Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
US Election

আমেরিকার এ বারের ভোট এবং পুঁটিদি

আমেরিকার উত্তর-পূর্বে এখন নভেম্বরের হালকা শীতের আমেজ। আসন্ন গভীর শীতের আগে প্রকৃতি সেজে উঠেছে ‘ফল’ ঋতুর সোনালী গয়নার সাজে আর লাল কমলা হলুদ রঙের পোশাকে।

বিশ্বজিৎ সেন
মেরিল্যান্ড, আমেরিকা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৬ ১৬:০৩
Share: Save:

আমেরিকার উত্তর-পূর্বে এখন নভেম্বরের হালকা শীতের আমেজ। আসন্ন গভীর শীতের আগে প্রকৃতি সেজে উঠেছে ‘ফল’ ঋতুর সোনালী গয়নার সাজে আর লাল কমলা হলুদ রঙের পোশাকে। চারিদিকের ওক, চেরি, ম্যাপল আর অন্যান্য পর্ণমোচী গাছের পাতায় এখন রঙের আগুন। ঝরে পড়ে যাওয়ার আগে নিজেকে উজাড় করে সেজে নেওয়া শেষবারের মতো।

অবশ্য আমেরিকার অন্তরে এখন ভীষণ ভাবে চলছে অন্য দুই রঙের খেলা। ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রতীক নীল আর রিপাবলিকান দলের প্রতীক লাল রঙের যুদ্ধের উত্তেজনায় আচ্ছন্ন এখন গোটা দেশ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। উত্তেজনা-আলোচনা-তর্কবিতর্ক-নমুনা ভোট— সবই এখন তুঙ্গে। নিয়ম অনুযায়ী প্রায় দেড় বছর আগে শুরু হয়েছিল এই নির্বাচনের প্রাথমিক পর্যায়। সেই পর্যায়ে রিপাবলিকান দল নির্বাচন করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাদের দলের প্রার্থী হিসেবে। অন্য দিকে ডেমোক্র্যাটিক দল নির্বাচন করেছে হিলারি ক্লিন্টনকে। দ্বিতীয় এবং মূল পর্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু হয়েছে প্রায় চার মাস আগে। আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা। নির্বাচিত হতে চলেছেন গণতন্ত্রের অন্যতম ধারকবাহক আমেরিকার এক নম্বর জনপ্রতিনিধি।

এক জন মার্কিন নাগরিক হিসেবে এই নির্বাচনে সামিল হতে খারাপ লাগে না। জীবনের বেশিরভাগ সময় এই দেশে কাটিয়ে, এই দেশের ভাল থাকার সঙ্গে নিজেদের এবং সন্তানদের ভাল থাকাকে মিশিয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকি এই নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। ভোট দিতে যাই। ভাবতে চেষ্টা করি, আমার এই ছোট্ট অনুদানের সাগরে আমার পরের প্রজন্মের বৈতরণীতে দোলা কম লাগবে।

এই দেশের নির্বাচনের পদ্ধতি আলাদা। এ যেন সেই অন্ত-সলিলা ফল্গু নদী। না আছে রাস্তায় মিছিল, না আছে বাড়ির দেওয়ালে পোস্টার, না আছে পাড়ায় তারস্বরে মাইকে ‘ভোট দিন’ প্রচার। কট্টরপন্থীদের কয়েক জন অবশ্য নিজেদের প্রার্থীর জন্য নিজেদের বাড়ির লনে ছোট্ট পোস্টার দাঁড় করিয়ে দেন নিয়মকানুন বজায় রেখে। তার বেশি আর কিছু নয়। এই দেশে নির্বাচনের প্রচারের সিংহভাগই হয় টেলিভিশনের মাধ্যমে। প্রার্থীরা প্রচুর খরচ করে বিজ্ঞাপন দেন টিভি এবং রেডিওতে। প্রতি দিন টিভি চ্যানেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা হয় প্রার্থীদের সম্বন্ধে। নমুনা ভোট নেওয়া হয় প্রায় প্রতি দিন। সেই নমুনা ভোটের ফলাফল দেখে প্রার্থীরাও ঠিক করেন কোথায় কত খরচ করা হবে। বিত্তবানেরা কোটি কোটি ডলার দান করেন এই নির্বাচনে, সরকারি নিয়মকানুন মেনে। স্বল্পবিত্ত নাগরিকদের অবদানও কম নয়। এই ইলেক্ট্রনিক যুগে স্মার্ট ফোনে বোতাম টিপলেই ঘরের ডলার চলে যায় দলের তহবিলে। নির্বাচনের অর্থ সংগ্ৰহ এবং বিতরণ হয়ে থাকে অত্যন্ত স্বচ্ছ পরিকাঠামোর মধ্যে। প্রতি মাসে সরকারের কাছে এই রাজনৈতিক দলগুলোকে হিসেব দিতে হয়, কী ভাবে কত ডলার তারা সংগ্ৰহ এবং খরচ করেছে। কালো ডলার অথবা বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্ৰহ একেবারেই নিষিদ্ধ।

ব্যালট স্লিপ হাতে এক ভোটার ফ্লোরিডায়। ছবি: এএফপি।

এ বারেও নির্বাচনের এই ফল্গুধারার পাশে যখন বিয়ার নিয়ে বসে আছি আর উত্তেজনার আগুন পোয়াচ্ছি, সেই রকমই এক দিন পুঁটিদি ফোন করলেন। ‘কী রে বিশু, তোর তো এ বার কোনও পাত্তাই নেই। কী ব্যাপার বল তো! তুই অন্য দলে চলে গেলি নাকি রে? অবশ্য একটু পয়সা হলে সব মার্কিন বাঙালিই দল পাল্টায়।” পুঁটিদি, অর্থাৎ পুঁটিরানি সেনগুপ্ত আমার খুড়তুতো ভাইয়ের মাসতুতো দিদি। এ দেশে এসে, অনেক ডিগ্রি সংগ্রহ করেছেন। মফস্সল বাংলার সেই কলাবিনুনি আর ছাপা শাড়ির পুঁটিদি এখন আমেরিকার ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ ডাঃ প্যাটি সেন! কর্মজীবনে অনেক উন্নতি করেছেন এবং সঙ্গে ঘরসংসার সামলেছেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে প্যাটি সেন এখন সমাজসেবায় ব্যস্ত। বললাম, ‘‘কী যে বলো পুঁটিদি! আমার আবার পয়সা! আর তুমি তো জানো আমি ভোটার রেজিস্ট্রেশনের খাতায় নিজেকে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ হিসেবে নাম লিখিয়েছি।’’ জানি রে জানি! সেই জন্যই তো তোর সঙ্গে ভোটের টকঝাল গল্প করা যায়। ভাবতে পারিস, মধুছন্দা আর ইন্দ্রজিৎ এ বার অন্য দলকে সমর্থন করছে। একদম চেপে গেছিলো ব্যাপারটা। পার্টিতে আসছে যাচ্ছে-মিচকি মিচকি হাসছে-অথচ, দ্যাখ ভেতরে ভেতরে এই ব্যাপার! আমি আরও কয়েক জনকে সন্দেহ করেছি। চোখে চোখেও রাখছি তাদের। বেফাঁস কথা বলেছ তো সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে টেক্সট চলে আসবে।’’

বললাম, ‘‘পুঁটিদি, এই দেশ হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতার দেশ। যার যাকে ইচ্ছে ভোট দেবে তাতে তোমার এত রাগের কী?’’ ঠিকই বলেছিস, কিন্তু রাগ তো হয়! তবে হ্যা! এ বার মেলিন্ডা ট্রাম্প আর ইভানকা ট্রাম্পের পোশাকগুলো দেখে মন ভরে যাচ্ছে! কি অপূর্ব সব ডিজাইন! আর কি সুন্দর সব ফিগার ওদের! অন্য দিকে হিলারিও কিন্তু কম দিচ্ছে না রে! কি মিষ্টি রঙের সব প্যান্টস্যুট পড়ছে আজকাল। কচি কলাপাতা-হালকা বেগুনি-আবার কখনও একদম টকটকে লাল। চুলে আবার নানা রকম রং দিয়ে হাইলাইট করছে। কে বলবে ঊনসত্তর বছর বয়স!’’ বললাম, ‘‘পুঁটিদি, তুমি এত সমাজসেবা কর, নির্বাচনে ফান্ড রেইস কর, তুমিও কিন্তু ইলেকশনে দাঁড়াতে পারতে— কোনও ছোটখাট পোস্টের জন্য।’’ হেসে পুঁটিদি বললেন, ‘‘টিভির নির্বাচনের যুগে এটাই তো সমস্যা রে! এই টিভির যুগে কাগের ঠ্যাং বা বগের ঠ্যাং হয়ে হনহন করে হাঁটলেই লোকে কি আর তোকে ভোট দেবে? দেখিস না, আমাদের সাউথ ক্যারোলিনার গভর্নর ভারতীয় মেয়ে নিকি হ্যালিকে। কী সুন্দর পরিচর্চা করে রাখে নিজেকে! ও সব আমার দ্বারা হবে না। যাই হোক, যার জন্য তোকে ফোন করা— ভোটের দিন ভাবছি আমরা, মানে মেরিল্যান্ডের বাঙালিরা গাড়ি পার্ক করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়াব। প্রেসকে একটা স্টেটমেন্ট দেওয়া– এই আর কি! বেশ একটা দেশের মতো মিছিল মিছিল ভাব আনা যাবে, আবার বলা যাবে, দেখ আমরা আমেরিকান বাঙালিরা কেমন এক গোষ্ঠী হয়ে ভোট দিচ্ছি! তুই কিন্তু সেই দলে আছিস। তবে একটা মুশকিল হচ্ছে যে ভোট নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কোনও গান খুঁজে পাচ্ছি না। তাই ভাবছি, ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও’ দিয়ে চালিয়ে দেব। কেতন মানে তো ঝান্ডা, তাতেই হবে। হ্যাঁ রে, রোমে বাঙালিরা মাদার টেরিজার ক্যানোনাইজেশন-এর সময় কি গান গেয়ে মিছিল করেছিল? ভাবছি, সেই গানগুলোও গাইব।’’

বুঝলাম, বাঙালির বিশ্বায়নের অন্য এক স্তরের ভাবনাচিন্তা করছেন ডাঃ প্যাটি সেন। তার আগেই কেটে পড়তে হবে। বললাম, “পুঁটিদি, তুমি তো জান, আমাদের মেরিল্যান্ডে ভোটের কিছু দিন আগে থেকেই ভোট দেওয়া যায় কিছু কিছু বুথে। আমার তো আর্লি ভোটিং হয়ে গেছে।’’

আরও পড়ুন: এ কি মার্কিন ভোট, না সারা বিশ্বের!

অন্য বিষয়গুলি:

US Election Donald Trump Hillary Clinton
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE