠল না, সে বিষয়ে চিন্তাক্লিষ্টও বটে। সিনেমাকে বৌদ্ধিক যুক্তি-তক্কে মুড়ে ফেললেও তিনি তার রূপ রস গন্ধে এক রকম নিমজ্জিত। তার কিছু উগ্র দিকও আছে, সে আলোচনা পরে। কিন্তু সিনেমার প্রতি এমন আকণ্ঠ ভালবাসাকে কুর্নিশ না করে পারা যায় না।
চিদানন্দ দাশগুপ্ত গদ্যসংগ্রহ ১
সম্পা: শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৯৯.০০
দে’জ পাবলিশিং
এর মধ্যে প্রথম যে বিষয়— চলচ্চিত্র আন্দোলন— তাতে চিদানন্দ দাশগুপ্তের ভূমিকা এ দেশে পথিকৃৎসম। বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন সময়ে আর বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখা এই আন্দোলনের ইতিহাস ও উত্তরণ এই সংগ্রহের সবচেয়ে আকর্ষক দিক। রাজনৈতিক বা রাজনৈতিক আত্মীয়তা আছে এ রকম আন্দোলনের শ্রম ও সমস্যা নিয়ে দেশে কাজের খামতি নেই, কিন্তু তার বাইরে যে অনেক রকম আন্দোলনের রেওয়াজ আছে তা আমরা সব সময় মনে রাখি না। সে দিক থেকে দেখলে চিদানন্দবাবুর লেখাগুলো— কখনও স্মৃতিচারণামূলক, কখনও বা বিশ্লেষণধর্মী— কলকাতা তথা ভারতে সিনেমার প্রতি সচেতনতা তৈরির ‘অ-সচেতন’ ইতিহাসও বলা যেতে পারে। গ্রন্থের শুরুতেই চিত্রভাষ পত্রিকার সঙ্গে চিদানন্দবাবুর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে এর অনেকটাই ধরা পড়ে। এ ছাড়াও আছে বেশ কিছু প্রবন্ধ। সাধারণ মানুষের সিনেমার প্রতি অবজ্ঞা বা অজ্ঞতা দূর করা যদি আন্দোলনের একটি লক্ষ্য হয়, আন্দোলনের আর একটা দিক দেশ-বিদেশের ছবি দেখার ব্যবস্থা করা, আর সেই নিয়ে পাবলিক ডোমেন-এ যুক্তি তর্ক গল্পের আসর বসানো। সে দিন অবধিও ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ দেখার চোখ তৈরি করা থেকে তাকে ঘিরে হইচই, অনেকটাই করেছে একাধিক সিনেমা সোসাইটি। এর প্রারম্ভিক সময়ের যে ‘ছবি’টা তাঁর লেখায় পাওয়া যায়, যা সত্যি কৌতূহলোদ্দীপক। এর এক দিকে চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে বসেও সিনেমা নিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের নাক কুঁচকানো, আবার অন্য দিকে ছোকরা সিনেফাইলদের অনুরোধে রবিবার সকালে দুর্লভ মেক্সিকান ছবির ৩৫ মিমি প্রদর্শনে লাইটহাউস বা মেট্রো কর্তৃপক্ষের অম্লান বদান্যতা, দুই-ই আমরা দেখতে পাই। স্বাধীনতার অনতিকাল পরেই ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখাতে গিয়ে ‘বিপ্লবের প্রস্তুতি’ নেওয়ার অভিযোগে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি-র উপর পুলিশি নজরদারির ঘটনা তো কিংবদন্তিসম। এই প্রসঙ্গে ১৯৯৯-এ লেখা নতুন শতাব্দীতে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন বিষয়ক প্রবন্ধটিতে পোস্টমডার্ন কন্ডিশন-এর অঙ্গস্বরূপ ক্ষুদ্রীকরণ (মিনিয়েচারাইজ়েশন) আর ব্যষ্টিকরণ (ইনডিভিজুয়েশন) নিয়ে তাঁর মতামত শুধু জোরালোই নয়, দূরদর্শীও বটে। তবে পরের লেখায় কিছুটা অস্ফুট হলেও এও কিছুটা ধরা পড়ছে যে সিনেমা আন্দোলনে তেমন সাফল্য কোনও কালে আসেনি, মানুষকে বোঝানোর কাজটা শেষে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার আয়োজনও হয়ে থাকতে পারে।
সত্যজিৎ রায়ের ছবি, বিশেষ করে ‘অপু ট্রিলজি’ নিয়ে চিদানন্দ দাশগুপ্তের যে অনুরক্তি, তা নিয়ে নতুন করে পাঠকদের বলার কিছু নেই। সিনেমা চেনানো, ফিল্ম সোসাইটি তৈরিতে পাশে থাকা, সিনেমার অলিগলি বা বিদেশি ছবি নিয়ে চিন্তাভাবনা— এর প্রত্যেকটির জন্যই সত্যজিৎ রায়ের প্রতি তিনি যে যারপরনাই কৃতজ্ঞ, সেটা বার বার উঠে এসেছে। কিন্তু যেটা মনে রাখার সেটা হল প্রথম জীবনে গাঢ় বন্ধুত্ব সত্ত্বেও পরবর্তী জীবনে ‘ছবি করিয়ে’ আর ‘ছবি সমালোচক’ তাদের নিজস্বতা বজায় রেখে দুই আলাদা অক্ষরেখায় দাঁড়ায়। বন্ধুর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও সমালোচক চিদানন্দ জানিয়ে দেন কেন অভিযান ছবিতে সৌমিত্র বেমানান, কেন চারুর প্রতি পরিচালক সত্যজিতের যে ‘এমপ্যাথি’ তার কণাটুকুও জোটে না ঘরে বাইরে ছবির বিমলার। বর্তমান বাংলা ছবির যে কুশ্রী রূপ, তার অন্যতম কারণ সাহসী সমালোচক বলতে বাংলায় প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। সত্যজিৎ সম্পর্কে চিদানন্দের সুচিন্তিত লেখাগুলোর পাঠে বর্তমান নিম্নমেধার যজ্ঞ থেকে উত্তরণের কিছু হদিস অবশ্যই পাওয়া যেতে পারে, অন্তত সমালোচকের ভূমিকা সংক্রান্ত।
এ সবের পরেও কিছু প্রশ্ন নিতান্তই ফাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে সিনেমা নিয়ে ঐকান্তিক চর্চা করার একনিষ্ঠ প্রয়াসকে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হিসাবে ধরা কখনওই ঠিক হবে না। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, সেই প্রসঙ্গে চিদানন্দ দাশগুপ্তের বার বার ‘সৎ সিনেমা’র উল্লেখ কিছুটা বিভ্রান্তি ও বিরক্তির সৃষ্টি করে। সৎ সিনেমা মানে কী? পুরস্কার পাওয়া ছবি? গম্ভীর দুঃখী ছবি? এর সঙ্গে জিজ্ঞাস্য: যাঁরা এই নিরিখে সিনেমা করেন না, শিল্পী হিসাবে তাঁদের ‘সারভাইভাল’টাই ‘অসৎ’ কি না। সিনেমার নৈতিক দায় অন্য যে কোনও শিল্পের মতোই, ধর্মের মতো নৈতিক-অনৈতিকের জালে শিল্প নিজেকে জড়িয়ে ফেললে, ইতিহাস বলে তার মৃত্যু অনিবার্য। সোভিয়েট রিয়ালিজ়মের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। তা হলে কি ধরে নিতে হবে, এ দেশে তথাকথিত আর্ট ফিল্ম ও ফিল্ম আন্দোলনের স্বঘোষিত নৈতিকতার ক্রুশ আদতে তাকে এক ধরনের রক্ষণশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল?
এর কিছু আভাস এই বইয়েই আছে, তা হল নির্দিষ্ট ছবির সমালোচনা, বিশেষ করে সে ছবি যদি বাঙালির জনপ্রিয় ছবি হওয়ার দুর্ভাগা উদাহরণ হয়ে থাকে। চল্লিশের দশকের শেষ বা পঞ্চাশের শুরুর দিকের যে ক’টি ছবির সমালোচনা এখানে গ্রন্থিত, সব ক’টিতেই যেন এক ধরনের কিশোরোচিত আমর্ষ। বাংলা ছবির বিবিধ দুর্বলতা— চিত্রনাট্যের শিথিলতা, অভিনয়ের দৈন্য, শিল্প তো দূরের কথা চলচ্চিত্রের সিনেমা হয়ে ওঠার চেয়ে নাটক বা সাহিত্যের রসে নিজেকে রঞ্জিত করার ঐকান্তিক ইচ্ছে, এগুলো যে ইউরোপীয় সিনেমা-শিল্পে অল্পবিস্তর হাতেখড়ি হওয়া আঁতেলের ভ্রান্ত উন্নাসিকতা, তা কিন্তু একেবারেই নয়। এগুলো বাংলা ছবির মৌলিক সমস্যা। পথের পাঁচালী-র আগেও তা ছিল, পরেও। কিন্তু এও ঠিক যে পথের পাঁচালী-পূর্ব বাংলা ছবি নেহাতই আঁস্তাকুড়ের সম্পদবিশেষ— এও অতি গুরুতর দোষারোপ। সাহিত্য, নাটক বা চারুকলার মতো প্রত্যেক দেশের সিনেমাও তার নিজস্ব ইতিহাস বা পরিমণ্ডলের ওজনবাহী। তেমনই, হীরালাল থেকে সত্যজিৎ-পূর্ব অর্ধশতকের বাংলা ছবির ইতিহাসে একাধিক বাঁক, তার নীচে একাধিক স্তর। আধুনিকতার সঙ্গে কখনও তার ঝগড়া, কখনও ভাব। সিনেমাপ্রেমীর সঠিক কাজ হওয়া উচিত সেই বাঁকগুলোর হদিস। অথচ এ ক্ষেত্রে চিদানন্দ যা করলেন তা হল, এই সময়টাকে এবং তার কুশীলবদের একই ধাঁচে ঢেলে কলমের ঝটকায় ‘গণিকা’, ‘পঙ্গু’, ‘জড়বুদ্ধি’ ইত্যাদি বিশেষণে তাচ্ছিল্যের তিক্তরসে ডুবিয়ে দেওয়া। এ-হেন ‘ইতিহাসহীন’ পর্যবেক্ষণের অন্যতম শিকার পথের পাঁচালী স্বয়ং: চিরকাল মিথ হয়ে থেকে গেল ছবিটি, কোনও দিনই তার ইতিহাসের অংশ হওয়া হল না।
অনুরাগে নয়, বরং ফিল্ম নামক বস্তুটিকে বোঝায় এখানেই কিছুটা খামতি থেকে যাচ্ছে অগ্রণী সমালোচকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy