বাবা সুভো ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাবেকি রীতিনীতির বাঁধানো রাস্তা ছেড়ে নিজের মতো করে পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। লেখালিখি, আঁকা থেকে শুরু করে শিল্পকলা সংগ্রহ— সব কিছুতেই নিজস্বতা তৈরিতে ছিল তার নিরন্তর প্রয়াস। পূর্ব-পশ্চিমের সেতু রচনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অক্লান্ত। তাঁর গানে, লেখায়, ছবিতে তার আভাস ছড়ানো। সুভো ঠাকুরের কনিষ্ঠ সন্তান এবং সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রপৌত্র নিউইয়র্কবাসী সুন্দরম একই সঙ্গে দুই ধারাকে নিজের মতো করে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তিনি অবশ্য তার ক্যানভাসটাকে আরও বিস্তৃত করেছেন। তাঁর আগ্রহ শিল্পকলায় বিম্বিত বিশ্বায়নে। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা যে কয়েকজন সেরা স্থপতি উপহার দিয়েছে বিশ্বকে, তাদের অন্যতম লুইস কান-কে নিয়ে সুন্দরমের নির্মীয়মাণ তথ্যচিত্র ‘লুই কান’স টাইগার সিটি’ এক অর্থে সেই মহান ব্রতেরই এক বৃহত্তর সংযোজন।
এ হেন শিল্পরসিক তথা শিল্প-ইতিহাসবিদের ইট-কংক্রিট-সিমেন্টের শিল্পীর কাজে আকৃষ্ট হওয়া খুব আশ্চর্যের হয়তো নয়। যদি ছাত্রজীবনেই সেই স্থপতির কাজের সঙ্গে পরিচয়টুকু ঘটে যায়। সুন্দরমের ক্ষেত্রে ঘটেছিল সেটাই। আশির দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ নিতে গিয়ে প্রথম জানতে পারেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের স্থাপত্যভাবনা তথা লুইস কানের স্থাপত্যরীতির সম্বন্ধে। বাংলাদেশ ঘুরে আসার জন্য একটি বৃত্তিও পান। স্বপ্ন লালিত হয় সেই সময় থেকেই। কিন্তু ছবি বানানোর কৃৎকৌশল তো জানতেন না সুন্দরম। ভর্তি হলেন নিউইয়র্কের ফিল্মমেকিং স্কুলে। ২০০০ সাল থেকে শুরু হয়েছিল তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ। এর জন্য পৃথিবীর যেখানে যেখানে কানের কাজ রয়েছে, সেখানেই গিয়েছেন সুন্দরম। জন্মস্থান এস্তোনিয়া থেকে শুরু করে ইতালি, ফ্রান্স-সহ মোট ১৪টি দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাঁকে।
আরও পড়ুন:
দুধ খেতে গিয়েই বিষম, গ্রেফতার শেরিনের বাবা
ম্যানিকুইন না সংরক্ষিত মৃতদেহ: বিতর্ক, বিস্ময় বাড়াচ্ছে মেক্সিকোর দোকান
সুন্দরমের এই তথ্যচিত্র বাংলাদেশের জাতীয় সংসদভবন চত্বর বা শের-ই-বাংলা নগরে আন্তর্জাতিক এই স্থপতির শিল্পচেতনার মধ্যে মিশে থাকা আধ্যাত্মিকতা কী ভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তা দেখানো হয়েছে। প্রাকৃতিক আলোকে কাজে লাগিয়ে এই বিশাল ভবনের ভেতরে যে স্থাপত্য-দর্শনের জন্ম দিয়েছেন কান, তারই সন্ধান করেছেন সুন্দরম। তাঁর নিজের কথায়, ‘শের-ই-বাংলা নগরে কান যে নিজস্ব স্থাপত্যরীতি প্রয়োগ করেছেন, তাকে বলা যেতে পারে মুঘল এবং বৌদ্ধ স্থাপত্যরীতির আধুনিক সংস্করণ। ইট কংক্রিটের আধুনিক ভাষায় আধ্যাত্মিকতাকে এ ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারার মধ্যেই কানের প্রতিভা।’
এই ভবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসটুকুও তুলে আনতে ভুল করেননি সুন্দরম। উপমহাদেশের সেই সময়কার রাজনীতি এর উপর কী ভাবে ছায়া ফেলেছিল, সুন্দরমের গবেষণালব্ধ তথ্যে তা পরতে পরতে উঠে এসেছে। কিন্তু ওর উপরেও রয়েছে সুন্দরম কী ভাবে লুইস কানে আকৃষ্ট হলেন এবং এই মানুষটাকে তাঁর স্থাপত্যে আবিষ্কার করলেন সেই গল্প।
শিল্পকলা সুন্দরমের রক্তে। সেই সঙ্গে রয়েছে বাবার মতোই উদ্যোগ। নিউ ইয়র্কে দু-দু’টি আর্ট গ্যালারি তাঁর নিজের নামেই। ‘সুন্দরম টেগোর গ্যালারি’। হংকং এবং সিঙ্গাপুরে রয়েছে আৱও দু’টি। বিশ্ব শিল্পকলার খোঁজখবর করতে গোটা পৃথিবীই চষে বেড়াতে হয় তাঁকে। তবে মাটির সঙ্গে যোগাযোগ এখনও ছিন্ন হয়নি। চৌরঙ্গি এবং রাসেল স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে সত্তরের দশকের অশান্ত সময়ে তাঁর পরিবার কলকাতা ছেড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র সুন্দরমের পড়াশোনা শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে। নিউইয়র্কে চার দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে দেওয়া সুন্দরমের আশা, এ বছরের শেষ নাগাদ তথ্যচিত্রের কাজ পুরোপরি শেষ হয়ে যাবে। আগামী বছরের গোড়া থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনি ছবিটি পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থার রস গ্যালারির যে হলটিকে সুন্দরম তাঁর সাম্প্রতিক তথ্যচিত্রের রাফ্ কাট দেখানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন, তার উপরের এক শ্রেণিকক্ষে দু’দশকেরও বেশি সময় অধ্যাপনা করেছেন বিশ্ববিশ্রুত স্থপতি লুইস কান। আমেরিকার যে শহরে বসে তা দেখা গেল সেই ফিলাডেলফিয়া লুইসের নিজের শহর। যদিও বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার অন্যতম সেরা এই স্থপতির জন্ম এস্তোনিয়ার এক ইহুদি পরিবারে। রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের যুদ্ধে রুশবাহিনীতে যোগ দিতে হবে, এই আশঙ্কায় সপরিবারে দেশছাড়া হয়েছিলেন লুইসের বাবা। অল্প বয়সে অর্থ উপার্জনের জন্য নির্বাক চলচ্চিত্রের সঙ্গে পিয়ানো বাজাতেন কান। প্রথম জীবনের সেই ঝঞ্ঝা এবং পরবর্তী জীবনের গ্রিস এবং রোমের স্থাপত্যরীতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়াই তাঁর স্থাপত্যরীতিকে নিজস্বতা দিয়েছিল বলে মনে করা হয়।
কানের বহু কীর্তির মধ্যে বাংলাদেশের সংসদ ভবনটিকে তাঁর ‘ম্যাগনাম-ওপাস’ বলা হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে লুইস কান তার আগেই তৈরি করেছেন অমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের আধুনিক ভবনগুলি। নেপাল, শ্রীলঙ্কাতেও রয়েছে তাঁর স্থাপত্য নিদর্শন।
১৯৭৪ সালে ভারত থেকে দেশে ফিরছিলেন কান। ম্যানহাটনের পেনসিলভ্যনিয়া স্টেশনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় কানের। সঙ্গে কেউ ছিলেন না। তিন দিন দেহ পড়ে থাকে মর্গে। দাবিদার নেই। সে সময় তাঁর মাথার উপর বিপুল ঋণের বোঝা। তার চেয়েও আশ্চর্যের, বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা তাঁর তিনটি পরিবারের অস্তিত্ব যার সদস্যেরা পরস্পরের কাছে অচেনা। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ কানের মৃত্যু সংবাদে তাঁর এক মেয়ের কথাই শুধু উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০০৩ সালে তাঁর আর এক ছেলে নাথানিয়েল কান একটি তথ্যচিত্রে ছেলের চোখে বাবার বিভিন্ন কাজের অন্তর্নিহিত দার্শনিকতার সন্ধান করেন। অস্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছিল সেই ছবি। কানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও সেই ছবিতে আলোকপাত করা হয়।
এবার পূর্ণদৈর্ঘের কাহিনিচিত্রে হাত দেওয়ার ইচ্ছে সুন্দরমের। চলছে গল্প সন্ধান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy