বড়বাজারের ঘিঞ্জি গলির মধ্যে আছে আর্মেনিয়ান গির্জা। যা পুরনো সমাধিক্ষেত্রের জমিতে তৈরি হয়েছিল ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তী কালে গির্জা লাগোয়া জমিতে একটি প্রাচীন সমাধিফলক আবিষ্কৃত হয়। ফলকে লেখা ওই সমাধিতে ঘুমিয়ে আছেন রেজাবিবেহ সুকিয়া। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে প্রয়াত হয়েছিলেন রেজাবিবেহ | এটাই এখনও অবধি কলকাতায় আবিষ্কৃত প্রাচীনতম খ্রিস্টান সমাধি।
১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে যখন রেজাবিবেহ সমাধিস্থ হলেন কলকাতায়, লন্ডনে জন্মগ্রহণ করলেন জোব চার্নক। অর্থাৎ ব্রিটিশদের অনেক আগে কলকাতায় বিদেশি বণিক হিসেবে পা পড়েছিল আর্মেনীয়দের। কিন্তু ব্রিটিশরা আসার পরে কলকাতায় স্তিমিত হয়ে যায় তাঁদের ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি। ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের পরে কলকাতা পুরোপুরি হয়ে যায় ব্রিটিশদের। কলকাতায় এখনও অবধি আবিষ্কৃত প্রাচীন ব্রিটিশ সমাধিস্থান ছিল সেই জমিতে, যেখানে আজ সেন্ট জোনস গির্জা দাঁড়িয়ে আছে। ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রয়াত জোব চার্নকের সমাধিও আছে এখানে।
কিন্তু সেই সমাধিস্থানের জমিও দ্রুত ভরে গেল। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্থানাভাবে বন্ধ করে দিতে হল গোরস্থান। সে বছরই ২৫ অগস্ট নতুন সমাধিক্ষেত্র শুরু হল তৎকালীন মরাঠা ডিচ বা মরাঠা খালের কাছে। গোরস্থান লাগোয়া রাস্তার নামই হয়ে গেল ‘বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড’। স্থানীয় নাম অবশ্য ছিল বাদামতলা। রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য বাদামগাছ ছিল নামকরণের কারণ। নতুন ফোর্ট উইলিয়ামের উল্টোদিক থেকে শুরু হয়ে সোজা দক্ষিণ পূর্ব হয়ে মরাঠা ডিচ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল এই রাজপথ। বেঙ্গল অ্যান্ড আগরা ডিরেক্টরি ১৮৫০ অনুযায়ী এর নাম ছিল ‘গোরস্থান কা রাস্তা’।
এই রাস্তার পাশেই ছিল গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্টের বাসভবন। ১৭৫৯ থেকে ১৭৬৪ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলার গভর্নর। তাঁর নাম অনুসারে গোরস্থান-পথের নাম প্রথমে হয়েছিল ভ্যান্সিটার্ট অ্যাভিনিউ। পরে এই ভবনে বাস করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি এলাইজা ইম্পে। তাঁর এই বাসভবনের বাগানে ঘুরে বেড়াত পোষা হরিণ। সেই ‘ডিয়ার পার্ক’ থেকেই রাস্তার নাম ক্রমে হয়ে গেল ‘পার্ক স্ট্রিট’। এই বাসভবনের মালিকানা বদল হয় একাধিকবার। লোরেটো হাউজ স্কুলও প্রাথমিক ভাবে শুরু হয়েছিল এই বাড়িতে। পরে তা স্থানান্তরিত হয়।
পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে যাঁরা ঘুমিয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই নতুন পরিবেশ সহ্য করতে না পেরে অকালপ্রয়াত। পাশাপাশি এখানে শুয়ে আছেন বহু যশস্বী ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের পুরোধা এই যুক্তিবাদী কবি ও ছাত্রদরদী অধ্যাপককে সমাধিস্থ করা হয়েছিল এখানেই। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন মাত্র ২২ বছর বয়সে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সেনা আধিকারিক হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। প্রতিদিন গঙ্গাস্নানের পরে শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহকে পুজো করতেন তিনি। কৃষ্ণই ছিলেন তাঁর একমাত্র আরাধ্য। যদিও মৃত্যুর পরে তাঁকে যেন সমাধি দেওয়া হয়, এই ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন তিনি। পালিত হয়েছিল শেষ ইচ্ছে। ইষ্টদেবতার বিগ্রহের সঙ্গেই তাঁর নশ্বর দেহ স্থান পায় সমাধিতে।
সমাধিস্থ বাকি বিখ্যাত যশস্বীদের মধ্যে আছেন নৌআধিকারিক ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড কুক, উদ্ভিদবিজ্ঞানী কর্নেল রবার্ট কিড, স্থপতি জন গার্স্টিন, প্রাক্তন সার্ভেয়র জেনারেল অব ইন্ডিয়া কলিন ম্যাকেঞ্জি এবং চার্লস ডিকেন্সের ছেলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্স। ভবানীপুর সমাধিক্ষেত্র থেকে তাঁর সমাধিফলক এখানে স্থানান্তর করা হয়।
গির্জার বাইরে থাকা বা নন চার্চ সেমিট্রির মধ্যে পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান অন্যতম। উনিশ শতকে আমেরিকা ও ইউরোপের বাইরে এটাই ছিল সম্ভবত সর্ববৃহৎ খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্র। বিরল গাছপালায় সুসজ্জিত এই শেষ বিশ্রামের জায়গার মেয়াদও একদিন ফুরিয়ে এল। স্থানাভাবে বন্ধ করে দিতে হল এর দরজা। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের পরে এই সে আর কাউকে শেষ আশ্রয় দেয়নি।
এই পার্ক স্ট্রিট সমাধিক্ষেত্রেই ছিল আরও অনেক ব্যক্তিত্বের শেষ-শয্যা। এখানেই ছিল সাহিত্যিক উইলিয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারের বাবা রিচমন্ড থ্যাকারের সমাধি। এখানেই ঘুমিয়ে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেমস কির্কপ্যাট্রিক। ১৭৯৮ থেকে ১৮০৫ অবধি হায়দরাবাদের এই বাসিন্দাকে অমর করে রেখেছেন উইলিয়াম ডালরিম্পল। তাঁর ‘হোয়াইট মুঘল’ উপন্যাসে।
নর্থ পার্ক স্ট্রিটের মতো কলকাতার আরও কিছু সমাধিক্ষেত্র আজ প্রায় ধুলোমাটি। সেন্ট জোনস চার্চের সমাধিস্থানে এখন প্রায় কিছুই নেই। পাশাপাশি কলকাতায় ছিল এডওয়ার্ড তিরেত্তাজ বেরিয়াল গ্রাউন্ড। ইতালির ভেনিস থেকে তিনি ভাগ্যের খোঁজে এসেছিলেন কলকাতায়। নানা কারবারে ধনকুবের তিরেত্তা কলকাতায় বাজার বসিয়েছিলেন। আজও আছে সেই বাজার। লোকমুখে তাঁর নাম ‘টেরিটি বাজার’।
কলকাতার অন্য গোরস্থানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লোয়ার সার্কুলার রোড সেমিট্রি, স্কটিশ সেমিট্রি, গ্রিক সেমিট্রি এবং ভবানীপুর সেমিট্রি। অতীতকে আঁকড়ে ধরে কলকাতার কোণায় কোণায় ঘুমিয়ে আছে ইতিহাসের আকর এই সমাধিস্থানগুলি।( ঋণস্বীকার: ক্যালকাটা ইলাস্ট্রেটেড : জন বেরি, ক্যালকাটাজ এডিফিস : ব্রায়ান পল বাখ, ক্যালকাটা: ওল্ড অ্যান্ড নিউ: এইচ ই এ কটন ) (ছবি:সোশ্যাল মিডিয়া)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy