সুসের সমুদ্র সৈকতে ফুল দিয়ে গিয়েছেন স্বজনহারারা। ছবি: এএফপি।
পালাও... দোহাই তোমার পালাও। বাচ্চাদের বোলো, আমি ওদের খুব ভালবাসি।
কথাগুলো মাথার মধ্যে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে ২৬ বছরের ব্রিটিশ তরুণী সারা উইলসনের। গত ২৪ ঘণ্টা তিনি ঠায় বসে রয়েছেন হাসপাতালের একটা চেয়ারে। যদি একটা ভাল খবর আসে...। ওই হাসপাতালেরই জরুরি বিভাগে ভর্তি রয়েছেন তাঁর প্রেমিক ম্যাথিউ জেমস। গত কাল সুসের সমুদ্র সৈকতে বন্দুকবাজের ছোড়া তিন-তিনটে গুলি ঢুকে যায় ম্যাথিউয়ের শরীরে। যেমনটা হয়তো হওয়ার ছিল সারার সঙ্গেই। শেষ মুহূর্তে সারাকে দু’হাত দিয়ে আগলে সামনে এসে দাঁড়ান ম্যাথিউ। ‘‘আমি ওঁর জন্যই বেঁচে আছি এখনও,’’ বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তরুণী।
একঘেয়ে জীবনে একটু গতি আনতে দু’সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দু’জনে চলে এসেছিলেন তিউনিসিয়ার সৈকত শহর সুসে। বাচ্চাদের রেখে আসেন মা-বাবার কাছে। সমুদ্রের একেবারে কোল ঘেঁষে, তাই খুব মনে ধরেছিল তিন তারা বেলভিউ হোটেলটা। তখনও জানতেন না, কী ঘটতে চলেছে।
কাল বেলা বারোটা। সামনেই ভূমধ্যসাগরের নীল জল। ছুটির মেজাজ। হোটেলের সামনেই বালির উপর আধশোয়া হয়ে সূর্যস্নান করছিলেন দু’জনে। হঠাৎই কানে এল বন্দুকের আওয়াজ। ক্রমশ জোরে। সারার কথায়, ‘‘খুব স্পষ্ট মনে আসছে না। গাঢ় রঙের পোশাক পরা একটা লোককে দেখেছিলাম বেপরোয়া ভাবে গুলি চালাতে। এ দিকে ও দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত দেহ। হঠাৎই আমাকে আড়াল করে দাঁড়াল ম্যাথিউ। ওঁর শরীর থেকে ঝরে পড়ছিল রক্ত। চিৎকার করতে থাকে, ‘পালাও’...।’’
এক দিকে ম্যাথিউ। আর অন্য দিকে দুই সন্তান, ছ’বছরের টেগান ও ১৪ মাসের ক্যাডেন। বাচ্চা দু’টোর মুখ চেয়ে হোটেলের দিকে দৌড় লাগান সারা। বালির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেহগুলো টপকে টপকে যেতে থাকেনি। ফের একটা ধাক্কা। হোটেলে ঢুকেই শোনেন আতর্নাদ। পুলের জলে ভাসছে দেহ। চার দিকে রক্ত।
দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে একটা টাওয়েল কাবার্ডে ঢুকে পড়েন সারা। বললেন, ‘‘আলমারির ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে কারা যেন হেঁটে যাচ্ছে। আর সব ছাপিয়ে আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি।’’
কিছু ক্ষণ পরে সব শান্ত হল। আলমারি থেকে বেরিয়ে এলেন সারা। শুরু হল আতঙ্কের পরবর্তী অধ্যায়। ‘ম্যাথিউ কি বেঁচে আছে?’ খোঁজ শুরু। তত ক্ষণে ছুটে এসেছে পুলিশ-প্রশাসন। সাদা চাদর দিয়ে তারা ঢেকে দিয়েছে পড়ে থাকা দেহগুলো। ওই চাদরগুলো সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকেন সারা। এক রকম ধরেই নিয়েছিলেন, ও ভাবেই হয়তো দেখতে পাবেন ম্যাথিউয়ের নিথর দেহটা। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পরেও খোঁজ মেলেনি প্রেমিকের। এ দিকে ভাল করে কথাও বলতে পারছেন না কারও সঙ্গে। স্থানীয় লোক কিংবা পুলিশ, কেউই ভাল ইংরেজি জানেন না। হঠাৎই তাঁর হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন উদ্ধারকারী দলের এক জন। ফোনের ও পারে ম্যাথিউ। ভেসে এল, ‘‘আই লাভ ইউ।’’ তার পর থেকেই সারা ঠায় বসে হাসপাতালের ওই চেয়ারটাতে। একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে মধ্য তিরিশের যুবকের। অস্ত্রোপচার করে গুলি বার করা হয়েছে ম্যাথিউয়ের,তবে অবস্থা গুরুতর।
অলিভিয়া লিথলের কাহিনি তুলনায় ভাল। ম্যাঞ্চেস্টারের তরুণী ছুটিতে সুস এসেছিলেন। ঘটনার সময় তিনি হোটেলে একটা ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন। হঠাৎ গুলির আওয়াজ পান। ছুটে যান বারান্দায়। আবার গুলির শব্দ। এ বার কাছেই। এ দিকে বাবার ফোন এসেছে। ফোন কানে নিয়ে ছুটতে শুরু করেন অলিভিয়া। যেন মৃত্যু পিছু ধাওয়া করেছে। ছুটতেই ছুটতেই বাবাকে বলতে থাকেন, ‘‘তোমায় খুব ভালবাসি বাবা।’’ বেঁচে গিয়েছেন অলিভিয়া।
সমুদ্রের ধারে সার দিয়ে রাখা সান বেডগুলোর শেষটাতে শুয়েছিলেন এলি মেকিন। বললেন, ‘‘ছাতার আড়াল থেকে বন্দুক বার করে আনল লোকটা। তার পরই ডান দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালানো শুরু করল ও। যদি কোনও ভাবে বাঁ দিকে তাক করত... আমি শেষ হয়ে যেতাম।’’
‘গান’ আর ‘রান’। এই শব্দ দু’টো শুধু শুনতে পেয়েছিলেন ডেবি হর্সফল। হোটেলের দিকে দৌড়তে শুরু করেন তিনি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই শুনতে পান নীচের তলায় গুলি চলছে। বললেন, ‘‘যদি সিঁড়ি দিয়ে না উঠে লবিতেই কোথাও লুকোতে যেতাম, তা হলেই সাক্ষাৎ হয়ে যেত মৃত্যুর সঙ্গে।’’
বেঁচে ফিরেছেন ডেবি। অক্ষত আছেন অলিভিয়া, এলি, হর্সফলও। সারা উইলসন এখনও ম্যাথিউয়ের অপেক্ষায়। হয়তো মৃত্যুকে হারিয়ে ফিরে আসবেন টেগান ও ক্যাডেনের বাবাও। তাঁদের সঙ্গেই বেঁচে থাকবে, ‘সন্ত্রাসের শুক্রবার’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy