জানুয়ারি থেকে মার্চ— দেশে বিমা ব্যবসার সোনার সময়। সারা বছরে পলিসিতে যত লেনদেন হয়, তার প্রায় ৭০ শতাংশই না কি হয়ে যায় এই তিন মাসে!
কেন? ইংরেজি নতুন বছরে পরিবারকে সুরক্ষাকবচ জোগানোর প্রতিজ্ঞা? সঞ্চয়ে আটঘাট বেঁধে নতুন বছর শুরুর প্রস্তুতি? না কি নেহাতই কাকতালীয়? আসলে এর একটাও নয়। ৩১ মার্চ অর্থবর্ষ শেষ। তার আগে কর বাঁচাতে পড়িমরি করে লগ্নি করা ভীষণ জরুরি। তা টাকা রাখি কোথায়? বাড়ির বড়রা, আড্ডার বন্ধু, অফিসের সহকর্মী কিংবা চেনাশোনা বিমা এজেন্ট— এঁদের অনেকেই একবাক্যে সমাধান দেন, ‘‘কেন জীবন বিমা কিনলেই হল। বিমার সুরক্ষাও হাতে এল, আবার ভবিষ্যতের সঞ্চয়ও। ঠিক যেন এক ঢিলে দুই পাখি।’’ গলদটা এখানেই। সম্ভবত ঠিক এই মোড়েই বিমা বাছাইয়ে ভুল করে ফেলি আমরা।
বিমা সঞ্চয় নয়
বহু বার শোনা কথা। তবু এটা বলেই আজকের আজকের আলোচনায় ঢুকতে চাই যে, বিমা কিন্তু বিনিয়োগ নয়। ঝুঁকি সামলানোর রক্ষাকবচ। তাই সেখানে টাকা ঢালার আগে তাকে সে ভাবেই দেখা উচিত।
আর ঠিক সেই কারণেই এখানে জীবন বিমা বলতে শুধু টার্ম পলিসি নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা। এ ধরনের পলিসিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহকের মৃত্যু ছাড়া টাকা পাওয়া যায় না। অনেকটা স্বাস্থ্য বিমার মতো। কিন্তু তেমনই অনেক কম টাকা প্রিমিয়াম গুনে কভারেজ মেলে অনেকটা বেশি। সে ক্ষেত্রে হাতে রয়ে যাওয়া বাকি টাকা খাটানোর সুযোগ থাকে অন্য বেশি রিটার্নের প্রকল্পে।
যেন যথেষ্ট হয়
জীবন বিমা কেউ করেন কেন? যাতে তাঁর অবর্তমানে পরিবার বিপদে না পড়ে, তাই তো? কোনও পলিসি কেনার আগে সবার প্রথমে এই বিষয়টি বিবেচনা করুন। ভেবে দেখুন, যে-কভারেজ নিচ্ছেন, তা আপনার পরিবারের পক্ষে যথেষ্ট তো?
বিমার হিসেবপত্তর
এই কারণে বিমার ‘সাম অ্যাশিওর্ড’ ঠিক করা নিয়েই আজ শুরুতেই কথা বলব। বিমাকারীর চাহিদা, জীবনযাত্রার মান, প্রতি মাসে তাঁদের গড় খরচ ইত্যাদি অনুসারে বিমার অঙ্ক বদলে যাওয়ার কথা। তা যায়ও।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা ফর্মুলা মোটামুটি সকলেরই কাজে লাগতে পারে। যা দিয়ে কত টাকার কভারেজ লাগবে, তার মোটামুটি একটা আঁচ পাওয়া যায়। সেটি হল—
• বিমা কেনার আগে মোট ধারের হিসেব করুন (গাড়িঋণ, গৃহঋণ ইত্যাদি যোগ করে)।
• তার উপরে আঁচ করুন ফি বছর জিনিসপত্তরের দাম কেমন বাড়তে পারে (অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির হার)। এ বার দেখুন, সেই হিসেবে আগামী দিনে সংসার চালানোর খরচ কেমন দাঁড়াবে।
• সন্তানের পড়াশোনা, উচ্চশিক্ষা, বিয়ের আনুমানিক ব্যয়— মূল্যবৃদ্ধি ধরে তা-ও হিসেব করুন।
এ বার এই তিনটি যোগ করলে, কত টাকার কভারেজ জরুরি, তার মোটামুটি একটা আন্দাজ মিলবে। এর সঙ্গে নিন ক্রিটিক্যাল ইলনেস ও অ্যাক্সিডেন্ট রাইডার।
যদি এত হিসেব করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে বার্ষিক আয়ের ১০-২০ গুণ টাকার বিমা করতে পারেন। এতে দীর্ঘ মেয়াদে বর্তমান জীবনযাপনের মান বজায় রাখতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর যদি তার পরেও দেখেন, সেই টাকায় চলবে না, তখন ‘টপ-আপ’ করানোর রাস্তা তো খোলা থাকছেই।
যত আগে, তত ভাল
অনেকেই প্রশ্ন করেন, পলিসি কখন কেনা উচিত? সাধারণত সংসার চালানো বা সন্তানের জন্য সঞ্চয়ের মতো দায়িত্ব ঘাড়ে চাপলে, তবেই পলিসি কেনার কথা বলা হয়। কিন্তু আপনি যদি চান, তা হলে চাকরি পাওয়ার পরেই পলিসি কিনতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখলে ভাল—
• যত আগে টার্ম পলিসি কিনবেন, তার প্রিমিয়ামও তত কম পড়বে।
• বয়স যত বাড়ে, ততই বিভিন্ন রোগের কারণে প্রিমিয়ামের অঙ্কও বাড়তে থাকে।
• বেশি বয়সে বিমা কিনলে বাড়তি প্রিমিয়ামের ঝক্কি আছে। সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করতে হতে পারে।
তাই যত আগে শুরু করা যায়, তত ভাল। তবে তা বলে তাড়াহুড়ো করে না কিনে, গোড়াতেই নিজের প্রয়োজন বুঝুন।
কত বছরের জন্য?
কত টাকার টার্ম পলিসি করা উচিত, তা যেমন ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে, তেমনই শুরুতে ভেবে ফেলতে হবে মেয়াদ। খুব কম দিনের জন্য বিমা করলে হয়তো দেখা যাবে, যখন প্রয়োজন, তখন সেটি কাজেই এল না। আবার খুব বেশি দিনের জন্য পলিসি কিনলে দিতে হতে পারে তুলনায় বেশি প্রিমিয়াম।
তাই আমি বলব, যত দিনের জন্য বিমা লাগবে বলে মনে করছেন, তার থেকে কয়েক বছর বেশি সময়ের মেয়াদে পলিসি করতে। তাই প্রথমে দেখে নিন, পরিবারের সদস্যদের কত দিন আপনার রোজগারের উপরে নির্ভর করতে হবে। সেই অনুযায়ী মেয়াদ স্থির করুন।
আর সংস্থা বাছাই?
মিউচুয়াল ফান্ড বা শেয়ার কেনার সময়ে যদি আগে সংস্থার খুঁটিনাটি দেখে লগ্নি করি, তা হলে পলিসি কেনার বেলাতেই নয় কেন? আমরা অনেকেই আগুপিছু না ভেবে যে-পলিসির প্রিমিয়াম তুলনায় কম, সেটির দিকে ঝুঁকি। কিন্তু শুধু তা তো মাপকাঠি হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে অন্তত কয়েকটি বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার বিষয়ে অবশ্যই জোর দেব—
টাকা মেটানোর ইতিহাস
কোনও বছরে বিমার টাকা দাবি করে শতকরা কত জন গ্রাহক সেই টাকা হাতে পাচ্ছেন, সেই অনুপাতই হল ক্লেম সেট্লমেন্ট রেশিও। সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং টাকা মেটানোর ইতিহাস বোঝার যা একটা উপায়।
টাকা পেতে কত দিন?
বিমার টাকা দাবি করার পরে গড়ে কত দিন লাগছে তা হাতে পেতে। শুধু বিমা বিক্রি করেই কাজ সেরে ফেলা নয়, তার পরেও সংস্থা গ্রাহকদের পরিষেবা দিতে কতটা তৎপর, তা বোঝা যায় এই সময় দেখলে। যত কম সময় লাগবে, তত ভাল।
তুলনা করুন
বাজারে বিভিন্ন সংস্থার নানা ধরনের টার্ম পলিসি রয়েছে। কেউ কম প্রিমিয়ামে বা়ড়তি সুবিধা দেওয়ার দাবি করলেই, সেখানে চট করে টাকা ঢালবেন না। আগে সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিচার করুন। এজেন্টের কাছে খুঁটিয়ে তথ্য জানতে চান। মনে রাখবেন, পরিবারের সুরক্ষার জন্য টাকার ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে।
নজরে বৈশিষ্ট্য
প্রথাগত প্রকল্পের বাইরেও, নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য-সহ টার্ম পলিসি আনছে সংস্থাগুলি। নজর রাখুন সেগুলিতে। এর মধ্যে রয়েছে—
টাকা ফেরত
সাধারণত টার্ম পলিসিতে মেয়াদ শেষে টাকা পাওয়া যায় না। অন্যান্য পলিসির মতো তা সারেন্ডার বা পেড-আপও করা যায় না। কিন্তু এখন কিছু টার্ম পলিসিতে মেয়াদ শেষে প্রিমিয়াম বাবদ জমা দেওয়া টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বিমাকারীর সামনে। তবে সেই সুবিধা চাইলে, গুনতে হবে প্রিমিয়াম বাবদ বাড়তি টাকাও।
নমিনির হাতে টাকা
বিমাকারীর মৃত্যু হলে, এক বারে বা প্রতি মাসে নমিনিকে টাকা দেয় সংস্থা। কোনও কোনও সংস্থা বাড়তি সুবিধা হিসেবে সাম অ্যাশিওর্ডের বাইরেও প্রতি মাসে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করে। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সেই অঙ্ক বাড়তে থাকে। মূল্যবৃদ্ধি সামলাতে এটি ভাল উপায়। এ জন্য বাড়তি প্রিমিয়াম লাগতে পারে। দেখে নিন আপনার সংস্থা সেই সুবিধা দিচ্ছে কি না।
একাধিক নমিনি
সাধারণত এক জনকেই নমিনি বাছা যায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তিকে নমিনি করে, তাঁদের প্রয়োজন অনুসারে টাকা আগে থেকে ভাগের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন বিমাকারী।
জয়েন্ট পলিসি
ব্যাঙ্ক, ডাকঘরে আমানত প্রকল্প যেমন এক বা একাধিক ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, অনেক বিমাতেও সেই সুবিধা মেলে। ধরুন, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই রোজগার করেন। দু’জনেরই বিমা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে চাইলে এক সঙ্গে প্রকল্প কিনতে পারেন। এতে তুলনায় কম খরচে বেশি কভারেজ পাওয়া যায়।
বাড়তি সুবিধা
টার্ম পলিসির সঙ্গেই নেওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের বাড়তি সুবিধা বা রাইডার। যেমন, অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ অ্যান্ড ডিসেবিলিটিজ, টার্মিনাল ইলনেস বেনিফিট ইত্যাদি।
প্রথমটির ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বিমাকারীর মৃত্যু হলে, বিমার টাকা ছাড়াও বাড়তি অঙ্ক পাবেন নমিনি। এ ছাড়াও দুর্ঘটনার কারণে বিমাকারীর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে, রয়েছে প্রিমিয়ামে ছাড়ের মতো সুবিধা।
আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কোনও কঠিন অসুখ ধরা প়ড়লে, বিমার সাম অ্যাশিওর্ডের একাংশ বা পুরোটাই মেলে। অনেক সংস্থা বিমাকারীর মৃত্যুর আগেই সেই টাকা দেয়।
প্রিমিয়ামে ছাড়
অনেক বিমা সংস্থা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামে ছাড় দেয়, আপনার প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেই সুবিধা রয়েছে কি না, প্রথমেই তা জেনে নিন।
প্রিমিয়াম না দিলে
অন্যান্য পলিসিতে নির্দিষ্ট সময়ের পরেও প্রিমিয়াম দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। টার্ম পলিসিতে কিন্তু প্রিমিয়ামের টাকা না দিলে, পলিসি বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
তাই খেয়াল রাখুন, বছরে কোন সময়ে আপনাকে প্রিমিয়ামের টাকা গুনতে হবে। সেই অনুসারে তৈরি হন। যদি তা সত্ত্বেও টাকা দিতে দেরি হয়ে যায়, তা হলে সরাসরি বিমা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করুন অথবা আপনার এজেন্টের সঙ্গে কথা বলুন।
নথি হারালে
বিমার কাগজ হারালে, সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানান। তারাই নতুন নথির ব্যবস্থা করবে। পলিসির সুবিধা তাতে কাটছাঁট হওয়ার কথা নয়।
পছন্দ না হলে ফেরত
পলিসির কাগজ হাতে পাওয়ার পরে, তা খুঁটিয়ে পড়ুন। যদি তার শর্ত পছন্দ না হয়, তা হলে সেটি ফেরত দিতে পারেন। সাধারণত এ জন্য ১৫-৩০ দিন সময় পাওয়া যায়। একে বলে ফ্রি-লুক পিরিয়ড। তবে এজেন্টের মারফত পলিসি কিনলে এই সময়সীমা ১৫ দিন। পলিসির কাগজে ভুল থাকলেও, এই সময়ের মধ্যে তা শুধরে নেওয়া যায়।
পেড-আপ বা সারেন্ডার
সাধারণত প্রথাগত পলিসিতে পেড-আপ (মাঝপথে টাকা না তুললেও, প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ করা) এবং সারেন্ডারের (পলিসি বন্ধ করে সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়া) সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু বেশির ভাগ টার্ম পলিসিতে তা মেলে না। যদি পলিসিতে সেই সুবিধা থাকে, প্রথমেই তা ভাল ভাবে বুঝে নিন।
আগামী সংখ্যায়...
শুধু বিমা পলিসি কিনলে তো হবে না। প্রয়োজনের সময়ে যাতে ক্লেমের টাকা পরিবার হাতে পায়, সেই বিষয়টিও শুরু থেকেই নিশ্চিত করা জরুরি। তার জন্য সঠিক তথ্য জমা দেওয়া থেকে শুরু করে কী কী করা উচিত, তা নিয়েই আগামী সংখ্যায় আলোচনা করব আমরা।
লেখক: ব্যাঙ্কবাজার ডট কমের সিইও
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy