জাহারি আহমেদ শাহ
প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও সন্দেহের তালিকায় প্রথম থেকেই পাইলট জাহারি আহমেদ শাহের নাম উপরে রেখেছিলেন তদন্তকারীরা। সোমবার জানা গেল, ‘অল রাইট, গুডনাইট’ বলে শেষ বারের মতো যিনি এটিসি-র সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তিনি কো পাইলট ফারিক আব্দুল হামিদ। তার পরই কেটে যায় যোগাযোগ। যা থেকে গোয়েন্দাদের সন্দেহ, বিমান উধাও হওয়ার পিছনে থাকতে পারে পাইলট-কো পাইলটের যৌথ উদ্যোগ। বিশেষত জাহারি রাজনৈতিক অতীতের কথা জানার পর সে সন্দেহ বাড়ছে বই কমছে না।
কি সেই অতীত? গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি, মালয়েশিয়ার বিরোধী দলনেতার অন্ধ ভক্ত ছিলেন নিখোঁজ বিমান বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআরের চালক জাহারি আহমেদ শাহ। এমনকী, বিমানে ওঠার মাত্র সাত ঘণ্টা আগে জেলবন্দি ওই নেতা, আনোয়ার ইব্রাহিমের মামলার শুনানিতেও সম্ভবত হাজির হয়েছিলেন তিনি। তথ্য এ-ও বলছে, সে দিনই কুয়ালা লামপুরের এক আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ইব্রাহিমকে। আর তা শুনে বিমানচালক যে তীব্র অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তা-ও জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। সব মিলিয়ে তাই সন্দেহ, মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকারের থেকে বদলা নিতেই হয়তো বিমানটি ছিনতাই করেছেন চালক।
সে সন্দেহ জোরদার করছে একটি ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে, ‘ডেমোক্র্যাসি ইজ ডেড’ লেখা একটি টি-শার্ট পরে রয়েছেন জাহারি। বিষয়টি দেখে অনেকেরই ধারণা, হয়তো গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারিয়েছিলেন ইব্রাহিম-অনুগত ৫৩ বছরের দক্ষ বিমানচালক। বিশেষত সম্প্রতি ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে যে ভাবে সমকামিতার অভিযোগ এনে তাঁকে জেলে পুরেছে মালয়েশীয় সরকার, তার পর জাহারির ক্ষোভ বাড়াই স্বাভাবিক। আর তার জেরেই হয়তো বিমান ছিনতাই।
এই মামলার রায় বেরোনোর সাত ঘণ্টা পরই বেজিংয়ের উদ্দেশে ওড়েন জাহারি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরই অভিমুখ বদল। আর তার কিছু ক্ষণ আগেই মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দুই যোগাযোগ ব্যবস্থার নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া। খুব দক্ষ কারও পরিকল্পনা ছাড়া এগুলো যে হতে পারে না, তা আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। জাহারির রাজনৈতিক ক্ষোভের কথা জানতে পারায় তদন্তকারীদের সন্দেহ তাই দৃঢ় হচ্ছে, উধাও-রহস্যের নেপথ্যে রয়েছেন চালক স্বয়ং। উদ্দেশ্য সরকার-বিরোধী প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা।
এই তত্ত্বের সমর্থনে তদন্তকারীদের কাছে এখনও কোনও জোরদার প্রমাণ নেই। যেমন ইব্রাহিমের দলের অন্যান্য সমর্থকের মধ্যে যাঁরা জাহারি-ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদেরই এক জন জানিয়েছেন, রাজনৈতিক বিষয়ে অসম্ভব সক্রিয় ছিলেন জাহারি। এক কথায় যাকে বলে ‘রাজনীতি-পাগল’ ব্যক্তি। সে দিক থেকে দেখতে গেলে নেতার প্রতি সরকারের এ হেন অবিচারের বদলা নেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন তিনি। কিন্তু তাঁর আর এক বন্ধুর দাবি, রাজনৈতিক বিষয়ে ঠিক যতটা উৎসাহী ছিলেন জাহারি, ততটাই সচেতন ছিলেন নিজের দায়িত্ব নিয়ে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে জাহারির পক্ষে কোনও ভাবেই বিমান ছিনতাই সম্ভব নয়। ওই বন্ধুর দাবি, যদি বিমানটি ছিনতাই হয়েও থাকে, তা অন্য কেউ করেছে। শুধু বন্ধু নন, জাহারির পড়শিরাও দাবি করেছেন, প্রতিবেশী হিসেবে অসম্ভব ভালও ছিলেন তিনি।
তবে ব্যক্তিগত জীবন স্বস্তির ছিল না। শোনা গিয়েছে, স্ত্রী-র সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেলেও কুয়ালা লামপুরের জাহারির বিলাসবহুল বাড়িতেই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতেন স্ত্রী। কিন্তু আশ্চর্য! বিমান নিখোঁজ হওয়ার ঠিক আগের দিন তিন সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন তিনি। প্রত্যাশিত ভাবেই এই ঘটনার মধ্যেও রহস্যের ইঙ্গিত পাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
তবে সন্দেহ যতই থাকুক, সবটাই তলে তলে। এমনকী, শনিবারের সাংবাদিক বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বিমানচালকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। কিন্তু জানান, যতটুকু তথ্য মিলেছে, তা থেকে পরিষ্কার, রীতিমতো উদ্দেশ্য নিয়েই সব কিছু করা হয়েছিল। এবং গোটা বিষয়টিতেই দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। অন্য দিকে, জাহারির রাজনৈতিক ক্ষোভের ছবিটাও জেনে গিয়েছেন তদন্তকারীরা। মুখে না বললেও গোপনে দু’টো আপাত বিচ্ছিন্ন সূত্রকে মিলিয়ে দিয়ে জাহারির বাড়ির তল্লাশিও নিয়েছেন তাঁরা। তাতে দু’টো ল্যাপটপ মিলেছে। কিন্তু বিমানের হদিস মিলতে পারে, এমন সূত্র মেলেনি। তদন্তকারীদের ধারণা, নিজের ব্যক্তিগত কম্পিউটারটি ককপিটে নিয়েই উঠেছিলেন জাহারি। তথ্য যা ছিল, সব সেখানেই।
এখন বিমান বেপাত্তা। জাহারিও নিখোঁজ। সত্যিটাও তাই আঁধারে। উধাও-রহস্যে তাই শুধু আসছে সন্দেহের নয়া মোড়। স্বয়ং চালক যার কেন্দ্রে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy