বালুচিস্তানের বোলান। গত ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত পাকিস্তানের এই প্রদেশ। এখানেই মঙ্গলবার যাত্রীবোঝাই জাফর এক্সপ্রেসকে অপহরণ করেন বালুচ বিদ্রোহীরা। রাতভর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চেষ্টায় এখনও পর্যন্ত ১০৪ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে চলছে পাক সেনার গুলির লড়াই। তবে মঙ্গলবারের ঘটনা নতুন নয়। অতীতেও বার বার জাফর এক্সপ্রেসকে নিশানা বানিয়েছেন বিদ্রোহীরা। প্রশ্ন উঠছে, কেন বার বার জাফর এক্সপ্রেসকে নিশানা করেন বিদ্রোহীরা?
২০১৮, ২০১৩, ২০২৪— প্রতি বারই প্রায় একই কায়দায় বালুচ বিদ্রোহীরা জাফর এক্সপ্রেসকে নিশানা করেছেন। এই এক্সপ্রেসে হামলা চালিয়েছেন। কখনও তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, কখনও তাঁরা ব্যর্থ। তবে তার পরেও জাফর এক্সপ্রেসই হয়ে উঠেছে বিদ্রোহীদের নিশানা! ২০১৮ সালে পাকিস্তানের পঞ্জাবগামী এই এক্সপ্রেসে নাশকতার ছক কষেছিলেন স্বাধীনতাপন্থী সশস্ত্র বালুচ গোষ্ঠী বিএলএ (বালুচ লিবারেশন আর্মি)-র বিদ্রোহীরা। কিন্তু সেই হামলায় অল্পের জন্য রক্ষা পায় ট্রেনটি। লাইনের উপর বিস্ফোরক রেখে ট্রেনটিকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। সেই বিস্ফোরক রিমোট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। তবে সময়ের হেরফেরে সেই যাত্রাই রক্ষা পেয়েছিল জাফর এক্সপ্রেস। ট্রেনের ২০০ ফুট দূরে রেললাইনে বিস্ফোরণ হয়।
বালুচ বিদ্রোহী ছাড়াও টিটিপি (তেহরিক-ই-তালিবান)-র জঙ্গিদেরও নিশানাতেও থাকে জাফর এক্সপ্রেস! মঙ্গলবারের হামলা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০২৩ সালে দু’বার জাফর এক্সপ্রেসে একই স্থানে দু’মাসের ব্যবধানে হামলার ঘটনা ঘটে। সেই বছর ১৯ জানুয়ারি সেই বোলানেই বালুচ বিদ্রোহীরা নিশানা করেছিলেন ট্রেনটিকে। সেটি লাইনচ্যুত হওয়ার পর বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় অন্তত ১৩ জন আহত হন। ওই ঘটনার এক মাস পর আবার বোলানেই জাফর এক্সপ্রেসকে নিশানা করেন বিদ্রোহী। বালুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা থেকে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারগামী ওই এক্সপ্রেসে হামলা চালানো হয়। মৃত্যু হয় এক জনের, আহত অন্তত ১২। শুধু জাফর এক্সপ্রেস নয়, গত বছর কোয়েটা স্টেশনে প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে। ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ২৬ জনের মৃত্যু হয়। ৪০ জনের বেশি মানুষ আহত হন।
জাফর এক্সপ্রেসে সাধারণ যাত্রী থাকে বটে, তবে বিশেষত পাক সেনার কর্মীরাই এই ট্রেন যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেন। গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বিদ্রোহীরা বালুচিস্তানে গেরিলা কৌশলের উপর নির্ভর করে নানা সময়ে নানা ‘বিদ্রোহে’র ঘটনা ঘটান। ২০১৮ সাল থেকে বিদ্রোহীদের হামলার কৌশলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। অনেক বেশি পরিকল্পিত হামলা চালাচ্ছেন তাঁরা। বেশির ভাগ সময়ই আত্মঘাতী হামলাকে বেছে নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন:
শুধু ট্রেন নয়, বিদ্রোহীদের নিশানায় থাকে যাত্রিবাহী বাসও। তাঁদের কৌশল পরিবর্তনের পর প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের অগস্টে। চিনা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে যাওয়া এক বাসে আত্মঘাতী হামলা চালান বিদ্রোহীরা। ২০১৮ সালের পর থেকে গোয়েদর, করাচি, তুরবাত, বোলানের মতো এলাকায় ১০টিরও বেশি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছেন তাঁরা।
পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বালুচিস্তান প্রাকৃতিক ভাবে সবচেয়ে সম্পদশালী। কিন্তু ধীরে ধীরে তা বেহাত হয়ে যাচ্ছে বালোচ নাগরিকদের। ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ (সিপিইসি) তৈরির পর থেকেই বিদ্রোহীরা জ্বলে উঠেছেন। এই করিডরের প্রতিবাদে বার বার তাঁরা বিদ্রোহ দেখিয়েছেন। গত অক্টোবরে মাজ়িদ ব্রিগেড (২০১০ সালে কোয়েটায় পাক সেনার হাতে নিহত বিএলএ কমান্ডরের নামে তৈরি গোষ্ঠী) করাচি বিমানবন্দরের কাছে আত্মঘাতী হামলা চালায়। চিন থেকে আগত ইঞ্জিনিয়ার এবং বিনিয়োগকারীদের একটি কনভয়কে তারা লক্ষ্যবস্তু বানায়। বিস্ফোরকবোঝাই একটি গাড়ি ঢুকে পড়ে ওই কনভয়ে। সেই বিস্ফোরণে চিনা নাগরিক এবং তাঁদের নিরাপত্তাকর্মী-সহ কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হন।
‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ (সিপিইসি) তৈরির পরে গত কয়েক বছরে বালুচিস্তানের সম্পদ আরও বেশি মাত্রায় লুট হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। সেই লুট আটকাতে এবং বালুচিস্তান নিজেদের দখলে রাখতে বার বার বিদ্রোহীরা পাক সরকার এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁদের বিদ্রোহ দমনে পাক সরকারও একের পর এক পদক্ষেপ করেছে। প্রতিবাদ দমন করতে পাক সেনা এবং ফ্রন্টিয়ার কোর বাহিনী সেখানে ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ। হামলা, পাল্টা হামলায় বার বার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাকিস্তান।