Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Bangladesh

জামায়াতের মুখে ন্যায়ের কথা, বার্তা নয়াদিল্লিকে

অনেক ব্যস্ততার মধ্যেই সময় দিলেন, জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন সাংসদ তথা সহকারী সাধারণ সম্পাদক এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ। উষ্ণভাবে খোঁজখবর নিলেন, ঢাকায় কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না।

উত্তপ্ত ঢাকার পরিস্থিতি।

উত্তপ্ত ঢাকার পরিস্থিতি। —ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
ঢাকা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:৪৮
Share: Save:

ইসলামাবাদ অথবা লাহোরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে বারবার, ঢাকায় গত দেড় দশকে তা কখনওই হয়নি। রাত ১২টার সময়ে ‘পুরান ঢাকায়’ হইহই করে কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়ে, ভিড় রাস্তায় আড্ডায় মেতেছি, নজরদারির প্রশ্নই নেই। এমন ছবিতেই ঢাকাকে মানিয়েছে সব সময়। অন্তত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে, যত বার বাংলাদেশে এসেছি। রাস্তায় আক্রান্ত হওয়ার কথা মাথাতেই আসেনি কারও, যতই কম-বেশি ভারত বিরোধিতা বা তিস্তা চুক্তি নিয়ে মালিন্য থাকুক না কেন সে দেশে।

কিন্তু এ বার শহীদ তাজউদ্দিন অ্যাভিনিউয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলের লবিতে দু’জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি, আমরা যাওয়ার পর থেকেই, ঠায় বসে অভিনিবেশের সঙ্গে মোবাইল ঘাঁটছেন সকাল থেকে রাত। শুধু আমাদের ঢোকা বা বেরোনোর সময় উদাসীন মুখে তৎপর, স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠছেন, যেন জরুরি কাজ মনে পড়ে গিয়েছে! পিছনে না ফিরেও বোঝা যায় কাওরান বাজারের গলি থেকে উত্তরার ভিড়াক্রান্ত মেট্রো স্টেশনে, আমাদের পিছনে তাঁদের ছায়া রয়েছে।

এ ছাড়া উপায়ও নেই। কারণ জুলাইয়ের পরে এখানে যে কোনও সময় যা কিছু ঘটতে পারে, মেনে নিয়েছেন সাধারণ মানুষ। ভোটের যত বিলম্ব হবে, ততই অনিশ্চিত হবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক স্বর। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে তিন মাস অতিক্রান্ত। রাজনৈতিক নেতাদের দাপটের চিহ্ন কিন্তু নেই কোথাও। যদি থাকে তা হল জামায়াতে ইসলামীর চূড়ান্ত ব্যস্ততা এবং সক্রিয়তা। এই জামায়াত নতুন অবতারে অবতীর্ণ, তার স্বর মোলায়েম, সব ধর্মকে নিয়ে চলার বার্তা দিচ্ছে ঘনঘন। ভারতের প্রতি ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা’-র কথা বলেছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। তাঁর দলের এখন এটাই মুখের লব্জ। তারা ক্ষিপ্র, তৎপর, সুযোগসন্ধানী। ইসলামি দলগুলিকে এক মঞ্চে শামিল করতে ছুটে বেড়াচ্ছেন নেতারা। বিবদমান ইসলামি দলগুলিকে নিয়ে আলাদা করে সভা করছেন। তুখোড় কূটনীতিকের মতো সাউথ ব্লককে বলছেন, “আপনার স্বভাব বদলান, তা হলে প্রতিবেশী বদলানোর দরকার পড়বে না।’’ বাংলাদেশের জমানা পরিবর্তনের পর এখনও হতভম্ব ভাব না-কাটা ভারতের এর উত্তরে মৌন থাকা ছাড়া আপাতত রাস্তাও নেই।

অনেক ব্যস্ততার মধ্যেই সময় দিলেন, জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন সাংসদ তথা সহকারী সাধারণ সম্পাদক এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ। উষ্ণভাবে খোঁজখবর নিলেন, ঢাকায় কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। আরও বেশি দিন কেন থাকলাম না, তা হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে গিয়ে এখনকার ‘শান্তির’ পট স্বচক্ষে দেখে আসা যেত, সেই আফশোসও করলেন। সেই সঙ্গে নতুন করে যেন ঝালিয়ে নিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসটাও। “স্বাধীনতার পরে গত তিপান্ন বছরে এই দেশ বহু উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। গত ১৫ বছরের শাসনে চলেছে স্বৈরতন্ত্র। দেশের অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়ে ছড়িয়েছে দুর্নীতি। সামাজিক ন্যায়, সাম্য, বৈষম্য দুরীকরণের ধারণা নিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু সরকার গত দশ বছরে তাকে উল্টেপাল্টে ফেলতে চেয়েছে।” তাঁর কথায়, “জামায়াত সবচেয়ে নিপীড়িত হয়েছে এই জমানায়। আমরা বারবার নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় ছিলাম। আমাদের সম্পর্কে মিথ্যা ভাষ্য তৈরি করে ১৫ বছর দলীয় অফিস বন্ধ করে রেখেছে। ২০০৯ সালে শেষ দলীয় কার্যালয় খুলেছি। তার পরে ’২৪-এর ৫ অগস্ট নিজেদের ঘরে গিয়ে বসেছি। আমাদের নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।”

জামায়াত নেতৃত্বের বক্তব্য, এই আন্দোলন ‘সামাজিক আন্দোলন’, ভুক্তভোগী মানুষের ‘আবেগ’ থেকেতৈরি। এই অন্তর্বর্তী সরকার ‘জনগণের আকাঙ্ক্ষার’ প্রতিফলন। জামায়াতের কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ঢাকায় আসার পর থেকে শোনা মানবাধিকার কর্মী তথা কবি ফরহাদ মজহারের প্রচারিত তত্ত্বের। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পরে যিনি ’৭২ সালের সংবিধানের সব থেকে বড় সমালোচক হিসেবে আসরে নেমেছেন। তাঁর কথায়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে অর্থাৎ বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব এবং গণতন্ত্রের নামে এত দিন পেটি বুর্জোয়ারা ভোটের হিসাবনিকাশ করে গিয়েছে। নিজেদের ক্ষমতার একটি অস্ত্র হিসেবে সংবিধানকে ব্যবহার করেছে। মুজিববাদ হিসেবেই এই সংবিধানকে দেখতে হবে এবং ফেলে দিতে হবে। মাদ্রাসায় পড়া লাঞ্চিত হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীই প্রতিনিধিত্ব করবে দেশের।ইউনূস সরকারের গড়া কমিটিগুলির কাছে ১০ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিরেখেছে জামায়াতে। গুঞ্জন, সেই দাবিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে টিম ইউনূস। জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমানের কথায়, “এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।”

সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে জামায়াতের দাবি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার বিধান সংযুক্ত করতে হবে। একই ব্যক্তি পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। এ ছাড়া আইন ও বিচারব্যবস্থা, সংসদ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, পুলিশ, গণপ্রশাসন, শিক্ষা, বিদেশনীতির আমূল সংস্কার চাইছেন আমীর। দাবি, পাঠ্যপুস্তকে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি, সব শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিরোধী উপাদান বাদ দিতে হবে। দাবি, গত সাড়ে ১৫ বছর যারা র‌্যাবে কাজ করেছেন, তাঁদের স্ব-স্ব বাহিনীতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাঁদের পুনরায় র‌্যাবে নিয়োগ করা যাবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে স্থায়ীভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে।

এই সব দাবির প্রধান লক্ষ্যমুখ, আওয়ামী লীগ যাতে অদূর ভবিষ্যতে যাতে মাথা না তুলতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও বলছেন শেখ হাসিনার দল ‘ফ্যাসিস্ট দল’। তাদের হাতে ‘রক্ত’ লেগে। সংস্কার কমিটিগুলি যখন সর্বদলীয় বৈঠক করবে তখন আওয়ামী লীগকে ডাকার প্রশ্নই নেই। হয়তো তার আগেই দলকে নিষিদ্ধ করা হবে। কিন্তু যে প্রশ্নটা রাজনৈতিক বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল, জামায়াতের এই সব দাবি অনুসরণ করে সংস্কার হলে,বিএনপি-র হাতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার খুব বেশি অস্ত্র থাকবে না। কিন্তু আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই তাঁদের।

(চলবে)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy