বিদ্যুৎ নেই।
ডাক্তার নেই।
হাসপাতাল তো দূর অস্ত্।
রাজ্যের বহু প্রত্যন্ত প্রান্তের ছবি এ রকমই। যেমন, খাস কলকাতা থেকে মাত্র ঘণ্টা দুয়েক দূরে বালি দ্বীপই আদপে যেন আলাদা পৃথিবী। নয়-নয় করে ৩০,০০০ লোকের বাস। কিন্তু এই সে দিনও জ্বর-জ্বালায় সে ভাবে ওষুধ পাওয়ার জো ছিল না সেখানে। অথচ সেখানেই কি না মার্চে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে ফেলেছেন ছয় ‘সাহসিনী’!
পাল্স দেখা, প্রেশার মাপার মতো প্রাথমিক কাজটুকু তো তাঁরা করছেনই, সেই সঙ্গে কম্পিউটার মারফত যোগাযোগ করছেন ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে। তাঁদের পরামর্শ মেনে গ্রামেই বন্দোবস্ত করছেন নিত্যকার রোগ-জ্বালার চিকিৎসার। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গোসাবার কাছে বালি দ্বীপের ওই ছয় মেয়ে দশ কিংবা বারো ক্লাস পাশ। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসায় ন’মাসের প্রশিক্ষণকে সম্বল করে এখন গ্রামের অন্ধকার ছবি বদলে দিচ্ছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে পরিবারেরও। নিজেদের উদ্যোগে উপার্জনের মাধ্যমে।
সারা দেশেই দক্ষ কর্মী পেতে মাথা খুঁড়ছে প্রায় সমস্ত শিল্প। প্রায় চুল ছেঁড়ার দশা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলির। কাজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধু উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে কর্মপ্রার্থীদের সামনে তার দরজা খুলে দিতে পারছে না তারা। তাই সেই ফাঁক ভরাট করতে পা ফেলছে বেসরকারি উদ্যোগ। চেষ্টা করছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতার সেতু তৈরির। যেমন, স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিসরে এই যোগসূত্র তৈরিতে পা বাড়িয়েছে স্কুল ফর স্কিলস ইন অ্যালায়েড হেল্থ সায়েন্সেস। সিউড়িতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরে এ বার পূর্ব মেদিনীপুরেও সেই লক্ষ্যে একটি হাসপাতাল বাড়ি হাতে নিয়েছে তারা।
স্কুলের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন চিকিৎসক শতদল সাহার মতে, প্রতি ১০০টি হাসপাতাল বেডের জন্য প্রয়োজন অন্তত ১৫০ জন সাপোর্ট স্টাফ। কারণ, ডাক্তার রোগী দেখে ওষুধ লিখবেন। কিন্তু সেই ওষুধ ঠিক মতো খাওয়ানো, ইঞ্জেকশন-স্যালাইনের বন্দোবস্ত, এমনকী প্রতি মুহূর্তে রোগীর উপর সতর্ক কিন্তু সমব্যথী নজরদারি নির্ভর করে সাপোর্ট স্টাফদের উপরেই।
এর আগে সিআইআইয়ের সমীক্ষাও জানিয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে রাজ্যে প্রশিক্ষিত নার্সের ঘাটতি হবে ২০ থেকে ৩০ হাজার। পাল্লা দিয়ে সমস্যা হবে যথেষ্ট সংখ্যায় সাপোর্ট স্টাফ পেতে। তাই এ ধরনের প্রশিক্ষণ শেষে কাজের সুযোগ পেতে যেমন সুবিধা হবে, তেমনই আখেরে উপকার হবে রোগীদেরও।
সিউড়িতে স্কুল ফর স্কিলস ইন অ্যালায়েড হেল্থ সায়েন্সেসের প্রধান দূর্বা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, বালি দ্বীপের মতো ওই একই রকম ছবির দেখা মিলবে বীরভূমের বড়রা গ্রামে। সেখানেও একই ভাবে খুলেছে চিকিৎসা কেন্দ্র। তাঁর দাবি, ‘‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে এমনও অনেকে প্রশিক্ষণ নিতে আসেন, যাঁদের বাবা রিক্শা চালান কিংবা সব্জি বেচেন। কারও মা সংসার চালান সেলাইয়ের কাজ করে। কিন্তু প্রশিক্ষণের পরে পড়ুয়াদের অনেকেই কাজ করছেন বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে। মাস গেলে বেতন পাচ্ছেন সাত-সাড়ে সাত হাজার টাকা। সেই রোজগারে তাঁদের পরিবার যেমন মাথা উঁচু করে বাঁচছে, তেমনই দক্ষ কর্মীর জোগান দেওয়া যাচ্ছে চিকিৎসা শিল্পে।’’
শতদলবাবুর দাবি, হোম হেল্থ এইড, ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান এবং অপারেটিং থিয়েটার টেকনিশিয়ান— এই তিন বিষয় পড়াতে ফি সপ্তাহে কলকাতা থেকে আসেন ডাক্তারবাবুরা। শুরুতে প্রাথমিক ধারণাগুলির সঙ্গে পরিচিতির পরে হাতে-কলমে কাজ শেখার সুযোগ মেলে। করানো হয় ইন্টার্নশিপ। অসুবিধা হয় না প্রশিক্ষণ শেষে কাজের সুযোগ পেতেও। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুল তৃতীয় বছরে পা দিল। এবং একেবারে শুরু থেকে এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছে কলকাতার অধিকাংশ হাসপাতাল। সব রকম ভাবে সাহায্য করেছেন নামী ডাক্তারবাবুরাও।’’
শুধু তা-ই নয়। চাকরি পাওয়ার পাশাপাশি এ ধরনের প্রশিক্ষণ খুলে দিচ্ছে নিজের ব্যবসা শুরুর দরজা। কেউ গ্রামে হেল্থ কিয়স্ক খুলছেন, তো কেউ পরিকল্পনা ছকছেন অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা চালু করার। সার্বিক ভাবে সমাজে এর প্রভাব দেখে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো জোগাতেও এগিয়ে আসছেন অনেকে। শতদলবাবুর কথায়, ‘‘যে-সমস্ত জায়গায় আমরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলেছি বা খুলছি, সেগুলি দিয়েছেন এলাকারই কোনও নামী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। কেউ জুগিয়েছেন বৃত্তির টাকা। আমরা মন দিয়েছি শুধু প্রশিক্ষণে।’’ তাঁর মতে, এই পেশা আসলে সুযোগ দেয় অন্যের জীবন বাঁচিয়ে নিজের জীবন বদলানোর। তাই এর উপযুক্ত করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে আগামী দিনে আরও অনেক সংস্থা আগ্রহী হবে বলে আশাবাদী তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy