Advertisement
E-Paper

বাঁধাধরা ছকে ফেলা যায় না

এই বইয়ে গোড়া থেকেই লেখক একান্ত তথ্যনিষ্ঠ, এবং নিজের কোনও বিশ্লেষণ দিয়ে পাঠককে আক্রান্ত করা থেকে বিরত।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

আবির্ভাব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ০৮:২৪
Share
Save

‘বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি’— হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই বাক্য আজ প্রবাদের সমতুল্য। বাঙালির সেই বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া এক কৃতবিদ্য বঙ্গসন্তান অক্ষয়কুমার দত্ত। পঁয়ত্রিশ বছরের সুস্থ জীবনে অক্ষয়কুমার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তা করেছেন। এক দিকে শিক্ষা ও সমাজচিন্তা, অন্য দিকে ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও ভূগোল বিষয়ে চিন্তা করেছেন। যুক্ত থেকেছেন পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে। তিনি যখনই যে বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছেন, সেই বিষয়টিই যেন হয়ে উঠেছে তাঁর ধর্ম।

“বাঙালির অহং-বৌদ্ধিক অনুশীলনের মধ্যেই অক্ষয়-চর্চা থেমে থাকবে না, অক্ষয়-চর্চা পরিণতি লাভ করবে অক্ষয়-চর্যায়”— এই আশায়, আলোচ্য বইটি সূত্রধরের স্বল্পকথন ও অনুক্রমণিকা ছাড়া মূল পনেরোটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। অক্ষয়কুমার দত্তের প্রয়াণ-পরবর্তী সময়ে বাঙালি সমাজে তাঁর প্রভাব কেমন ছিল সেই ভাবনাবিন্দু থেকে বইটি শুরু হলেও, এই দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতেও লেখক আবার ধরিয়ে দিয়েছেন অক্ষয়কুমারের বাল্য ও কৈশোর। এর পর— অক্ষয়কুমারের সঙ্গে তৎকালীন চিন্তকদের বৌদ্ধিক আদান-প্রদান, পত্রালাপ, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার— সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অক্ষয়কুমার-কৃত পরিভাষা কোষ ও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, কবিতা ও প্রবন্ধের চর্চায় অক্ষয়কুমার দত্ত এবং এর পরে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, স্বজন ও বিভিন্ন পত্রিকার মূল্যায়নে অক্ষয়কুমার দত্ত— এই ভাবে অধ্যায়গুলি সজ্জিত।

বিস্মৃত অবিস্মৃত অক্ষয়কুমার দত্ত (দ্বিতীয় খণ্ড)

পীযূষকান্তি সরকার

৬০০.০০

কবিতিকা

এই বইয়ে গোড়া থেকেই লেখক একান্ত তথ্যনিষ্ঠ, এবং নিজের কোনও বিশ্লেষণ দিয়ে পাঠককে আক্রান্ত করা থেকে বিরত। ছোট ছোট মন্তব্যের জন্যও তিনি বিশিষ্টদের শরণাপন্ন। সে কারণে কখনও কখনও একটি পৃষ্ঠা পার হতে পাঠককে বারংবার ফিরে আসতে হয় গ্রন্থপঞ্জিতে। এই বইয়ের তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জি তাই বইটির অন্যতম সম্পদ হয়ে উঠেছে।

উনিশ শতক মোটামুটি দুই ধরনের যুক্তিতে আচ্ছন্ন ছিল। এক দিকে ছিল পাশ্চাত্য নবজাগরণের যুক্তি, অন্য দিকে প্রাচীন দর্শনশাস্ত্র ও ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তি। সম্ভবত, অক্ষয়কুমার দত্তকে এই দুইয়ের কোনওটাতেই খাপে খাপে বসিয়ে দেওয়া যায় না। অক্ষয়কুমার দত্তকে লেখক কখনও ‘আদর্শ বস্তুবাদী’, কখনও ‘বস্তুবাদী এবং বাস্তববাদী’ বলে অভিহিত করেছেন। এর জন্যও লেখক স্বপন বসুকে উল্লেখ করেছেন। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে দৃষ্টান্ত করে লেখক দেখাচ্ছেন— অক্ষয়কুমার ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হবেন, এইটিই স্বাভাবিক। যদিও অক্ষয়কুমারের নিজের রচনা সর্বদা সেই কথা বলে না।

‘মিত্রতা’ প্রবন্ধে অক্ষয়কুমার দত্ত লিখছেন, “ধর্ম্ম-ব্যতিরেকে রেখে আর কিছুই স্থায়ী নহে।” “প্রকৃত মিত্রের অকপট হৃদয় বিশ্বাস-রূপ পরম পদার্থের জন্ম ভূমি।” এই ‘পরম পদার্থ’, এক নিমেষেই আমাদের স্পিনোজ়ার দর্শন স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মর্তব্য যে, সে সময় শিক্ষিত বঙ্গসন্তানদের পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্য পাঠ কিং‌বা লেখায় তার উল্লেখ কোনও নতুন কথা নয়। অক্ষয়কুমারের নীতি ও ধর্ম বিষয়ক রচনাগুলিতে বার বার উঠে এসেছে ‘করুণাময় পরমেশ্বর’ ও তাঁর ‘মঙ্গলময় নিয়ম’-এর কথা। পাশাপাশি আছে ‘ভূত, প্রেত, পিশাচ ইত্যাদি অবাস্তবিক পদার্থ’ও।

এই বই অক্ষয়কুমার দত্তের মূল লেখা বিশ্লেষণের নিরিখে এই মহৎ জীবনকে মূল্যায়নের প্রচেষ্টা নয়। এই বই আসলে অক্ষয়কুমারের সময়কাল, তাঁর ব্যাপ্তি, সমাজ ও তৎকালীন মনীষার সঙ্গে তাঁর বিনিময়, এবং অক্ষয়-পরবর্তী চিন্তকদের ভাবনায় এক সার্থক অক্ষয়-পরিক্রমা।

নজরে

পাঁচ-ছ’বছর মোটে বয়স, কিন্তু মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ায় অভিনয়ে। এইটুকু বয়সেই রীতিমতো তারকা, নাটক শেষে তাকে ঘিরে সবাই উচ্ছ্বসিত, সে কোথাও এলে মা-বাবা ও শিশুদের ভিড় ভেঙে পড়ে, হাতে ফুল আর উপহার গুঁজে দিতে। লেয়া ডয়েচ, ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় সম্পদ, বিস্ময়প্রতিভা, লেখা হয় কাগজে।

১৯২৬-এ ক্রোয়েশিয়ার জ়াগ্রেবে জন্ম নেওয়া লেয়ার কথা ইউরোপ তবু জানে, আমরা জানি না। পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা মার্টিনা তাঁর কথা লিখেছেন, তাঁকে নিয়ে প্রদর্শনী করেছেন বার্লিনে। সেই লেখালিখি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন সুলগ্না মুখোপাধ্যায়। বইয়ের নামে আনা ফ্রাঙ্কের সঙ্গে তুলনায় যে আশঙ্কার মেঘ ঘনায়, তা-ই সত্যি হয়েছিল লেয়ার জীবনে— শিশুতারকার ‘জিনিয়াস’খ্যাতি ক্রোয়েশিয়ার ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল ‘উস্তাচে’র প্রকোপে অস্তমিত তো হয়েছিলই, জীবন দিয়েও চোকাতে হয়েছিল দাম। কারণ: ইহুদি পরিচয়।

লেয়া ডয়েচ: ক্রোয়েশিয়ার আনা ফ্রাঙ্ক মার্টিনা বিতুনাচ,

অনু: সুলগ্না মুখোপাধ্যায়

১৭৫.০০

ঋতবাক

অ্যামস্টারড্যামের আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি অমর করে রেখেছে তাকে। জ়াগ্রেবের লেয়া ডায়েরি লেখার সময় পায়নি, পনেরো বছরের ছোট্ট জীবনের দশ বছরই তো কেটেছে ব্যস্ততায়, অভিনয়ে। তারও কত বৈচিত্র: মলিয়ের থেকে শেক্সপিয়র, টলস্টয়; স্থানীয় রূপকথা, গীতিনাট্য! বাইরে যেখানেই গেছে, মন জিতেছে। রেডিয়োর অনুষ্ঠানে, অপেরাতেও।

এরই সমান্তরালে পাল্টে যাচ্ছিল দেশ। জার্মানির ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি পন্থী উস্তাচে আন্দোলনের শুরু ১৯৩০-এই, ১৯৪১-এর এপ্রিলে ক্রোয়েশিয়ায় ক্ষমতায় আসে তারা। শুরু হয় ইহুদি-পীড়ন। ইহুদিদের চাকরি ব্যবসা বন্ধ হয়, সংস্কৃতিচর্চাও। খুব চেষ্টা করেছিলেন লেয়ার বাবা-মা— প্রভাবশালীদের কাছে সুপারিশ করে, এমনকি লেয়াকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করেও। কাজ হয়নি। লেয়ার বাবা আত্মগোপন করেন এই ভেবে যে হয়তো শুধু ইহুদি পুরুষদেরই জীবনাশঙ্কা হবে, নারী ও শিশুদের নয়। ১৯৪৩-এর মে মাসে ১৬০০ ইহুদি গ্রেফতার হন; লেয়া, তার ভাই, মা-ও।

জ়াগ্রেবের ট্রানজ়িট ক্যাম্প, স্টেশন, রেল। গন্তব্য অউশভিৎজ়। লেয়াকে অবশ্য যেতে হয়নি সেখানে, দীর্ঘ যাত্রার ধকল সইতে না পেরে ট্রেনেই মৃত্যু। তার আর পর নেই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review Bengali Literature

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}