এক জন কবি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন: “কবিতায় সমাজ, দেশ পাল্টানো যায় কিনা, এ সব কথার মধ্যে অযথা না জড়িয়ে ভবিষ্যৎ আর আরো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গুপ্ত সাংকেতিক ইশারা কিছু রেখে যাওয়া, একজন কবির কাছে মনে হয় অনেক ভালো।” ২২/৮/১৯৮৬ এই তারিখটি বসানো আছে কথাগুলির নীচে। এর তেরো বছর পরে এক সাক্ষাৎকারে এই কবিই বলেছেন: “আমার কবিতায় যে-সব গলির কথা এসেছে, প্রথমেই জানাই, তা শুধু উত্তর কলকাতার নয়। সারা কলকাতার গলিগুলো আমাকে টানে। কলকাতার বাইরের অথবা যে-কোনও জায়গার গলিও। এই গলি আর রাস্তাগুলোর সঙ্গে আমি একটা আত্মিক টান অনুভব করি।... একটা গলি হয়তো বেঁকে গেছে ডান-দিকে আবার কিছুদূর গিয়েই চুপচাপ বাঁ-দিকে বাঁক নিয়েছে। মনে হয়, কোনও কথা এরা বলতে চায় আমাকে। সমুদ্র যেমন ঢেউয়ের সঙ্গে বালিতে ঝিনুক উপছে দাঁড়িয়ে থাকে, কলকাতাও সে-রকম এই গলিগুলোকে চার দিকে ছড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সব গলি আর তার মানুষজনদের কথা লিখে রাখাটাই যেন আমার কাজ...।” এই সাক্ষাৎকারের দশ বছর আগে ২৯/১/১৯৮৯ তারিখে সে-কবি লিখে রেখেছেন কবিতায়: “এই সেই গলি যেখানে আমার বাপ-কাকারা বেঁচেছিলেন/আমাদের ছেলে-ছোকরারাও/এই গলিতেই তাস পিটবে প্রেম করবে আর ধুপধাপ দৌড়বে রাতদুপুরে/... আপনার কি মনে হয় না/ইতিহাস এসে এই গলিতেই ছাতামাথায় দাঁড়িয়ে পড়বে একদিন.../এই সেই গলি যেখানে সামান্য একটা মাছি আস্ত হরিণকে/টেনে নিয়ে যায়/আর আমরা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনি/আর আমরা বন্ধ ঘর থেকে শুনি/জানলার বাইরে লক্ষকোটি টনের নিশ্বাস আর ভাসমান এক গোঁঙানি।”
এ-কবিতার এগারো বছর আগে এই কবি-ই লিখেছিলেন: “...সেদিন একটা ছেলেকে/দেখলাম, তার বাবার গায়ে গরম জল ঢেলে দিচ্ছে—/একটা লোককে দেখলাম পেচ্ছাপ করতে করতে কাঁদছিল।” আরও তিন বছর আগে ১৯৭৫ সালে তাঁর কবিতা বলবে: “ওরা আমাকে মোচড় দিয়েছিল/ ওরা আমাকে গলা টিপে ধরেছিল/ ওরা আমার খাবার বন্ধ করেছিল/ আমার সারা গায়ে দাঁতের দাগ/ বিছানার বদলে রাস্তা আর,/ ঘুমের বদলে জেগে ওঠা/ আর দৌড়নো দৌড়নো আর দৌড়নো—” কবিতাটিতে এর পরেই এসে পড়ছে একটি অমোঘ স্পেস, স্পেসের পরে মাত্র একটিই লাইন: ‘শুধু একটা পিস্তলের জন্যে’। মনে রাখতে হবে ১৯৭৫ সাল মানে নকশাল যুবকদের ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে তার আগে। মাত্র চার বছর আগেই ঘটে গেছে বরাহনগরের কুখ্যাত গণহত্যা। এ-কবিতার নাম ‘ওরা’। এ-কবিতায় কবির যে ‘আমি’ তা রূপান্তরিত হয়েছে নির্মম ভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং নিরুপায় ভাবে হিংসার গ্রাসে ঢুকে যাওয়া বিপ্লবী যুবকদের ‘আমি’-র মধ্যে।
কবিতা সমগ্র ১, ২
ভাস্কর চক্রবর্তী
৪৫০.০০ প্রতি খণ্ড
দে’জ়
কার কবিতা নিয়ে কথা বলছি এত ক্ষণ? হ্যাঁ, ভাস্কর চক্রবর্তী। ‘ওরা’ কবিতা লেখার তিন বছর পর ভাস্করের কবিতা ডাক দিয়ে জানাবে: “কলকাতার রাস্তায়, লন্ডনের রাস্তায়, প্যারিসের রাস্তায়,/ ঘরছাড়া, বাড়িছাড়া ভাই আমার,/ চায়ের ভাঙা গেলাস তোমরা তুলে ধরো এখন, আর/ খুশি হও—”। ‘প্রার্থনা’ নামক এক কবিতার লাইন বলবে: ‘এবং যে খেতে পায় না তুমি তাকে পাঠিয়ে দিও প্লেটভর্তি খাবার...’ এর পাশাপাশি অন্য কবিতা বলবে: ‘আমি আবার জানাতে চাই, ছুটে আসছে যে ঝলমলে দিন/ সে শুধুই আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে/ যারা আইসক্রিমের জন্যে কাঁদে আর মার আঁচলে গিয়ে লুকোয়...’। বলবে: ‘মা সকল, তোমরা ভালো থেকো/ সিঁড়ির নিচে, হাসপাতালে, ভালো থেকো তোমরা...।’ সিঁড়ির নীচে কারা থাকে? যারা গৃহহারা। হাসপাতালে কারা থাকে? যারা অসুস্থ। সকলের জন্য আশীর্বাদ চেয়েছে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা। সে-কবিতা জানিয়েছে ‘আগুনের বৃষ্টি দিয়ে হেঁটে এসে আজ শান্ত যে আলো জ্বেলেছি/ প্রতি সাধারণ ঘরে প্রতিটি অন্ধকার ঘরে আমি পৌঁছে দিতে চাই।’ ভাস্করের কবিতা আমাদের সতর্ক করে দেয়: ‘শেকল শুধু লোহা দিয়েই তৈরি হয় না’। সে-কবিতা আমাদের জানায়: ‘এই তো পাশের বাড়ি থেকে/ মা অথবা ছোটোবোন আঁচলে লুকিয়ে চাল নিয়ে আসছে দ্রুত।’ জানায়: ‘পাশের বাড়ির ঝগড়া কলকাতার শাপশাপান্ত আর গালিগালাজ/ শেষ হবে না কোনোদিন?’
আমরা দেখি, কলকাতার গলি-উপগলির মধ্যে বেঁচে আছে যে নিম্নবিত্ত বাঙালিজীবন, তা কী অবিশ্বাস্য সততায় উঠে এসেছে ভাস্করের কবিতায়! স্নেহকাঙাল মন, তাদের দারিদ্র ও পারস্পরিক নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞানসমেত।
সম্প্রতি ভাস্করের দু’খণ্ড কবিতাসমগ্র নতুন করে প্রকাশিত হল, যেখানে ধরা আছে তাঁর সমগ্র কবিতাজীবন। এ-দু’টি সংগ্রহে পাচ্ছি ভাস্করের দশটি কবিতার বই— পাশাপাশি প্রতিটি কবিতার রচনাতারিখ, কোন পত্রিকায় কোন বছরে সে-সব কবিতা প্রকাশিত হয়েছে তার সম্পূর্ণ বিবরণ। পাচ্ছি, এ-কবির অগ্রন্থিত এমনকি অপ্রকাশিত ১১৮টি কবিতা। এই সমগ্রদ্বয় ধরে রেখেছে ভাস্কর অনূদিত সমস্ত কবিতা যা কখনও গ্রন্থবদ্ধ হয়নি। যেমন, পোল্যান্ডের তাদেউশ রুজেভিচ-এর একগুচ্ছ কবিতা। সেই সঙ্গে আধুনিক কন্নড় কবিতার অনুবাদসমূহ। রুজেভিচ বিষয়ে ভাস্কর লিখছেন: “রুজেভিচ আঙুল তুলেছিলেন। প্রথাবাহিত কবিতার থেকে যাবতীয় অলংকার, কবিত্বপূর্ণ কারিগরি, সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।...” এর এগারো বছর পর, ভাস্কর ২০০৪ সালে অ্যান্টি পোয়েট্রি আর রুজেভিচ প্রসঙ্গে বলছেন: “আমি জানি না আমি অ্যান্টি পোয়েট্রি কিছু লিখেছি কিনা... তবে আমার অ্যান্টি পোয়েট্রি পড়তে খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে রুজেভিচ।... পোল্যান্ডের ওই সময়টা... এইখান থেকে যে সব কবিরা উঠে এসেছে, একদিকে নাজী-রা... ওই সব কবিরা প্রায় বোমা থেকে সিগারেট ধরিয়েছে... এই একজন কবি (রুজেভিচ) যিনি সারাজীবন একটা কবিতাও ছন্দে লেখেননি।”
ভাস্করের ডায়েরি দিয়েই কথা শুরু করেছিলাম। ২২/৯/৮২-র একটি এন্ট্রি এই রকম: “যে-মানুষ অন্য একজন মানুষের পাশ থেকে মসৃণ ভাবে সরে যায়, পারমাণবিক পৃথিবীর বিরুদ্ধে তার কোনো কথা বলারই অধিকার নেই।” এই ডায়েরিগুলি, সাক্ষাৎকার-সহ, আমরা পেলাম সমগ্রদ্বয়ের সম্পাদক ও গ্রন্থপরিচয়কর্তা সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যসন্নিবেশে ও দূরদর্শিতায়। ভাস্কর, সুমন্তকে কিছু খাতাপত্র বিক্রি করতে দিয়েছিলেন। সুমন্ত সেখানে ভাস্করের ডায়েরি আবিষ্কার করে গোপনে জমিয়ে রেখে আজ আমাদের সামনে এনে দিলেন। ম্যাক্স ব্রডকে কাফকা নিজের লেখা পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন। ব্রড তা করেননি। সুমন্তর কারণে আমরা পেয়ে গেলাম ভাস্করের ডায়েরির এই কথাগুলিও: “যেন সাধারণ মানুষের দুঃখের সঙ্গে সারাজীবন জড়িয়ে থাকতে পারি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy