Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

অসহিষ্ণু সময়ের উত্তর

ভোর। সানাইয়ে ভৈরবী বাজছে, চার পাশের অন্ধকারের জরায়ু ছিঁড়ে। কে বাজান? বিসমিল্লা খান। এমন আশ্চর্য মোহিনী সুর আর কে উত্থিত করতে পারেন নাভিপদ্ম থেকে? মনে হল সমস্ত ঘুমন্ত ফুলের উন্মিলীয়মান কুঁড়িতে লেগেছে রাগিণীর লাল আভা।

বিভোর: উস্তাদ বিসমিল্লা খান গান গাইছেন। গৌতম ঘোষের তথ্যচিত্রের শুটিংয়ের সময় সঞ্জিৎ চৌধুরীর তোলা ছবি। বই থেকে

বিভোর: উস্তাদ বিসমিল্লা খান গান গাইছেন। গৌতম ঘোষের তথ্যচিত্রের শুটিংয়ের সময় সঞ্জিৎ চৌধুরীর তোলা ছবি। বই থেকে

চিন্ময় গুহ
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

গৌতম ঘোষের বিসমিল্লা ও বানারস

লেখক: গৌতম ঘোষ, শিলাদিত্য সেন, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়

১২০০.০০

প্রতিক্ষণ

ভোর। সানাইয়ে ভৈরবী বাজছে, চার পাশের অন্ধকারের জরায়ু ছিঁড়ে। কে বাজান? বিসমিল্লা খান। এমন আশ্চর্য মোহিনী সুর আর কে উত্থিত করতে পারেন নাভিপদ্ম থেকে? মনে হল সমস্ত ঘুমন্ত ফুলের উন্মিলীয়মান কুঁড়িতে লেগেছে রাগিণীর লাল আভা।

বিসমিল্লার শতবর্ষে অস্বাভাবিক নীরবতা—যাকে cultural amnesia বলব— পার হয়ে এক মায়াবী সুরমূর্ছনা আজ আমাদের আবিষ্ট করে দিচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, বারাণসীর গঙ্গার শ্বাসরোধকারী দৃশ্যমালা। নৌকো, জলের ওপর সাদাকালো আর রঙের খেলা। ছবি যেন কথা বলে উঠছে, আবহমানকে ছুঁয়ে।

মনে পড়বে, তরুণ সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ ছবিতে বারাণসীর অবিস্মরণীয় রূপগন্ধময় চিত্রপটের কথা। যেমন, ভোরবেলা মৃত্যুপথযাত্রী হরিহরের জন্য গঙ্গাজল আনতে গিয়ে নির্জন ঘাটে অপুর দেখা একটি লোকের ব্যায়ামের দৃশ্য। একটি শহর তার আবহমানতা নিয়ে চলচ্চিত্রের পরদায় এমন ভাবে উন্মোচিত হয়েছে কি কখনও? এক কিংবদন্তি সানাইবাদকের সাধনাকে ক্যামেরায় স্পর্শ করতে গিয়ে গৌতম ঘোষ বারাণসী ও বিসমিল্লাকে নিয়ে যে তথ্যচিত্র করেন (১৯৮৯), তাতেও সেই সুর ও মায়া ছিল। শিল্পীর জন্মশতবর্ষে সেটি এক অভিনব অ্যালবামে পুনর্জীবন পেল। চলচ্চিত্র, স্থিরচিত্র আর লিপির মাধ্যমে বাংলা ও ইংরেজিতে এ এক ত্রৈভাষিক পুষ্পার্ঘ। তিনটি সুর তুলিতটে মিশে গিয়ে যেন এক পা তুলে নাচের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে।

এই বইয়ে সন্নিহিত হয়েছে শ্বাসরোধকারী কিছু স্থিরচিত্র, যার অনেকগুলিই তথ্যচিত্রে ব্যবহৃত হয়নি। ছবিগুলি এখানে ফিরে এসেছে চলচ্চিত্রের গতিময়তা নিয়ে। সাদাকালো ছবিতে গানের সুরের মতো আলোছায়ার খেলা এক নান্দনিক স্তরে পৌঁছয়। সঞ্জিৎ চৌধুরীর তোলা সাদাকালো আর রঞ্জন ঘোষের রঙিন ছবিতে এসেছে চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসের ঘনত্ব ও সুষমা। সঙ্গে জেমস প্রিন্সেপের ছবিতে উনিশ শতকের বারাণসী। বিসমিল্লাকে নিবেদিত তথ্যচিত্রকে ঘিরে তিনটি অক্ষরচিত্র: গৌতম ঘোষ, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় আর শিলাদিত্য সেনের।

প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে বিসমিল্লা মেঝেয় বসে আছেন, তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন গৌতম ঘোষ। সেটির চিত্রগ্রহণ তত ভাল নয়। বরঞ্চ ভিতর-মলাটে সানাই হাতে বিসমিল্লার ছবি, কিংবা গঙ্গার ঘাটে বিসমিল্লা প্রচ্ছদে হয়তো বেশি উপযোগী হত। অথবা তেমন কোনও ছবি যেখানে বিসমিল্লা সানাইয়ে বিভোর।

ভারতরত্ন ও পদ্মবিভূষণ, সংগীত নাটক অকাদেমি ও তানসেন সম্মানে অলংকৃত উস্তাদ বিসমিল্লা খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও এম এস শুভলক্ষ্মীর পর তৃতীয় ভারতরত্ন। ১৯১৬ সালে আমিরুদ্দিন খানের জন্মের সময় তাঁর ঠাকুরদা ‘বিসমিল্লা’ বলে উঠেছিলেন বলে তাঁর নাম হয় বিসমিল্লা। বাবা ছিলেন ভোজপুরের রাজার ডুমরাও প্রাসাদে সভাসংগীতকার। ঠাকুরদা ও তাঁর পিতাও ছিলেন সেখানকার সংগীতকার। সানাইয়ের মতো একটি লোকশিল্পে প্রচলিত ‘সাধারণ’ যন্ত্রকে মার্গসংগীতের স্তরে উন্নীত করে পূর্ণ অবয়ব প্রদানে উস্তাদ বিসমিল্লার একক অবদান সর্বজনস্বীকৃত। সানাই আর বিসমিল্লা হয়ে উঠল সমার্থক।

শুরুতেই তাঁর আশীর্বাদ বা দোয়া প্রার্থনা করছেন গৌতম ঘোষ। প্রতিবারই বিসমিল্লা দর্শনে গিয়ে তাঁর মনে পড়েছে লালনের গানের কলি: ‘সত্য বল সুপথে চল ও রে আমার মন/ সত্য সুপথ না চিনিলে পাবি না মানুষের দরশন।’ নিজের বাগানে অসংখ্য ফুল ফুটিয়ে বিসমিল্লা বেরিয়ে পড়েন অন্য বাগানের সুন্দর সব নতুন ফুলের সন্ধানে। ক্যামেরার সামনে কিরানা, আগরা, ডাগর, বানারসি প্রভৃতি গায়কি অঙ্গে একই রাগ বিভিন্ন ঘরানায় কী ভাবে পরিবেশিত হয় গেয়ে দেখান তিনি। বিসমিল্লার ভাষায়, ‘বিভিন্ন ঘরানা থেকে ফুল তুলে এনে আমার সানাইয়ে ভরে দিলাম। তৈরি হল গুলদস্তা।’

শিলাদিত্য সেন তাঁর ধারাভাষ্য শুরু করেছেন ১৯৮৯ সালে নন্দনে ‘মিটিং আ মাইলস্টোন: উস্তাদ বিসমিল্লা খান’ দেখে সত্যজিৎ রায়ের বিস্ময়োক্তি দিয়ে: ‘অসাধারণ সানাইবাদক, আবার এত সুন্দর কথা বলেন, এ তো আমার ধারণাই ছিল না।’ বাক্য শেষ না করে ‘অ্যামেজিং’ কথাটা ব্যবহার করেন সত্যজিৎ। গৌতম তাঁর স্মৃতিচারণে কাশীতে উস্তাদজির ছ’বছর বয়স থেকে দীর্ঘ বসবাস, জীবনযাপন মেলে ধরছেন। ভৈরবী আর আজানের সুরকে মিলিয়ে দিচ্ছিলেন বিসমিল্লা। ‘লোকে বলে বিসমিল্লার ফুঁ, বিসমিল্লার আঙুল... এর কোনও তুলনা নেই। আমি তাদের বলি, আমি কে? আমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁরই তো তারিফ হওয়া উচিত।’ রাধাকৃষ্ণের লীলা পরিবেশন করতে করতে বলতেন, ‘বাজাতে বাজাতে মনটা আমার বৃন্দাবনে চলে যায়।’ সংগীত আর পারফরমেন্স থাকে না, হয়ে ওঠে মানবদর্শন।

সত্যজিৎ ঠিক ধরেছেন, বিসমিল্লার কথার জাদু কম মোহিনী নয়। তিনি বলেন, ‘বানারস, যেখানে রস তৈরি হয়, যেখানে বানতা হ্যায় রস।’ বাইজিদের ডালমন্ডি গলি দিয়ে হাঁটার সময় সংগীতের রেশে ‘কান দুটো পবিত্র হয়ে যেত।’ কথা বলছেন রাগরাগিণীর ঘরানা, পরম্পরা আর বিবর্তন নিয়ে। বারাণসীর গঙ্গা, মন্দির, মসজিদ, পূজাপাঠ, কীর্তন নিয়ে। সকালে পবিত্র গঙ্গায় স্নান করতেন, তার পর মসজিদে নামাজ পড়তেন, আর সারাটা দিন বালাজি মন্দিরে গিয়ে সানাই বাজাতেন। ‘এর চেয়ে আনন্দের জীবন কী হতে পারে বলো!’ ‘আমরা তো ছোটবেলা থেকে রাধাকৃষ্ণের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, চিরকাল মনে করে এসেছি রাধাকৃষ্ণ আমাদেরই মধ্যেকার মানুষজন।’ তাই আবহমান বারাণসীর শিকড়ে প্রোথিত মানুষটি আমেরিকা বসবাসের আমন্ত্রণ হেলায় প্রত্যাখ্যান করেন।

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় গৌতম ঘোষের ছবিটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। বিসমিল্লা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, শৈশবে যখন মার্বেল খেলতেন, তখনও তা তালে ফেলেছেন, মজেছেন সুরে। ‘ঘর’ বলতে বিসমিল্লা বাড়িঘরের কথা বলছেন না, বলছেন এক চেতনার কথা। ছবির চমকপ্রদ একটি দৃশ্য বারাণসীর মহরম। ‘ওই একটা দিন আমি রাস্তায় বেরিয়ে কোনও রাগ বাজাই না, বাজাই বিলাতগীতি নৌহা।’

‘সুর মে হ্যায় সব।’ এ এক সহিষ্ণু ভারতবর্ষের সমন্বয়ের আবহমান ছবি, যে ভারত আছে, কিন্তু যাকে আমরা খুঁজে দেখছি না। শিলাদিত্য যেমন লিখেছেন, এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে এটি শিল্পের ভেতর দিয়ে প্রকৃত ভারতীয়তার ঐতিহ্য-চিহ্নগুলিকে চিনে নেওয়ার প্রচেষ্টা। এই বই যেন আজকের ক্ষোভিত সময়ের উত্তর।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE