আমাদের ছোট বেলায় বড়দিনের এত চল ছিল না। কিন্তু তা-ও সান্তার কাছে উপহার অনেক বারই চেয়েছি। ক্রিসমাসের দিন মাথার কাছে রাখা উপহার খোলার যে আনন্দ কতটা, সেটাও অজানা নয়। যত বড় হয়েছি, বুঝতে পেরেছি বাস্তবে বাবা-মায়েরাই আমাদের সান্তাক্লজ। ঠিক যে ভাবে বড়দিনের আগের রাতে মাথার কাছে গিফ্ট রেখে যান সান্তা, সে ভাবেই জন্মের মুহূর্ত থেকেই বাবা-মা আমাদের জন্য তিল তিল করে গড়ে তোলেন আর্থিক উপহারের ঝুলি। অল্প অল্প করে সঞ্চয় করেই সুরক্ষিত করেন পরিবারের ভবিষ্যৎ।
বড় হয়ে তাঁদের মতো আমাদেরও চেষ্টা থাকে পরিবারের সান্তা হয়ে ওঠার। তার সঙ্গেই ছোটবেলার মতো বড়দিনে নিজের জন্য অল্প-বিস্তর উপহার পাওয়ার ইচ্ছেটুকুও রয়ে যায় মনের কোনায়। সেই ইচ্ছে কী ভাবে পূরণ হবে, তা নিয়েই আজকের গল্প।
উপহার দিন বিমা
আমরা প্রত্যেকেই চাই, পরিবারের সকলে যাতে সুখে-শান্তিতে থাকেন। সে জন্য পরিশ্রমও কম করি না। কিন্তু সংসারের রোজগেরে মানুষটির যদি কিছু হয়, তা হলে বাকিদের পক্ষে সব দিক সামলানো মুশকিল। তাই বড়দিনে পরিবারের জন্য সবচেয়ে ভাল উপহার হল, নিজের জন্য বড় অঙ্কের জীবন বিমা করা। যাতে আপনার কিছু হলে, বাকিরা অন্তত আর্থিক দিক থেকে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আর এ জন্য সবচেয়ে ভাল উপায় টার্ম পলিসি। তার সঙ্গে অবশ্যই নিতে হবে ক্রিটিকাল ইলনেস এবং অ্যাক্সিডেন্ট রাইডার। যদি পরিবারের সে রকম দায়িত্ব নিতে না-হয়, তা হলে অবশ্য এই উপহার ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখতে পারেন।
দুঃখেও স্বস্তি
শুধু সুখে থাকলেই চলবে না। শরীরটাও ঠিক রাখতে হবে। যাতে সেই সুখ উপভোগ করা যায়। তাই পরিবারের জন্য সান্তার কাছে অবশ্যই চাইতে হবে স্বাস্থ্য বিমার উপহারও। কারণ, যে ভাবে চিকিৎসার খরচ বাড়ছে, তাতে নিজের পকেট থেকে তা মেটানো প্রায় অসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের পক্ষে। তাই চাকরিতে ঢোকার পরেই ভাবুন পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য বিমা করার কথা।
সময়ে ঝুলি ভরুন
বড়দিনে সারা পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের গিফ্ট দেন সান্তাক্লজ। দেখতে গেলে বছরে এক দিন। কিন্তু তার প্রস্তুতি চলে সারা বছর ধরেই। উপহার তৈরি করা থেকে শুরু করে প্যাকেবন্দি করা, ঠিকানা লেখা, সবই চলে ঘড়ির কাঁটা মেনে। ঠিক সে ভাবেই তৈরি হতে হবে আমাদেরও। কারণ, অবসর নেওয়ার আগেই যদি তহবিল তৈরি করে ফেলা যায়, তা হলে চাকরি শেষের মুখে এসে চাপে পড়তে হয় না। একটা উদাহরণ দিই—
চাকরিতে ঢোকার পরেই ২৫ বছর বয়সে যদি কেউ মাসে ৫,০০০ টাকা ইকুইটি ফান্ডে টাকা রাখা শুরু করেন, তা হলে ৩০ বছর ধরে সঞ্চয়ের পরে তাঁর হাতে আসবে প্রায় ১.৭৬ কোটি টাকা (১২% রিটার্ন ধরে)।
কিন্তু ওই ব্যক্তিই যদি ৩৫ বছর বয়সে গিয়ে মাসে ১৫,০০০ টাকা করে রাখতে শুরু করেন, তা হলে একই রিটার্ন ধরে ২০ বছর পরে গিয়ে তহবিল হবে ১.৫০ কোটি টাকার।
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে অবসরের মুখেগিয়ে একই বয়সে দু’জনের তহবিলের তফাৎ হয়ে যাচ্ছে ২৬ লক্ষের।
তাই বেশি টাকা না-থাকলেও, সময় হাতে নিয়ে অল্প অল্প করে লগ্নি শুরু করলে লাভ আপনারই। তবে এখানে শুধু ইকুইটি ফান্ডের উদাহরণ দিয়েছি বলে ভাববেন না যে, এটাই লগ্নির একমাত্র উপায়। বরং আপনার ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বুঝে লগ্নি ছড়াতে হবে। এ জন্য কথা বলতে পারেন বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও।
সন্তানের সান্তা
বড়দিনে শীতের আমেজ গায়ে মেখে পিকনিক আর চিড়িয়াখানা! চোখের সামনে ঘুরতে থাকা জীবজন্তু দেখে বিস্ময়ে বাচ্চাদের হাজারো প্রশ্ন। আর সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব বাবা-মায়েদেরই। সন্তানের ভালর জন্য তাঁদের চিন্তার শেষ থাকে না। কী ভাবে আরও একটু ভাল স্কুলে দেবেন, উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করবেন, ছেলে-মেয়ে বড় হলে বিয়ে দেবেন— এ সব কথাই প্রতিনিয়ত ভাবেন তাঁরা। এখানে আলোচনা করব, কী ভাবে বাচ্চাদের সান্তা হয়ে উঠতে পারেন বাবা-মায়েরা।
প্রথমে কথা বলি পড়াশোনা নিয়ে। উচ্চশিক্ষার খরচ যে ভাবে বাড়ছে,তাতে সন্তান জন্মের পরেই এ জন্য সঞ্চয় না-করে উপায় নেই। পাশের সারণি দেখুন। এখানে একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি কী ভাবে সেই তহবিল তৈরি করা যায়।
উচ্চশিক্ষার পরেও লগ্নি থামালে চলবে না। বরং পারলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই খাতে লগ্নি বাড়াতে হবে। যা দিয়ে তৈরি হবে বিয়ের তহবিল। পিপিএফে সুদ কমছে, তাই তার বদলে একটু ঝুঁকি নিয়ে সেই ২,০০০ টাকাও ইকুইটি ফান্ডে রাখতে পারেন, তা হলে তহবিল জমবে আরও বেশি।
ছাদ ও চাকার খোঁজ
সকলেই চান আর একটু বেশি ভাল থাকতে। সে জন্য মাথার উপর নিজের ছাদ বা গাড়ির জন্য প্রার্থনাও করি আমরা। তবে প্রত্যেকের পক্ষে তো আর নগদে গাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়! তাই এ জন্য ব্যাঙ্কের দরজায় কড়া নাড়ি। কিন্তু ঋণ পাচ্ছি বলেই বেশি ধার নেব, সেটাও কাজের কথা নয়। কারণ ফ্ল্যাট-গাড়ি কিনতে গিয়ে অন্যান্য লগ্নিতে ক্ষতি না-হয়, তা দেখতে হবে। তাই প্রথমে নগদ ও ঋণের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা জরুরি। আর সে জন্য জমাতে হবে ডাউনপেমেন্টের টাকা।
সাধারণত বলা হয়, ফ্ল্যাট কিনতে চাইলে ৩৫-৪০ বছর বয়সকে লক্ষ্য করে এগোন উচিত। কিন্তু তার প্রস্তুতি শুরু হবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই। অনেক ব্যাঙ্কই ২০-৩০ বছরের জন্য ঋণ দেয়। এতে কিস্তির অঙ্ক কমে ঠিকই, কিন্তু বাড়তি খরচ হয় সুদে। তাই ১০-১৫ বছরের মধ্যে ঋণ শোধের লক্ষ্য নিয়ে এগোন। আর গাড়ির জন্যও চেষ্টা করুন যতটা সম্ভব কম টাকার ঋণ নিতে।
ছোট্ট ছোট্ট পায়ে
ইকুইটি ফান্ডে মাসে লগ্নি ২,০০০ টাকা। ১৮ বছর পরে গিয়ে দাঁড়াবে ১৫ লক্ষে (১২% রিটার্ন ধরে)। ডেট ফান্ড বা পিপিএফে মাসে জমা ২,০০০ টাকা। ৮% রিটার্ন ধরলে ওই সময়ে তা হবে প্রায় ৯ লক্ষ। সব মিলিয়ে ১৮ বছর পরে হাতে আসবে ২৪ লক্ষ টাকা। উচ্চশিক্ষার খরচ মেটাতে তা যথেষ্ট।
চলুন বেড়িয়ে আসি
ঘুরতে যেতে কে না চায়? শীতের রোদ গায়ে মেখে সারা বছরের ক্লান্তি কাটিয়ে নেওয়ার সেরা সুযোগ হল বড়দিন থেকে নতুন বছরের শুরুর সময়টা। যে কারণে এর দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকি আমরা। কিন্তু পকেটে রেস্ত না-থাকলে, শুধু স্বপ্ন দেখাই সার। তাই সে জন্য শুরু থেকেই তৈরি করুন তহবিল। কী ভাবে? চলুন দেখি—
কেউ বছরে একটু বেশি দিনের জন্য এক বার ঘুরতে যান। আবার অনেকের পছন্দ কম দিনের জন্য কিন্তু একাধিক বার বেড়ানো। যখনই ঘুরতে যাবেন বলে ঠিক করছেন, তার আগে
থেকে তৈরি করুন পরিকল্পনা। শুধু কোথায় যাবেন, কী কী দেখবেন— তা দেখলেই হবে না। বরং প্রতি ক্ষেত্রে কত খরচ হবে, তার হিসেব করতে হবে। যার মধ্যে থাকবে যাতায়াত, হোটেল ও বেড়াতে গিয়ে গাড়ি ভাড়া, খাওয়া, কেনাকাটা, ট্রাভেল বিমা, আপৎকালীন টাকাও। মোট যা দাঁড়াবে, তাকে ১২ দিয়ে ভাগ করুন।
যেমন, ঘুরতে গেলে যদি ৩০,০০০ টাকা খরচ হবে বলে মনে করেন, তা হলে ১২ দিয়ে ভাগ করলে দাঁড়াবে ২,৫০০ টাকা। অর্থাৎ, কমপক্ষে ওই আড়াই হাজার টাকা আপনাকে প্রতি মাসে জমাতে হবে।
এই টাকা আপনি রাখতে পারেন রেকারিং ডিপোজিট বা ডেট ফান্ডে। যেখানেই টাকাই রাখুন না-কেন, দেখবেন ঘুরতে যাওয়ার দু’মাস আগে যেন তা হাতে আসে। কারণ, আগে থেকে ট্রেন বা প্লেনের টিকিট কাটলে, তুলনায় কমে পাওয়া যায়। ফলে সেখানেও সঞ্চয়ের রাস্তা থাকছে। তবে হ্যাঁ, প্রথম বার টিকিট কাটতে একটু কষ্ট করতে হবে। কিন্তু পরের বার থেকে দেখবেন জমা টাকা দিয়েই খরচ উঠে আসছে।
চেষ্টা করবেন, এক বার বেড়াতে গিয়েই যাতে রেকারিং বা ডেট ফান্ড পুরোপুরি বন্ধ না-হয়। সে ক্ষেত্রে জমে থাকা টাকার উপরেও লাভ করতে পারবেন। যা আগামী দিনে আপনার অল্প পুঁজিকেই বাড়াতে সাহায্য করবে। ফলে পরবর্তী কালে একটু বেশি দিন ঘুরতে যেতেও বাধা থাকবে না।
অতএব...
প্রার্থনা, উপহার চাওয়া তো থাকবে। এ বার চলে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রতি বছর বড়দিনও ফিরে ফিরে আসবে। কিন্তু এখন থেকেই তৈরি না-হলে, পরের বছর গিয়ে দেখবেন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন আপনি। তখন হাত কামড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই পরিবারকে উপহার দিতে কোমর বাঁধুন। পরের বারের আগেই অল্প-অল্প করে টাকা জমান। হয়ে উঠুন সান্তাক্লজ। নতুন বছরে সেই ইচ্ছে পূরণের শুভেচ্ছা রইল।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
পাঠকের প্রশ্ন?
প্রঃ একটি মিউচুয়াল ফান্ডের রিটার্ন ও ডিভিডেন্ড কি করযোগ্য? যদি হয়, তবে বছরে ডিভিডেন্ডে কি মূল্যবৃদ্ধি সূচক প্রয়োগ করে কর দিতে হবে? আমি ১০ লক্ষ টাকা একটি গ্রোথ ফান্ডে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে লগ্নি করেছি। সে ক্ষেত্রে কী হবে?
বেণীমাধব নন্দী, দুর্গাপুর
মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নি থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ডের উপর কর ধার্য হয় না। তবে মনে রাখবেন, ঋণপত্র নির্ভর (ডেট) ফান্ডের ক্ষেত্রে ডিভিডেন্ড দেওয়ার আগে ফান্ড নিজেই তার তহবিল থেকে চড়া হারে কর কেটে নেয়। অর্থাৎ ডিভিডেন্ড হিসেবে যে তহবিল বণ্টন হবে, সেখান থেকে ওই টাকা বাদ যায়। এই হার ২৮ শতাংশের বেশি। একে বলে ডিভিডেন্ড ডিস্ট্রিবিউশন ট্যাক্স। ফলে প্রাপকের যা পাওয়ার কথা, সেটা কমে যায়। ডিভিডেন্ড হিসেবে লগ্নিকারীর হাতে যা আসে, তার উপর কোনও কর দিতে হয় না। শেয়ার ভিত্তিক (ইকুইটি) ফান্ডের ডিভিডেন্ড পুরোপুরি করমুক্ত।
এ বার বলি রিটার্নের কথা। ইকুইটি ফান্ড এক বছর ধরে রেখে বিক্রি করে লাভ হলে, কর দিতে হয় না। আর ডেট ফান্ড তিন বছর ধরে রেখে বিক্রি করে লাভ হলে, তার উপর মূল্যবৃদ্ধি সূচক প্রয়োগ করা যেতে পারে। প্রয়োগের পরে অবশিষ্ট যে লাভ থাকে তার উপর ২০% হারে কর দিতে হয়। আর মূল্যবৃদ্ধি সূচক প্রয়োগ না-করলে পুরোটার উপরই ২০% কর দিতে হয়।
আপনার ফান্ডটি ডেট ফান্ড। ইতিমধ্যেই তিন বছর হয়ে গিয়েছে। ফলে ভাঙালে লাভের উপর মূল্যবৃদ্ধি সূচক প্রয়োগ করতে পারেন। অবশিষ্ট মুনাফার উপর ২০% কর দিতে হবে।
পরামর্শদাতা:
অমিতাভ গুহ সরকার
পরামর্শের জন্য লিখুন:
‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১।
ই-মেল: bishoy@abp.in
ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানাতে ভুলবেন না
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy