হক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হক্কানি হয়েছেন কার্যনির্বাহী অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী।
বিস্তর টালবাহানার পরে শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করল তালিবান। কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন মোল্লা মহম্মদ হাসান আখুন্দ। দোহায় তালিবানের রাজনৈতিক দফতরের চেয়ারম্যান মোল্লা আব্দুল গনি বরাদরকে কার্যনির্বাহী উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে।
অন্য তালিব নেতাদের তুলনায় কম পরিচিত মুখ হলেও আখুন্দের নাম রয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের জঙ্গি-তালিকায়। বিশেষ সূত্র উদ্ধৃত করে একটি পাক দৈনিকের দাবি, নয়া সরকারের প্রধান হিসেবে আখুন্দের নাম প্রস্তাব করেন তালিবানের সর্বোচ্চ নেতা হিবাতুল্লা আখুন্দজ়াদা স্বয়ং। হিবাতুল্লাকে ইরানের কায়দায় দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার পদে বসিয়ে তাঁর অধীনে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তালিবান সরকার গড়বে বলে শোনা যাচ্ছিল। তাঁর ভূমিকা নিয়ে আজ কোনও ঘোষণা করেনি তালিবান। তবে হিবাতুল্লা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছি, এঁরা (নতুন মন্ত্রীরা) দেশে শরিয়া আইন এবং ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে কঠোর পরিশ্রম করবেন। দীর্ঘমেয়াদি শান্তি, শ্রীবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন তাঁরা। কেউ যেন দেশ ছাড়ার চেষ্টা না করেন। ইসলামি আমিরশাহিতে কাউকে নিয়েই কোনও সমস্যা নেই।’’
গত ২০ বছর ধরে তালিবানের নীতি-নির্ধারক পরিষদ ‘রেহবারি শুরা’-র প্রধানের পদে রয়েছেন আখুন্দ। তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের সহযোগী এবং হিবাতুল্লার ঘনিষ্ঠ বলেই তিনি পরিচিত। কন্দহরের এই নেতা তালিবানের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই সংগঠনে রয়েছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবানের আগের জমানায় বিদেশমন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদেও ছিলেন তিনি।
হক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজুদ্দিন হক্কানি হয়েছেন কার্যনির্বাহী অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী। পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজ়িরিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সিরাজুদ্দিনের সঙ্গে তালিবান এবং আল কায়দার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এফবিআইয়ের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় থাকা তাঁকে ধরতে আমেরিকা ৫০ লক্ষ ডলার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। কাবুল দখলের পরে তালিবান বলেছিল, আমেরিকা-সহ সব দেশের সঙ্গেই তারা সুসম্পর্ক চায়। কিন্তু হক্কানি মন্ত্রী হওয়ায় সেই ঘোষণার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল, যেখানে তালিবানকে জঙ্গি-সংস্রব ছাড়তে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
কার্যনির্বাহী প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছেন হিবাতুল্লার শিষ্য এবং মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা মহম্মদ ইয়াকুব। কার্যনির্বাহী বিদেশমন্ত্রী হয়েছেন আমির খান মুত্তাকি, উপ-বিদেশমন্ত্রী শের মহম্মদ আব্বাস স্তানিকজ়াই, কার্যনির্বাহী অর্থমন্ত্রী হেদায়েতুল্লা বদ্রি। অর্থাৎ মোটের উপরে তালিবানের অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভায় ‘জঙ্গি’ তকমা পাওয়া তাদেরই একাধিক শীর্ষ নেতাকে দেখা গেল। সমস্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব রেখে ‘গ্রহণযোগ্য’ একটি সরকার যে তাদের কাছে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সেই বার্তা তালিবানকে দিয়েছিল ভারত-সহ বিভিন্ন দেশ। তালিবানও জানিয়েছিল, গ্রহণযোগ্য সরকার গড়ার লক্ষ্যে এগোনোর জন্যই দেরি হচ্ছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারে অন্তত শীর্ষ পদগুলিতে অ-তালিব কোনও মুখ নেই।
বরাদরের ‘পদাবনতি’ নিয়েও চলছে চর্চা। মনে করা হচ্ছিল, তাঁর নেতৃত্বেই সরকার গড়বে তালিবান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পেলেন উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ। তাঁর সঙ্গে আব্দুল সালাম হানাফিকেও উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে। সূত্রের মতে, কাবুল দখলের পরেও নিজেদের রাজনৈতিক ও সামরিক বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব তালিবানকে ভোগাচ্ছিল। গত শুক্রবার নাকি বরাদরের গোষ্ঠী এবং হক্কানি নেটওয়ার্কের মধ্যে সংঘর্ষও বাধে। বরাদর তাতে জখম হন। এই পরিস্থিতিতে নেপথ্য ভূমিকা ছেড়ে মঞ্চে নেমে পড়ে আইএসআই। পাক গুপ্তচর সংস্থার প্রধান ফৈজ় হামিদ আচমকা কাবুলে এসে বরাদর-সহ একাধিক তালিব নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। আইএসআইয়ের মধ্যস্থতাতেই শেষ পর্যন্ত সরকার গঠন নিয়ে জট কাটে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া হয় আখুন্দকে। তালিবান স্পষ্ট করে দিয়েছে, তাদের এই নয়া সরকার একান্তই ‘কার্যনির্বাহী’। স্থায়ী সরকার কবে গঠন হবে, তালিবানের প্রধান মুখপাত্র তথা কার্যনির্বাহী উপ-তথ্যমন্ত্রী জ়বিউল্লা মুজাহিদ তা স্পষ্ট করেননি। নির্বাচনেরও কোনও ইঙ্গিত নেই। তালিবান জানিয়েছে, নতুন সরকারের সূচনা উপলক্ষে অনুষ্ঠান হবে পরে কোনও সময়ে। তবে সেই অনুষ্ঠানে হাজির থাকার জন্য ইতিমধ্যেই রাশিয়া, চিন, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক এবং কাতারের কাছে তালিবানের আমন্ত্রণ পৌঁছেছে বলে খবর। চিন এবং রাশিয়া ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছে, তাদের তালিবানে ‘অ্যালার্জি’ নেই। আজ অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণার পরে জ়বিউল্লা বলেন, ‘‘সরকারের স্বীকৃতি পাওয়াটা আফগানিস্তানের অধিকার। সব দেশকে বলব, আমাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ রাখুন।’’ এই প্রসঙ্গে তুরস্কের বিদেশমন্ত্রী মেভলিত চাভুশোগলু বলেছেন, ‘‘বিশ্বকে আমরা বলব, তাড়াহুড়োর দরকার নেই। পরিস্থিতির উপরে নজর রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।’’ হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকিও বলেন, ‘‘গোটাটাই নির্ভর করছে তালিবান কোন পথে এগোয়, তার উপরে।’’
আজ কাবুলের রাস্তায় পাকিস্তান-বিরোধী বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে শূন্যে গুলি চালিয়েছে তালিবান। হেরাটে তালিবান-বিরোধী বিক্ষোভেও গুলি চলেছে। সেখানে দু’জন নিহত এবং আহত অন্তত আট। পঞ্জশির নিয়েও ধোঁয়াশা কাটেনি। ন্যাশনাল রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্টের নেতা আহমেদ মাসুদ তালিবানি শাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। বার্তাটি যাতে সম্প্রচারিত না হয়, তার জন্য সংবাদমাধ্যমের উপরে তালিবান চাপ সৃষ্টি করছে। ইতিমধ্যে একটি ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, তালিব নেতাদের হাত থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন কিছু লোক। তালিবানপন্থী এক চ্যানেলের দাবি, পঞ্জশিরের যোদ্ধারাই টাকা নিচ্ছেন। আত্মসমর্পণের পরে তাঁদের টাকা দিয়েছে তালিবান। প্রশ্ন উঠেছে, এ ভাবেই কি শেষ হচ্ছে পঞ্জশিরের প্রতিরোধ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy