তামিম চৌধুরী।
অনেকটা স্বস্তিতে বাংলাদেশ। ‘নিও জেএমবি’র প্রধান তামিম চৌধুরীর মৃতদেহ চিনে ফেলতেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল পুলিশ, প্রশাসন। গত দু’বছরের বেশি বাংলাদেশে একের পর এক নাশকতার মূল মস্তিষ্ক, মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল এই তামিম। শনিবার সকালে যৌথবাহিনীর হাতে দুই সঙ্গী-সহ তামিমের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটা কালো অধ্যায়ের সম্ভবত শেষ হল। এই স্বস্তিতেই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেমন বলেছেন- ‘তামিম চৌধুরী চ্যাপ্টারের শেষ’, তেমনই হাঁফ ছেড়েছেন শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ।
২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণের শুরুতেই খুন হয়েছিলেন ব্লগার রাজীব হায়দার। তার পরে একের পরে এক হত্যাকান্ড। চাপাতির কোপে খুন হতে থাকলেন ব্লগার লেখক, পুরোহিত, পির, বিদেশি নাগরিক, যাজক। শেষে বড়সড় হামলা হল গুলশনের হোলি আর্টিজান বেকারিতে। সেই হামলা গোটা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়। কয়েক দিন পরেই শোলাকিয়াতে ইদের নামাজের মাঠে ফের হামলা। এই হামলা নিজেদের দুই সদস্যের জীবন দিয়ে রুখে দেয় বাংলাদেশের পুলিশ। এই সব ঘটনারই পিছনে ছিল জেএমবির একটি ধারা, যা ‘নিও জেএমবি’ নামে পরিচিত। ছিল আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার।
গুলশন হামলা আর শোলাকিয়ার ঘটনার পরেই অনেক বেশি নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ। আরও কঠোর হয়ে যায় সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি মনোভাব। ফলে অল্প দিনেই বদলে যায় পরিস্থিতি। পরপর শিরোনাম হতে থাকে পুলিশ বাহিনীর সাফল্য। কল্যাণপুরে খতম হল নয় জঙ্গি। সারাদেশে পুলিশের অভিযানের প্রেক্ষিতে ঘটে বেশ কয়েকটা এনকাউন্টার। সেখানেও খতম হয় বেশ কয়েকজন জঙ্গি। ধরাও পড়তে থাকে অনেকে।
গত কয়েক মাস ধরেই এই জঙ্গিদের মাস্টারমাইন্ড হিসাবে আলোচনায় আসছিল কয়েকটি নাম। এর মধ্যে অন্যতম তামিম চৌধুরী। সেই তামিম চৌধুরী শনিবার নিজের আস্তানায় খতম হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া কবরস্থানের পাশের তিনতলা বাড়িটি ঘিরে পুলিশের এই অভিযানের নাম ‘অপারেশন হিট স্ট্রং টোয়েন্টি সেভেন’। এই অপারেশনের শেষে বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান একেএম শহিদুল হক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “অপারেশন শেষে আমরা ভেতরে ঢুকে দেখতে পাই তিনজন জঙ্গি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের চেহারা তামিম চৌধুরীর যে ছবি আমাদের কাছে আছে তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এতে স্পষ্ট সে তামিম চৌধুরীই হবে।”
বাংলাদেশের জঙ্গিদের নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁরা তামিম চৌধুরীর খতমকে একটি বড় ঘটনা হিসাবেই দেখছেন। তাঁদের মতে, গত দু’বছরে যে ভয়ের সংস্কৃতি জঙ্গিরা তৈরি করেছিল, এই সাফল্য সেই ভয়কে জয় করার পথে বড় পদক্ষেপ। তবে তামিম চৌধুরী যদি একটা অধ্যায়ের শেষ হয়, তার শুরুটা খুঁজতে গেলে এক দশক পিছিয়ে যেতে হবে।
প্রথম জেএমবি সুপ্রিমো আবদুর রহমান
জেএমবির উত্থান
২০০৫ সালের ১৭ অগস্ট বাংলাদেশের ৬৩টি জেলাতে এক সঙ্গে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবির সর্বোচ্চ নেতা আবদুর রহমান। দেশ জুড়ে বোমা হামলা চালানোর সময় প্রতিটি স্থানে প্রচারপত্র রেখে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় জেএমবি। এটি ছিল বাংলাদেশে জঙ্গিদের প্রথম জানান দেওয়া আক্রমণ। মুন্সিগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩টি জেলার প্রায় ৫০০ জায়গায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে দেশব্যাপী তৈরি করা হয়েছিল আতঙ্ক। সে দিনের ঘটনায় দু’জন নিহত হন এবং স্প্রিন্টারের আঘাতে আহত হন অন্তত ৫০ জন।
এর আগে জেএমবি বেশ কয়েকটি বোমা হামলা চালালেও এটিই ছিল প্রথম বড় ‘অপারেশন’। গত শতকের শেষ দশকে গঠিত এই দলটি প্রকাশ্যে আসার আগে রাজশাহীর বাগমারায় উগ্র বামপন্থীদের দমনের নামে পরিচালনা করেছিল অনেকগুলি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। সেই সময়ের বিএনপি-জামাত জোটের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামি জেএমবি নেতা সিদ্দিকুর ইসলাম বাংলা ভাইকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে রক্ষারও চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে সেই নিজামির মৃত্যুদণ্ড হয়।
১৭ অগস্ট বোমা হামলার পর জেএমবি থামেনি। ঝালকাঠিতে বিচারকদের লক্ষ্য করে, গাজিপুর আইনজীবী সমিতির দফতরে এবং বিভিন্ন আদালত লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে জেএমবি। বাংলাদেশে আত্মঘাতী হামলাও এই জেএমবির দ্বারাই শুরু। হামলা চলে যশোহরে উদীচি শিল্পী গোষ্ঠির অনুষ্ঠানে, রমনা বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বছর বরণ অনুষ্ঠানে, পল্টনে সিপিবির সমাবেশে, নারায়নগঞ্জে আওয়ামি লিগ অফিস-সহ আরও অনেক জায়গায়। শুরুতে সেই সময়ের সরকার এদের দেখেও দেখেনি। কিন্তু দেশব্যাপী বোমা হামলার পরে সরকার ও প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার কাজ শুরু করতেই হয়। জেএমবি-সহ চারটি দল নিষিদ্ধ করা হয় এবং শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর কাজটি হয় ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালে। ঝালকাঠির দুই বিচারকের হত্যা মামলায় জেএমবি প্রধান আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, থিংক-ট্যাংক আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও সালাহউদ্দিনকে ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ফাঁসি দেওয়া হয়।
শাহবাগ আন্দোলন
নতুন করে শুরু
২০০৮ সালে আওয়ামি লিগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করার পর প্রথম দিকে এই জঙ্গিদের তেমন একটা কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার কারাদণ্ড ঘোষণার প্রতিবাদে শাহাবাগে অবস্থান আন্দোলন গড়ে ওঠে। উল্টো দিকে আবার ‘নাস্তিক ব্লগারদের’ শাস্তির দাবিতে চলতে থাকে একটি মহলের উস্কানি। এ সময়েই হত্যা করা হয় রাজীব হায়দারকে। সক্রিয় হয়ে ওঠে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। এর পর ধারাবাহিক ভাবে মুক্তচিন্তার লেখক-ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটে গিয়েছে। প্রশাসন বা রাষ্ট্র কেউই তখন এই মুক্তচিন্তার লেখকদের নিরাপত্তা দেওয়া বা তাঁদের হত্যাকান্ডের বিষয়ে তেমন একটা সক্রিয় ছিল না। উল্টো চিন্তার স্বাধীনতা বা আস্তিক-নাস্তিক বিষয়টি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মুখেও শোনা গিয়েছে। এর পরে ঘটে বেশ কয়েকজন পুরোহিত, যাজক, পিরের হত্যাকান্ড। এই সব হত্যাকাণ্ডে জেএমবি ব্যবহার করেছিল চাপাতি, বোমা। কয়েক জায়গায় গুলি করে হত্যাও হয়। কয়েকজন বিদেশি নাগরিককেও তারা হত্যা করে।
সব শেষে এই বছর গুলশনে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ১৭ বিদেশিকে হত্যা করা হয়। দেশে-বিদেশে আলোচিত হয় এই ঘটনা। দেখা গেল জঙ্গিদের হাতে আধুনিক অস্ত্র, আধুনিক প্রযুক্তি। একই সঙ্গে গত বছর থেকেই শুরু হয় হত্যা বা হামলার দায়িত্ব নিতে আইএস কিংবা আল কায়দার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর নাম ব্যবহার। তবে যে নামই জঙ্গিরা ব্যবহার করুক, ১১ বছর পর আবার সামনে উঠে এসেছে ২০০৫ সালের হামলাকারী সেই জেএমবির নামই।
জেএমবি হামলা
জেএমবি থেকে নিও জেএমবি
২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশকে মেরে তিন জেএমবি নেতাকে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নেয়। এর পর নতুন করে আলোচনা শুরু হয় জেএমবিকে নিয়ে। গত ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর পুলিশ জানায়, কানাডাবাসী তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে সক্রিয় এখন ‘নিও জেএমবি’।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা সম্প্রতি বেশ কয়েকবার বলেছেন, সেই জেএমবি কয়েকটি ধারায় ভাগ হওয়ার পর তার একটি এখন ‘নিও জেএমবি’ নামে সক্রিয় এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-সহ আরও কয়েকটি সংগঠন। তামিম চৌধুরীই এই নব্য-জেএমবির প্রধান ছিল।
তামিম চৌধুরী বৃত্তান্ত
বাংলাদেশে জেএমবির যে অংশ আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-কে অনুসরণ করে জঙ্গি কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, সে অংশের শীর্ষ নেতা হিসেবে আলোচিত ছিল এই তামিম চৌধুরী। কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম দেশে ফিরে আত্মগোপন করে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। মিরপুর থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারেও এ তথ্য হয়েছে।
এই তামিম আহমেদ চৌধুরী সিলেটের বিয়ানিবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের বড়গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নাতি। স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, মজিদ চৌধুরী একাত্তরে ওই এলাকার ‘শান্তি কমিটি’র সদস্য ছিলেন।
তামিমের বাবা শফি আহমদ জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি সপরিবারে কানাডায় যান। কানাডার উইন্ডসরে থাকার সুবাদে ৩০ বছর বয়সী তামিমের বেড়ে ওঠাও সেখানে। পরিবার সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা না গেলেও বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তামিম তিন সন্তানের বাবা। পাঁচ বছর আগে বাবাকে ‘আমার সঙ্গ ছেড়ে দাও, আমি আল্লাহর নামে রয়েছি’ এই চিঠি লিখে নিখোঁজ হয়েছিল এই তামিম।
তামিমের নাম গণমাধ্যমে আসে গত ১ জুলাই গুলশনে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর। বর্বর ওই জঙ্গি হামলায় রেস্তোরাঁয় উপস্থিত ১৭ বিদেশি-সহ ২২ জনকে হত্যা করা হয়। ওই দিন রাতে উদ্ধার অভিযানের সময় বন্দুকধারীদের বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহত হয় পাঁচ হামলাকারী। মোট ২৯ জনের ম়ৃত্যু হয়। গুলশনের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তামিম আহমেদ চৌধুরী ও সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হককে চিহ্নিত করেন আইজিপি একেএম শহিদুল হক। তিনি জানান, তামিম ও জিয়াকে ধরতে সহায়তা করলে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হবে।
এর আগে, আইএস বাংলাদেশে দলের শাখাপ্রধান হিসেবে যে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের নাম ঘোষণা করেছিল, সে আসলে তামিম- এই বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তবে তার তথ্যগত প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেননি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, তামিম আহমেদ চৌধুরী ২০১৩ সালের অক্টোবরে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসে।
গুলশন হামলার পর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়েছিল রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান। রিগ্যান পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, জাহাজ বিল্ডিং নামে পরিচিত তাজ মঞ্জিলের আস্তানায় অন্য 'বড় ভাই'দের পাশাপাশি নিয়মিত যেত তামিম চৌধুরী। অভিযানে নিহত জঙ্গিদের সে প্রশিক্ষণ দিত। আর্থিকভাবে সহায়তাও করত।
এ ভাবেই কানাডায় বেড়ে ওঠা তামিম আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশে জঙ্গিদের নতুন ধারায় তৎপরতার নেপথ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, যে শনিবার নারায়ণগঞ্জে পুলিশের ‘অপারেশন হিট স্ট্রং টুয়েন্টি সেভেন’ অভিযানে নিহত হল।
পিছনের পথ
বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের সাম্প্রতিক ধারার শুরুটা হয়েছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বা হুজির হাত ধরে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীর হয়ে লড়াই চালিয়ে আসা বাংলাদেশিরাই এ সংগঠনটি গড়ে তোলেন। সেই সময়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর সাথে লড়তে বেশ বড় একটা সংখ্যার মানুষ বিভিন্ন পথে আফগানিস্তানে গিয়েছিল। আফগান যুদ্ধের পরে তারা ফিরে আসে। সঙ্গে নিয়ে আগে উগ্র মতামত। তারা আফগান স্টাইলে তালিবান বাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্নও দেখতে থাকে। “আমরা সবাই তালিবান, বাংলা হবে আফগান”— এই স্লোগানে মিছিল আমরা দেখেছি নিকট অতীতে।
রাষ্ট্রের নীরবতা
সরকারি নীরবতা ও মদতের বিষয়টাও যে এ দেশে জঙ্গিবাদের বিকাশে সহায়তা করেছে তা খুব পরিষ্কার। ১৯৯৯ সালে যশোহরে উদীচির সম্মেলন, ২০০১ সালে পল্টনে সিপিবির সমাবেশ ও রমনা বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান, গোপালগঞ্জে গির্জা ও নারায়ণগঞ্জে আওয়ামি লিগ কার্যালয়, ২০০৪ সালের ২১ অগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা হামলা হলেও এ সব ক্ষেত্রে জঙ্গিদের যুক্ত থাকার বিষয়টি তখন পুলিশের তদন্তে আসেনি। ২১ অগস্টের ঘটনায় জজ মিয়া নামে একজনকে নিয়ে নাটক বানানোর ঘটনাও ঘটেছিল। ২১ অগস্টের গ্রেনেড হামলার পরে সংসদে সরকারি দল থেকে বলা হয়েছিল, সে সময়ের বিরোধী দলনেতা শেখ হাসিনা নাকি নিজেই ব্যাগে করে গ্রেনেড এনেছিলেন। অর্থাৎ চেষ্টা চলেছিল আসল অপরাধী জঙ্গিদের আড়াল করার।
হোলি আর্টিজান হামলা
নতুন করে আতঙ্কের শুরু
২০০৮ সাল নাগাদ রাজধানীর বনানীতে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে থাকা নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ক্যাম্পাসে আনসারুল্লাহর যাত্রা শুরু হয়। ওই সময় আলকায়দা মতাদর্শের সমর্থক, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক এবং বেশ কিছু ছাত্রকে নিয়ে আনসারুল্লাহ কমিটি গঠন করা হয়। পুলিশের কাছে বেশ আগেই বরগুনায় গ্রেফতার হওয়া রাহমানি ছিলেন আনসারুল্লাহর মূল পৃষ্ঠপোষক। তার মাধ্যমে ২০০৮ সাল থেকে এ দেশে ভিন্ন মোড়কে জঙ্গিদের দাওয়াতি কার্যক্রম চলে। এ জন্য তিনি ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রচার মাধ্যমকে বেছে নেন।
ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার পর গ্রেফতার হওয়া নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে পাওয়া স্বীকারক্তিতে এই রাহমানির নাম উঠে আসে। রাহমানির কাছে তারা ধর্মীয় বিষয়ে তালিম নিতে যেতেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভিআইপিদের হত্যার ছকও তৈরি করেছিল রাহমানি। সে তার ‘এসো আল্লাহর পথে’ বইয়ে একটি হত্যার ছক দিয়েছিল। সেখানে ছিল দেশের প্রগতিশীল অনেকের নাম। শাহবাগ আন্দোলর কর্মী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের পরে ফয়সাল বিন নাইম, মাকসুদুল হাসান অনিক, এহসানুর রেজা রোমান, নাইম সিকদার ও নাফিস ইমতিয়াজকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তারা সকলে শায়খ রাহমানির শিষ্য।
তিনটি ঘটনায় নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। মাঝে হিজবুত তাহরিরের কর্মকাণ্ডের কারণে তারা ততটা সক্রিয় ছিল না। তাহরিরের তৎপরতা কিছুটা থমকে যাওয়ায় তারা কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে থাকে। জিহাদি চেতনার প্রথম অংশ হিসেবে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি একই কায়দায় আক্রমণ করে হত্যা করা হয় ব্লগার রাজীবকে। ৭ মার্চ রাতে পল্লবীতে ব্লগার সানিউর রহমানের ওপর হামলা করে তাদেরই টিমের সদস্যরা।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি জঙ্গিবাদের সমর্থন করে না। সে কারণেই গত দু’বছরে অনেকটাই স্তম্ভিত হয়েছিলেন দেশের সাধারণ মানুষ। সবারই প্রত্যাশা ছিল এই অন্ধকারের শেষ দেখার। সেই প্রত্যাশা থেকেই সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিলেন জঙ্গিদের রুখতে। আমরা দেখেছি, ৫০ লক্ষ শিক্ষার্থী নাগরিককে একই সময়ে সারা দেশে মানব বন্ধন গড়ে তুলতে। আমরা দেখেছি দূরের গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত অজস্র কর্মসূচি। আর সেই কর্মসূচি ভরসা দিয়েছে দেশের প্রশাসনকে। আজ তামিম চৌধুরীর খতমের মধ্যে দিয়ে বাহিনীর যে সাফল্য এল, তা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় সাফল্য সন্দেহ নেই। বলাই যায়, একটা অধ্যায়েরও সমাপ্তি হল তামিমের মৃত্যুর সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy