অজস্র সাদা পাতা পেরিয়ে পৌঁছতে হয় বইয়ের বিষয়বস্তুতে। ছবি: পিক্স্যাবে।
পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭৮। কিন্তু তার মধ্যে আড়াইশোরও বেশি পাতা সাদা। বাকি পৃষ্ঠায় সামান্য কিছু লেখা। এমন ভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য বুক অব দ্য বুক’ নামের বইটি। ১৯৬৯ সাল। লেখক ইদ্রিশ শাহের খ্যাতি তখন মধ্যগগনে। সেই সময়েই ব্রিটেনের অক্টাগন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় এই বই। রাজসিক চেহারার এই বই আকৃষ্ট করেছিল অনেক গ্রন্থপ্রেমীকেই। কিন্তু কেনার পরে তাঁদের বেশির ভাগই তাজ্জব হয়ে যান বইয়ের পাতা ওল্টাতে গিয়ে। পাতার পর পাতা সাদা। এমন এক গ্রন্থ প্রকাশে চমকে ওঠে প্রকাশনা জগৎও।
ইদ্রিশ শাহের নাম বর্তমান পাঠকসমাজে অচেনা লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু তাঁর এক অতুল কীর্তির সঙ্গে বিশ্বের গল্পপ্রেমীদের নিবিড় পরিচয়। ইদ্রিশ শাহই ইসলামি বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলির সংকলক।
১৯২৪ সালে ভারতের অভিজাত আফগান পরিবারে জন্ম ইদ্রিশের। মূলত সুফি দর্শনের লেখক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি গড়ে উঠলেও প্রাথমিক জীবনে তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল ম্যাজিক এবং ডাকিনীবিদ্যার মতো গুপ্ত বিষয়। এই সব বই প্রকাশের জন্য তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন প্রকাশন সংস্থা অক্টাগন প্রেস। তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ হল ‘দ্য সুফিজ’ নামে এক গ্রন্থ রচনা, যা সুফিবাদ বিষয়ে আকর হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। সুফিবাদ চর্চার অঙ্গ হিসেবেই তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ইসলামি বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন কাহিনি ও কিংবদন্তি।‘দ্য বুক অব দ্য বুক’ প্রকাশের সময়ইদ্রিশ পশ্চিমী জগতে বেশ পরিচিত। প্রাচ্যদেশীয় জাদুবিদ্যা এবং সুফি দরবেশদের জগৎ নিয়ে তাঁর কাজ আদৃত হচ্ছে ইওরোপ এবং আমেরিকায়। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর নতুন বই সাড়া জাগিয়েই প্রকাশিত হয়। কিন্তু বই কিনে পাতা ওল্টাতেই সবাই বিভ্রান্ত!
বইয়ের প্রথম সংস্করণে আখ্যাপত্র, আনুষঙ্গিক পাতাগুলি বাদ দিলে বাকি সব সাদা। একেবারে শেষের দিকে খান ১৫ পাতায় রয়েছে একটি কাহিনি। সেটুকুই বইয়ের সম্বল। কাহিনিটি খানিক এই প্রকার—প্রকৃত সত্যদ্রষ্টা এক দার্শনিক রাজা তাঁর প্রজাদের কী পদ্ধতিতে শিক্ষা দেবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এমন সময়ে তাঁর দরবারে এক ব্যক্তির আগমন ঘটে। আগন্তুক রাজাকে এক আশ্চর্য কেতাবের গল্প শোনান। সেই বই থেকে নাকি এক মহাজ্ঞানী মানুষ তাঁর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন। কিন্তু কখনই বইটি তাঁদের দেখতে দেননি। সেই মহাজ্ঞানীর মৃত্যুর পর শিষ্যরা বইটি খুলে দেখে, বইয়ে পাতার পর পাতা সাদা। একটি মাত্র পাতায় লেখা রয়েছে, ‘তুমি যদি সত্যিই জ্ঞানার্জন করতে চাও তা হলে তোমায় পাত্র ও তার ভিতরে রাখা বস্তুর পার্থক্য বুঝতে হবে।’ শিষ্যরা এই কথার প্রকৃত মর্ম বুঝতে না পেরে বিভিন্ন জ্ঞানী মানুষের কাছে যান। জ্ঞানীরা প্রত্যেকেই এর অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হন। তখন এক দরবেশ তাঁদের জানান, এই কেতাবের পুরোটাই একটা শিক্ষণীয় বিষয়। কোনও বস্তুকে তার আধার দেখে বিচার করা উচিত নয়। এর পরে সেই বই অনেক হাত ঘুরে হারিয়ে যায়। তাকে স্মৃতি থেকে সংকলিত করেন মালি নামের এক সুফি দার্শনিক। তিনি অজস্র সাদা পাতার মধ্যে এই বইয়ের ইতিহাস আর তাতে কথিত সেই বাক্যটুকুই রাখেন।
এই বই আসলে সুফি দর্শনের অন্তঃস্থলে থাকা এক সহজ বক্তব্য— কোনও কিছুর আবরণ বা আচ্ছাদন দেখে অন্তর্বস্তুকে আন্দাজ করা কখনও উচিত নয়। বইটির নির্মাণ এবং তাতে লেখা ১৫ পাতার কাহিনি সেই কথাই বলে। বইয়ের নামপত্রে উল্লিখিত ছিল এক প্রবাদ, যার অর্থ— বাসস্থানের মূল্য তার বাসিন্দার দ্বারাই নির্ধারিত হয়। বইয়ের ভূমিকা হিসেবে লিখিত ছিল ঈশপের একটি নীতিকাহিনি। এক সিংহীকে অরণ্যের অন্য পশুরা প্রশ্ন করে, সে এক সঙ্গে ক’টি শাবকের জন্ম দেয়। সিংহীর উত্তর ছিল— একটিই।কিন্তু সেটি সিংহশাবক। ইদ্রিশ বইটির নাম দেন ‘দ্য বুক অব দ্য বুক’ এবং ঈশপের এই গল্প বলে যেন জানিয়ে দেন, এই বই ‘সকল দেখার শ্রেষ্ঠ’। ইদ্রিশের সেই বই পড়ে চটে যান অনেকে। পারসিক সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ পণ্ডিত লরেন্স পল এলওয়েল-সাটন ইদ্রিশের কাজকে ‘ভাঁড়ামি’ বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু এলওয়েল-সাটনের সেই মন্তব্যকে আক্রমণ করেন ২০০৭-এ সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্ত ব্রিটিশ–রোডেশিয়ান লেখিকা ডরিস মে লেসিং। তাঁর বক্তব্য ছিল, এলওয়েল-সাটন এই বইয়ের কিছুই বোঝেননি। তাঁকে ‘শিক্ষিত’ বলতেও নাকি তাঁর দ্বিধা হয়।
কিন্তু এই কাহিনিই যখন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পে উঠে আসে অন্য চেহারায়, তখন তাকে কেউ ‘ভাঁড়ামি’ হিসেবে দেখেননি। গল্পটি এই—হামামে মোল্লা গিয়েছেন স্নান করতে। তাঁর দীনহীন পোশাক দেখে হামামের কর্মচারী তাঁকে একটা ছেঁড়া গামছা ও এক টুকরো সাবান ছুড়ে দিল। স্নান সেরে মোল্লা সেই কর্মচারীকে মোটা বকশিস দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পর দিন আবার ভাল পোশাক পরে মোল্লা হামামে গেলেন। সেই কর্মচারী এ বার বিস্তর সুগন্ধী, আতর-টাতর ঢেলে মনপ্রাণ দিয়ে তাঁর সেবা করল। স্নান সেরে মোল্লা তার দিকে একটা তামার পয়সা ছুড়ে দিলেন। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে মোল্লার দিকে তাকানোয় মোল্লা তাকে জানালেন, এই বখশিস গত দিনের জন্য। সেদিনের বখশিস তিনি গত দিনই দিয়ে দিয়েছেন। আফগান লেখক ইদ্রিশ বিরচিত মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একাধিক গল্পে ছড়িয়ে আছে এই দর্শনধারীকে দেখে গুণবিচারের বিভ্রান্তির শিক্ষা।
এই সব কাহিনির শিকড় সুদূর অতীতে। প্রায় সব দেশের সংস্কৃতিতেই রয়েছে এমন কাহিনি। কিন্তু ইদ্রিশ এই রূপক কাহিনিকে মানুষের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন ‘বই’-এর আকারে। তার সাদা পাতাগুলিও বইটিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনও অক্ষর না থাকলেও তারা কথা বলে পাঠকের কানে কানে। ইদ্রিশ শাহ মারা যান ১৯৯৬ সালে। রেখে গিয়েছেন স্বনামে এবং ‘আরকন দারাউল’ ছদ্মনামে লিখিত বহু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর সংকলিত মোল্লা নাসিরুদ্দিন এখনও আনন্দ দিয়ে চলেছে আবিশ্ব পাঠককে। কিন্তু ‘দ্য বুক অব দ্য বুক’ থেকে গিয়েছে গ্রন্থ-ভাবুকদের কাছে এক বিস্ময় হিসেবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy