কুড়ি বছর আগের সেই ভয়াবহ দিনটা আজও ভোলার নয়। ছবি সংগৃহীত।
প্রতিদিনের মতো সে দিনও সকাল আটটা কুড়ির ‘পাথ’ ট্রেন (পোর্ট অথরিটি ট্রান্স হাডসন-এর সংক্ষিপ্ত রূপ) ধরেছিলাম নিউ জার্সি থেকে। গন্তব্য, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার স্টেশন। সেই আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনেই রোজ নামতাম। মাটি থেকে প্রায় সাত তলা নিচু স্টেশনে নেমে উপরে ওঠায় ভরসা ছিল একমাত্র এসক্যালেটর। রাস্তায় উঠে আমার অফিস মিনিট দশেকের হাঁটা। কুড়ি মিনিটের ট্রেন সফরে কিছুই আঁচ করতে পারিনি। স্টেশনে নামার পর পরই একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ। মাথার উপর যেন ভূমিকম্প গোছের কিছু হল। বিদ্যুৎ সংযোগ তখনও কাটেনি স্টেশনের। কেউ এক জন বললেন, শিগগির স্টেশন থেকে বেরোতে হবে। উপরে কিছু একটা হয়েছে।
তখন বয়স বাড়ছে। তরুণ-তরণীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়নোর ক্ষমতা নেই। তবু যতটা দ্রুত পা চালিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করলাম। স্টেশনের উপরে রোদ ঝলমলে সেপ্টেম্বরের নিউ ইয়র্ক। রাস্তায় উঠেই দেখলাম বড় বড় সব দোকানগুলো খাঁ খাঁ করছে। কাজের দিনের সকালের ম্যানহাটনে একটা লোক নেই। এ দিকে ও দিকে প্রচুর হাই হিল। বড়সড় কোনও গোলমাল যে হয়েছে, আন্দাজ করতে অসুবিধে হল না আর। জন স্ট্রিটের রাস্তা ধরে এগোতে শুরু করেছি হঠাৎ লক্ষ করলাম মাথার উপরে আগুন বৃষ্টি হচ্ছে। আগুনের গোলা নীচে এসে পড়ছে যেন। ওই রাস্তা ধরে আর এগোতে পারলাম না। বাঁ দিকের আর একটা ছোট রাস্তা ধরার পরেই টের পেলাম কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। চোখের সামনে দেখি জ্বলছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সাউথ টাওয়ার। কালো ধোঁয়ায় ঢাকতে শুরু করেছে আকাশ।
কোনও মতে হেঁটে অফিস পৌঁছেছি। চার দিকে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গিয়েছে। তখনও আল কায়দার নাম শুনিনি। অফিসে আমাদের সংস্থার ডিরেক্টর মহেন্দ্র পটেল জানালেন, কোনও একটা বিমান ধাক্কা মেরেছে নর্থ টাওয়ারে। মনে মনে ভাবলাম বিমানের তো যাতায়াতের নির্দিষ্ট পথ রয়েছে, কী করে পথ ভুলে সেটা সাউথ টাওয়ারে ধাক্কা মারল!
এক ভারতীয় সংস্থায় কাজ করতাম তখন। অফিসে অনেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত কাজ করতেন। বিল্ডিংটা ছিল ২৭তলা। তিন তলায় ছিল আমাদের অফিস। অফিসে যখন পৌঁছলাম, টিভি চলছিল। একটু ধাতস্থ হতে না হতেই দেখলাম সাউথ টাওয়ারে এসে ধাক্কা মারল আর একটা প্লেন। টিভির পর্দায় তখন জ্বলছে একশো দশ তলার দু’দু’টো টাওয়ার। কিছু ক্ষণের মধ্যে নিউ ইয়র্কের পুলিশ বিভাগ জানাল, বিল্ডিং শিগগির খালি করে দিতে হবে। আরও হামলা হতে পারে।
রাস্তায় নেমে এলাম। চার দিকে মানুষ তখন দৌড়চ্ছে। করুণ আতর্নাদ শুনতে পাচ্ছি দু’টো টাওয়ার থেকে। চোখের সামনে এ ভাবে এত অসহায় মৃত্যু দেখতে হবে ভাবিনি। যত ওই এলাকাটা থেকে দ্রুত বেরোনোর চেষ্টা করছিলাম, নিজেকে তত অপরাধী মনে হচ্ছিল। শয়ে শয়ে মানুষ অসহায়ের মতো মারা গিয়েছিলেন। ভূমিকম্পের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য স্টিলের খাপের মধ্যে বানানো হয়েছিল টুইন টাওয়ার। দূর থেকে তাই সব সময় চকচক করত বিল্ডিং দু’টো। আগুনে পুড়ে টাওয়ার দু’টো ধসে পড়েছিল। কিন্তু ওই স্টিলের কেসিং আশপাশের বহু বহুতলকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। এমনকি টাওয়ারের একদম গা ঘেঁষে থাকা একটা কাচ ঘেরা বাগানের একটা গাছও নষ্ট হয়নি আগুনের তাপে।
রাস্তায় নেমে সহকর্মীদের সঙ্গেই হাঁটছিলাম। কী ভাবে ব্লুমফিল্ডের বাড়িতে ফিরব বুঝতে পারছি না। কারণ ফেরার একমাত্র উপায় ট্রেন তখন পুরোপুরি বন্ধ। সারা নিউ ইয়র্কের বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর সারা শরীরে উড়ে আসছে ছাই। ভিড় আর ধাক্কাধাক্কিতে সহকর্মীদের একে একে হারিয়ে ফেললাম। তার মধ্যেই শুনলাম দৌড়তে গিয়ে এক জনের হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙে গিয়েছে। দেখি তিনি আমাদেরই এক সহকর্মী। তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য একটা অ্যাম্বুল্যান্সও তখন ঢুকতে পারছে না। কোনও ক্রমে একটা বাস এল তাঁকে নিতে। ভিড়ের ধাক্কায় এক সময় দেখলাম সেন্ট্রাল ম্যানহাটনে এসে পড়েছি। সেখানে ভিড় অপেক্ষাকৃত কম। একটু দূরে একটা প্রাইমারি স্কুলে তখন ক্লাস চলছিল। দারোয়ানকে বললাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার থেকে আসছি। দারোয়ান সব শুনে ঢুকতে দিলেন। সেখানেই মুখ-হাত-পা ধুলাম। খানিক ক্ষণ বসে সঙ্গে থাকা লাঞ্চটা খেলাম। দুপুরে স্কুল বন্ধ করতে হবে। আর থাকার উপায় নেই। স্কুলের দারোয়ান বললেন, সামনে পুলিশ স্টেশন। সেখানে গিয়ে খুবই খারাপ ব্যবহার পেলাম। তারা একটা গির্জার রাস্তা বলে দিল। হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গেলাম। গির্জায় আমায় অবশ্য থাকতে দিলেন সেখানকার লোক জন। তত ক্ষণে টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে অফিসের মিস্টার কপূরের নম্বর জোগাড় করেছিলাম। জানতাম উনি নিউ ইয়র্কেই থাকেন। সেই সময়ে মোবাইলের ব্যবহার চালু হলেও আমার কাছে ছিল না। গির্জা থেকে মিস্টার কপূরকে ফোন করেছিলাম। ওঁর স্ত্রী ফোন ধরলেন। বললেন ওঁদের বাড়ি চলে আসতে। কিন্তু যাব কী করে, সব কিছু বন্ধ। গির্জা থেকে রাতের দিকে আমায় বলা হল, বাস চলছে। সেই বাসে করে কোনও মতে কপূরদের সেন্ট্রাল পার্কের কাছের সেই বাড়ি পৌঁছলাম। রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। ওঁরা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি অসময়ে যাওয়ায় আতিথেয়তার ত্রুটি রাখেননি অবশ্য। ছোট অ্যাপার্টমেন্ট। তার মধ্যেই ওঁরা আমায় শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। রাতে খেলাম রাজমা-রুটি আর টক দই। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরের দিন সকালে শুনলাম পাথ ট্রেন চলছে। কপূরদের বাড়ির কাছের একটা স্টেশন থেকে সোজা নিউ জার্সি। বাড়ি ফিরে দেখলাম ল্যান্ড ফোনের আন্সারিং মেশিনে উপচে পড়ছে মেসেজ। প্রচুর আত্মীয়-স্বজন আমাকে ফোন করেছেন। তাঁরা জানতেন ওই সময়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছেই আমি অফিসে যাই। তাঁদের একে একে ফোন করলাম, জানালাম ঠিক আছি।
তবে জীবন আর এক ছিল না তার পর থেকে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আগুন জ্বলেছিল প্রায় ছ’সপ্তাহ ধরে। ওই ধ্বংসস্তূপ সরাতে সময় লেগেছিল প্রায় ছ’মাস। ১৯৮২ সালে প্রথম আমেরিকায় গিয়েছিলাম। কিন্তু ২০০১ সাল সব কিছু ওলটপাল্ট করে দিয়েছিল যেন। অফিস যাওয়ার পরিচিত পথ পাল্টে গিয়েছিল। বেশ কিছু দিন পরে তৈরি হয়েছিল বিকল্প রাস্তা। নিউ ইয়র্কের প্রায় ২০০ মাইল দূরের পেনসিলভেনিয়া থেকেও দেখা যেত টুইন টাওয়ার। এখন ওই জায়গায় যে বিল্ডিং হয়েছে, সেটা অত উঁচু নয়। নিরাপত্তার জন্যই। বহু দূর থেকে তাই মাথা উঁচিয়ে নিজের অস্তিত্বও জানান দেয় না আর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy