দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। জোরালো হচ্ছিল জল্পনা। শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনে নিজেদের ব্যবসা বিক্রির পরিকল্পনার কথা জানাল টাটা স্টিল।
মুম্বইয়ে সদর দফতর বম্বে হাউসে সংস্থার পরিচালন পর্ষদের ম্যারাথন বৈঠকের পরে এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছে টাটা স্টিল। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইস্পাত বহুজাতিকটির দাবি, তলানিতে ঠেকা দাম, চড়া উৎপাদন খরচ আর সস্তার চিনা পণ্যের দাপটে ব্রিটেনের মাটিতে আর্থিক ফল ভাল করা যাচ্ছে না কিছুতেই। অদূর ভবিষ্যতেও সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। সেই কারণেই ব্রিটেনে ব্যবসা ঢেলে সাজার সমস্ত রাস্তা খতিয়ে দেখছে তারা। যার মধ্যে রয়েছে ওই দেশে ব্যবসা পুরোপুরি বেচে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনাও।
রানির দেশে টাটা স্টিলের কর্মী সংখ্যা অন্তত ১৫ হাজার। এর মধ্যে চার হাজার শুধু ওয়েলসের পোর্ট ট্যালবট কারখানাতেই। ভারতীয় বহুজাতিকটির এই ঘোষণায় প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে তাঁরা। যে কারণে ব্রিটিশ সরকারকে অবিলম্বে অবস্থা সামাল দিতে আর্জি জানিয়েছে কর্মী সংগঠনগুলি। ডেভিড ক্যামেরনের সরকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, প্রয়োজনে সাময়িক ভাবে কারখানা কিনে নেওয়ার। যাতে ধীরে-সুস্থে নতুন ক্রেতার খোঁজ করা যায়।
বিশ্বে ব্রিটেনই ইস্পাত শিল্পের আঁতুড় ঘর। সমস্যা জর্জরিত ইউরোপে যে-ক’টি দেশের অর্থনীতি তুলনায় ভাল, তার মধ্যে তারাও আছে। তা হলে পাততাড়ি গোটানোর সিদ্ধান্ত কেন?
উত্তর স্পষ্ট সারা দুনিয়ার ইস্পাত শিল্পের দিকে চোখ বোলালেই। বিশ্ব বাজারে তেলের মতো ইস্পাতের চাহিদাও তলানিতে। অথচ উপচে পড়ছে জোগান। ফলে ইস্পাতের দর অনেকখানি নেমে গিয়েছে। ইংল্যান্ডও ব্যতিক্রম নয়। তার উপর চিনের বাজারে তেমন চাহিদা না-থাকায়, সারা দুনিয়ায় ইস্পাত বাজার ছেয়ে গিয়েছে চিনা সংস্থার সস্তা পণ্যে। সমস্যার এই ছবি ব্রিটেনে জেরবার করেছে টাটা স্টিলকেও।
দু’বছর আগে যেখানে ব্রিটেনে ৩.৬১ লক্ষ টন চিনা ইস্পাত আমদানি হত, সেখানে ২০১৫-এ তা দাঁড়িয়েছে ৮.২৬ লক্ষ টন। ফল বিপুল লোকসান। পোর্ট ট্যালবটেই দৈনিক ক্ষতি ১০ লক্ষ পাউন্ড (৯.৬০ কোটি টাকা)।
তার উপর সংস্থার দাবি, ব্রিটেনে উৎপাদন খরচ যথেষ্ট চড়া। ব্রিটেনে ইস্পাত সংস্থাগুলিকে কয়লা-সহ জ্বালানির খরচ গুনতে হয় চড়া হারে। দিতে হয় পরিবেশ-করও। এত বেশি খরচে তৈরি ইস্পাত বিশ্ব বাজারে বিক্রি করা শক্ত হচ্ছে তাদের পক্ষে। যে-কারণে ব্রিটেনে টাটা স্টিলের ব্যবসা কিনতে আদৌ কে আগ্রহী হবেন, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।
বিশেষজ্ঞদের অনেকে আবার বলছেন, ব্রিটেনে ইস্পাত শিল্পে পা রাখার পর থেকেই সমস্যায় টাটা স্টিল। ২০০৮-এর বেজিং অলিম্পিকের আগে চিন জুড়ে ঢেলে সাজা হয়েছিল পরিকাঠামো। আকাশ ছুঁয়েছিল ইস্পাতের চাহিদা। দামও বেড়েছিল তাল মিলিয়ে। সে সময়ে ২০০৭-এ ১,৪০০ কোটি ডলারে অ্যাংলো-ডাচ ইস্পাত সংস্থা কোরাসকে কিনেছিল টাটারা। এখনও পর্যন্ত যা কোনও ভারতীয় সংস্থার বৃহত্তম বিদেশি অধিগ্রহণ। সেই সূত্রেই তাদের ব্রিটিশ ইস্পাত বাজারে পা রাখা। কিন্তু চিনে অলিম্পিক মিটে যাওয়ার পরে সেই চাহিদা আর ফেরেনি। প্রথমে বিশ্বজোড়া মন্দার প্রভাব আর তারপরে এখন চিনা অর্থনীতির ঝিমিয়ে পড়া— এই লাগাতার আক্রমণে ধুঁকছে ইস্পাত সংস্থাগুলি। বিশ্বের অর্ধেক ইস্পাতই তৈরি হয় চিনে। ফলে নিজেদের চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন সস্তায় তা সর্বত্র রফতানি করছে তারা। যার ফল ভুগতে হচ্ছে টাটা স্টিলকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy