জয়: তহরির স্ক্যোয়ারে সাঁজোয়া গাড়ি দখল করে বিদ্রহী নাগরিরদের উল্লাস।
এই সরস্বতী পুজোর একটা ব্যক্তিগত গল্প দিয়ে শুরু করি। আমাদের বাড়ির পুজোয় কোনও পুরোহিত আসেন না, পুজোটি করে আমার এক মামাতো বোন। ঘটনাক্রমে আমার এবং সেই বোনের, দু’জনেরই মোটের উপর বিশ্বাস অজ্ঞেয়বাদী— ঈশ্বর আছেন কি না, তা নিয়ে আমাদের সংশয় আছে। যা-ই হোক, পুজো চলাকালীন একটা বিভ্রান্তি তৈরি হল— কোনও একটি নির্দিষ্ট পাত্র ডান দিকে রাখার কথা, না কি বাঁ দিকে, তা নিয়ে। শেষ অবধি যে সমাধানসূত্রে পৌঁছনো গেল, তা এই রকম— যদি ঈশ্বর থাকেন, তবে তিনি সর্বত্রগামী এবং সর্বশক্তিমান, ফলে বাঁ দিকে রাখার জিনিস ডান দিকে রাখলেও তাঁর নিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না; আর যদি ঈশ্বর না থাকেন, তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল, পুরোটারই কোনও মানে নেই। কাজেই, ঈশ্বর থাকুন বা না-ই থাকুন, জিনিসটা যেখানে হোক রাখলেই চলবে।
কৌশিক বসুর নতুন বইটির আলোচনার শুরুতেই এক প্যারাগ্রাফ ব্যক্তিগত গল্প একেবারে অকারণে নয়— সরস্বতী পুজোর পরের দিনই বইটা পড়তে গিয়ে দেখলাম, তিনিও দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব বিষয়ে। জানিয়েছেন যে, ঈশ্বর আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। কারণ, যে দুনিয়ায় এত অন্যায়-অনাচার রয়েছে, সেখানে কোনও সর্বশক্তিমান এবং অসীম দয়াময় ঈশ্বরের উপস্থিতি সংজ্ঞাগত ভাবেই অসম্ভব— অর্থাৎ, ঈশ্বর থাকলে এই অন্যায়গুলো তিনিই বন্ধ করে দিতেন। এখানেই থামেননি অধ্যাপক বসু। লিখেছেন যে, হয়তো এমন কেউ আছেন যিনি বেশ ভাল রকম শক্তিমান, এবং মোটের উপর দয়াবান। কিন্তু, তাঁকে তো সংজ্ঞা অনুসারে ‘ঈশ্বর’ বলা চলে না!
ঈশ্বরবিশ্বাস বা অধ্যাত্মচিন্তার বাইরে বেরিয়ে যদি উপরের আলোচনাটুকুকে দেখি, তা হলে এতে স্পষ্ট হয় একটাই কথা— অধ্যাপক বসু যুক্তির কাঠামোয় ফেলে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। এই বইটির আগাগোড়া তিনি এই কাজটিই করে গিয়েছেন— দেখিয়েছেন, যে কোনও পরিস্থিতিতে কী ভাবে যুক্তিকে ব্যবহার করে পৌঁছনো যায় সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধান্তে। এই কাজে তাঁর আয়ুধ গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্বতত্ত্ব— বিজ্ঞানের দুনিয়ায় অনতিপ্রাচীন এক তাত্ত্বিক কাঠামো, গত একশো বছরে যা ব্যবহৃত হয়েছে গণিত থেকে অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান বা দর্শনের আলোচনায়। এই বইয়ে বেশ কয়েকটি ‘গেম’ কষে দেখিয়েছেন অধ্যাপক বসু। কিন্তু, যদি সেই গণিতে কোনও পাঠকের রুচি না থাকে, তাতেও সমস্যা নেই, কারণ দ্বন্দ্বতত্ত্বের ব্যবহার যুক্তির কাঠামোকে স্পষ্ট করে দেওয়ার জন্য, তার বিকল্প হিসাবে নয়। ফলে, গণিতে অনীহা কিন্তু যুক্তিতে আগ্রহ আছে, এমন পাঠকের কাছেও এই বইয়ের আলোচনা মনোগ্রাহী হতে পারে।
রিজ়ন টু বি হ্যাপি: হোয়াই লজিক্যাল থিঙ্কিং ইজ় দ্য কি টু আ বেটার লাইফ
কৌশিক বসু
৭৯৯.০০
টর্ভা (পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস)
বইয়ের আলোচ্য বিষয়ের পরিধি ব্যাপ্ত, তা স্বীকার করতেই হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের সফল জীবনের উজ্জ্বল ছবি দেখে হতাশায় ভোগা থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ ঠেকানোর উপায় বা একনায়কতন্ত্রে বিদ্রোহ দমনের কৌশল, যুক্তির কাঠামোয় এসেছে বহুবিধ প্রসঙ্গ। অধ্যাপক বসু বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দেওয়ার সময় আমরা প্রত্যেকেই নিজের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোকে বেছে নেব, সেটাই ‘ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম’— দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চালের শেষে পৌঁছনো একটি অবস্থা, সবাই যেখানে স্থিত হলে কোনও এক জনের পক্ষে সেই অবস্থা থেকে সরে আসা তার নিজের পক্ষে অ-লাভজনক। কাজেই, অন্যের ঝলমলে ছবি দেখে হতাশ হওয়ার আগে ভেবে নেওয়া ভাল, অন্ধকারের ছবিগুলো প্রকাশ্যে আসে না কেন।
কোনও স্বৈরাচারী শাসক কী ভাবে দমন করতে পারেন নাগরিক বিদ্রোহকে? তারও ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়ামের সন্ধান রয়েছে বইয়ে। ধরা যাক, কোনও দেশে জনসংখ্যা ১০০০, সবাই শাসকের উপরে বিরক্ত, সবাই রাস্তায় নামতে চান বিক্ষোভ প্রদর্শনে। শুধু একটাই মুশকিল, কেউ যদি জানেন যে, রাস্তায় নামলে তাঁকে নিশ্চিত ভাবে গ্রেফতার হতে হবে, তা হলে তিনি আন্দোলনে আসবেন না। এ দিকে, শাসকের জেলখানায় ধরে মোট ১০০ লোক। সহজ হিসাব— গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনা ১/১০। অর্থাৎ, দশ জনের মধ্যে ন’জনই গ্রেফতার হবেন না। এই অবস্থায় সবাই রাস্তায় নামবেন, এবং তা হলেই স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটবে। এই অবস্থায় শাসকের হাতে একটি অস্ত্র রয়েছে— জনসংখ্যাকে ১০০ জনের মোট দশটি ভাগে ভেঙে ফেলা। প্রথম দলে বিরোধী নেতারা, দ্বিতীয় দলে সাংবাদিকরা, তৃতীয় দলে ছাত্ররা, এই ভাবে মোট দশটি দল। এবং জানিয়ে দেওয়া যে, বিক্ষোভ দেখাতে এলে প্রথম দলের একশো জনকে নিশ্চিত ভাবেই গ্রেফতার করা হবে। যদিপ্রথম দলের ১০০ জন না আসেন, তা হলে গ্রেফতার করা হবে পরবর্তী দল থেকে। এই ভাবে দশম দল অবধি গড়াবে ব্যাপারটা।
যে-হেতু গ্রেফতার হওয়া নিশ্চিত হলে মানুষ পথে নামবেন না, ফলে স্বভাবতই প্রথম দলের ১০০ জন বিক্ষোভের দিন অনুপস্থিত থাকবেন। যুক্তি দিয়ে ভাবলে দ্বিতীয় দলের লোকরা আন্দোলনে যাওয়ার আগেই বুঝবেন যে, প্রথম দলের লোকরা আসবেন না, ফলে তাঁদের গ্রেফতার হতে হবে। ফলে দ্বিতীয় দলের লোকরাও যাবেন না। এই ভাবে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম থেকে দশম দল, সবাই যুক্তি দিয়ে বুঝবেন যে, গেলে নিশ্চিত ভাবেই গ্রেফতার হতে হবে। ফলে, এই ‘গেম’-এর ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম হল, কেউই বিক্ষোভ দেখাতে যাবেন না। অন্তত, তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের ট্যাঙ্কম্যান-এর মতো না হলে। স্বৈরশাসকের জয় হবে। এই গল্প থেকে কি সাম্প্রতিক ভারতের কোনও ছবি ফুটে উঠছে?
কৌশিক বসু মনে করিয়ে দিয়েছেন, নিজের উপরে ছাড়া দুনিয়ার আর কিছুর উপরেই আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে, ভেবে দেখতে হবে যে, নিজের পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব, তাতে কি দুনিয়ার পরিস্থিতিতে বিন্দুমাত্র ফারাক আনা যায়? যদি তা সম্ভব হয়, তবে সর্বশক্তিতে সে কাজ করতে হবে। যদি এই মুহূর্তে তা সম্ভব না-ও হয়, তবু ভুললে চলবে না যে, কিছু করা প্রয়োজন। কিন্তু, তার জন্য রেগে যাওয়া, হতাশ হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের ভিতরে সর্ব ক্ষণ যুক্তির খেলা চালিয়ে যেতে হবে। ছোট থেকে বড়, সব কিছুকেই বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যুক্তির কাঠামোয়। যেমন, ভেবে দেখতে পারেন, প্রতি দশ মিনিট জগিং করলে আপনার আয়ুতে যদি আট মিনিট বাড়তি সময় যোগ হয়, তা হলে কি আপনার জগিং করা উচিত? যদি জীবনের জগিং না-করা (অর্থাৎ, সেই সময়টিকে কোনও অন্য কাজে ব্যয় করা) সময়ের পরিমাণকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়াই আপনার উদ্দেশ্য হয়, তা হলে জগিং না করাই ভাল। কারণ, প্রতি দশ মিনিট জগিংয়ে ব্যয় হচ্ছে দশ মিনিট (যা জগিং না করলে অন্য কাজে ব্যবহার করা যেত), আর জমা হচ্ছে আট মিনিট— নেট খরচ দু’মিনিট!
অবশ্য একটা প্রশ্ন থাকে। অর্থশাস্ত্রের একাধিক পূর্বানুমানকে এই বইয়ে প্রশ্ন করেছেন কৌশিকবাবু, এর আগেও অন্যান্য বইয়ে করেছেন সেই অতি জরুরি কাজটি। কিন্তু, মানুষের যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা অসীম, অর্থশাস্ত্রের এই নিতান্ত অবাস্তব পূর্বানুমানটিকে তিনি প্রশ্ন করলেন না কেন? বিশেষত, আচরণবাদী অর্থনীতির গবেষণা দেখাচ্ছে, যে মুহূর্তগুলিতে কৌশিকবাবু যুক্তির আশ্রয় নিতে বলছেন, সেই রাগ-দুঃখ-উত্তেজনার মুহূর্তেই মানুষের যুক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতা সবচেয়ে কম থাকে। মগজ যদি ভাবার উপায়টুকুই না রাখে, কী করে ভাববেন লোকে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy