শেখ হাসিনার বাসভবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার ঢাকায় বাপি রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।
হাসিনা-মমতার বৈঠকে তিস্তার জলচুক্তির বিষয়টি সেই আশার কথাতেই ঝুলে রইল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বললেন, স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে তিনি আপত্তি তুলে নিয়েছেন। বিষয়টির অগ্রগতি হয়েছে। শীঘ্রই ছিটমহল বিনিময়ের কাজ শুরু হবে। তিস্তার জলবণ্টন চুক্তির বিষয়টি নিয়েও তিনি ভেবে দেখবেন।
আজ নিজের বাসভবনে মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের ভূরিভোজে আপ্যায়ন করলেও জলাভাব নিয়ে একাধিক বার টিপ্পনি করতে ছাড়েননি হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি ‘গণভবন’-এ আজ ভোজের তালিকায় ইলিশের অন্তত পাঁচটি পদ ছিল। তা দেখে মমতা হেসে হাসিনাকে বলেন, “ইলিশ মাছ পাঠানো আটকে রেখেছেন কেন? আমরা খেতে পাচ্ছি না!” ও বাংলার নেত্রীর হাজির জবাব, “তিস্তার পানি আটকে দিলে কী ভাবেই বা ইলিশ মাছ ভেসে আপনাদের ওখানে যাবে! পানি দেন, ইলিশও যাবে।” এতটুকু অপ্রতিভ না-হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চটজলদি উত্তর, “ইলিশ তো পদ্মা নদীর ব্যাপার। তিস্তার জলে আর ইলিশ কোথায়!”
বৈঠকের পরে রসিয়ে রসিয়ে এই ‘তিস্তারঙ্গের’ কথা জানালেন খোদ মমতাই। শেখ হাসিনা ইলিশ রফতানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কবে তুলবেন, সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা অবশ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু দেব, ব্রাত্য বসু, নচিকেতা, মুনমুন সেন-খচিত মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি দলকে আজ ইলিশে মাত করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। কালি জিরা চালের ভাত, সব্জি ডাল, বিভিন্ন ধরনের তরকারির সঙ্গে ছিল ভাপা ইলিশ, ইলিশ ভাজা, সর্ষে ইলিশ, ইলিশের ডিম ভাজি, ইলিশের তেল, চিতলের মুইঠ্যা, রূপচাঁদা ভাজা, রুই কালিয়া, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, খাসির মাংসের রেজালা, মুরগির ভুনা। সবার শেষে কুমিল্লার রসমালাই ও মিষ্টি দই।
স্বল্পাহারী মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “কত মাছ যে উনি রাঁধিয়েছিলেন, সে কী বলব! আমরা কি অত খেতে পারি?” ‘পাগলু’ নায়ক দেব তো ঢেঁকুর তুলে জানিয়ে দিলেন, তিন দিন শুধু ইলিশের উপরেই রয়েছেন! ফেরার আগে করুণ মুখে নায়ক বললেন, “আর খেতে পারছি না! সত্যি বলছি!”
বাংলাদেশের এই প্রবাদপ্রতিম আতিথেয়তায় মুগ্ধ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিরা। এর আগে অর্থমন্ত্রী হিসেবে যখন প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তখন তাঁকে নিজে রেঁধে পাঁচ রকম মাছ খাইয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এ বারেও সেই উষ্ণতার খামতি দেখা যায়নি। হাসিনা-মমতার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। নব্বইয়ের দশকে বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে যখন নয়াদিল্লি সফরে এসেছেন হাসিনা, তখন অশোকা হোটেলে গিয়ে গোটা রাত গল্প করেছেন মমতা। আজ দীর্ঘদিন বাদে দু’জনের দেখা হল। হাসিনা মমতাকে বলেছেন, “তুমি এত রোগা হয়ে গিয়েছ কেন? এত কাজের চাপ?” মমতা তাঁকে বলেছেন, “আপনি কিন্তু একই রয়েছেন।”
দুই নেত্রীর মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মেই শাড়ি বিনিময় হয়েছে!
মমতা ধানের শিষ দিয়ে তৈরি একটি ফ্রেমে বঙ্গবন্ধুর ছবি আজ উপহার দিয়েছেন হাসিনাকে। হাসিনাও বিনিময়ে মমতাকে দিয়েছেন একটি নৌকো। সঙ্গে ফাউ হিসেবে টিপ্পনি, “তিস্তায় পানি বইলে তবেই কিন্তু এই নৌকো চলবে!”
প্রশ্ন হল, তিস্তা চুক্তি নিয়ে ‘ভেবে দেখব’ বলে মমতা এই যে মৌখিক আশ্বাস দিয়ে এলেন, তা কার্যকরী হবে কবে?
মমতার বিমান ধরার পরে বাংলাদেশ সরকারের এক কর্তা খানিকটা হতাশা নিয়েই বললেন, “ভেবে দেখার জন্য তো চার বছর সময় নিলেন! আগের দিন বলেছিলেন আস্থা রাখুন, হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সমাধান মিলে যাবে। তার পরেও তিনি নতুন কথা তো কিছু শোনাতে পারলেন না আমাদের!”
তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি কবে হবে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। মমতা আজ হাসিনাকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তড়িঘড়ি তিস্তা সমস্যার সমাধান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলেও চাষআবাদের একটা বড় অংশ তিস্তার জলের ওপরে নির্ভরশীল। পরে দু’দেশের বাণিজ্য-কর্তাদের সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিশদে মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “আপনারা কি চান আমি এক বার এসেই সব সমাধান করে চলে যাই! স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান তো হয়েছে। তিস্তা নিয়েও ইতিবাচক পরিবেশে কথা শুরু হল। আপনাদের যে জল চাই, সেটা আমি বুঝি।” মমতা
জানান, তিস্তার জল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও কিছু সমস্যা রয়েছে। শুখা মরশুমে জলই থাকে না উত্তরবঙ্গে। জলই যদি না থাকে, তা হলে সেটা দেওয়া যাবে কী ভাবে!
তবু তিস্তা নিয়ে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করছেন ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা। এই আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু হওয়াতেই তাঁরা খুশি। তাঁদের কথা, এমনটা নয় যে মমতা তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে তাঁর মূল আপত্তির জায়গা থেকে সরে গিয়েছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক এই যে আলোচনা শুরু হল, তা থেকেই একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে তাঁরা আশাবাদী। এই আলোচনাকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই ব্যাখ্যা করছে বিদেশ মন্ত্রক।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশন সূত্রে জানানো হয়েছে, মমতা-হাসিনার বৈঠককে সামনে রেখে এ বার পরবর্তী ধাপের জন্য অগ্রসর হবে বিদেশ মন্ত্রক। এর পর কেন্দ্রের সঙ্গে নতুন করে তিস্তা নিয়ে আলোচনা শুরু করবে পশ্চিমবঙ্গ। গোটা সফরে ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ সারন যে ভাবে ছায়ার মতো মমতার সঙ্গে ঘুরলেন, তাতে বুঝতে অসুবিধা নেই আগামী দিনে মমতা-কেন্দ্র আলোচনায় তিনিই হতে চলেছেন প্রধান মধ্যস্থ। পঙ্কজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল এই মার্চে। কিন্তু এই বছরটা তাঁকে ঢাকাতেই থেকে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সন্দেহ নেই, চার বছর বদ্ধ থাকার পরে তিস্তার জল গড়াতে শুরু করল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy