রাজশাহীতে ভাঙা হয়েছে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি। ছবি: সমাজমাধ্যম।
১৪ অগস্ট: ঋত্বিক ঘটক বাস্তুহারা হলেন আরও একবার।
বাংলাদেশের এই অস্থির সময়েই রাজশাহীতে ঘটক পরিবারের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি ভাঙা পড়েছে। কারা বাড়িটি ভাঙল, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। ওই বাড়ির পাশেই রয়েছে একটি হোমিয়োপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। এলাকার মানুষের একাংশের দাবি, কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই বাড়িটি ভাঙা হয়েছে। ওই জমিতে কাজ করছেন যে ঠিকাদার, তিনিও সেই কথা বলেছেন। তবে কলেজের অধ্যক্ষের অভিযোগ, বাড়িটি ভেঙেছে কলেজেরই পুরনো ছাত্রদের একাংশ। ৫ অগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে যে ভাঙচুর চলেছে, এটা সেই সময়েরই ঘটনা।
দীর্ঘদিন ধরেই বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে কথাবার্তা চলছিল। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে ইজারা দেয়। ২০১৯ সালে বাড়িটির একাংশ ভেঙে সাইকেল গ্যারাজ তৈরির অভিযোগ উঠেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তখন রাজশাহী-সহ সারা দেশে এ ঘটনার প্রতিবাদ হয়। পরে ২০২০ সালে বাড়িটি সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় রাজশাহী জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, জেলা প্রশাসন সংরক্ষণের জন্য ভূমি মন্ত্রকে চিঠি দিয়েছিল। তাতে বাড়িটি ইজারা থেকে মুক্ত করে ঋত্বিক ঘটকের নামে করে দেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। তা ফলপ্রসূ হওয়ার আগেই বাড়িটা ভাঙা হয়ে গেল।
চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর দিকের বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছেন রাজশাহীর ঘোড়ামারা মহল্লায় মিয়াপাড়ার এই বাড়িতে। ওঁর বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ছিলেন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। পরে বদলি হয়ে রাজশাহীতে আসেন এবং সেখানেই পাকাপাকি বসবাস শুরু করেন। শীতকালের সাহিত্য-সঙ্গীত সম্মেলন উপলক্ষে বহু গুণীজনের আনাগোনা লেগে থাকত এই বাড়িতে। তার মধ্যে ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, ফৈয়জ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, উদয়শঙ্কর প্রমুখ। এ বাড়িতে থেকেই সুরেশচন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র ঋত্বিক রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ ও মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগারের মাঠে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যপত্রিকাও তখন সম্পাদনা করতেন তিনি। রাজশাহীতে থাকতে থাকতেই বামপন্থার প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়।
বুধবার বাড়ি ভাঙার খবরটা চাউর হতেই রাজশাহীর চলচ্চিত্র কর্মীরা ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, ইটের স্তূপ ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার পরেই বাড়িটির পাশে থাকা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। সেখানে শ্রমিকেরা আজও বাড়ি ভাঙার কাজ করছিলেন। তাঁরাও বলেন, তাঁরা কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভাঙার কাজ করছেন। তবে কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান দাবি করেন, প্রাক্তন ছাত্ররাই এটা ভেঙে ফেলেছেন। আনিসুরের বক্তব্য, ৬ অগস্ট একদল ছাত্র এসে তাঁকে বলে যে কলেজ থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরাতে হবে এবং বাড়িটা ভেঙে ফেলতে হবে। পরে সেদিন রাতেই তিনি জানতে পারেন যে, বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে। আনিসুরের দাবি, তাঁকে শ্রমিকরা জানিয়েছেন যে কিছু লোক টাকা দিয়ে বাড়িটি ভাঙতে বলে গিয়েছিল। আবার ঠিকাদার শামিম মিয়া দাবি করেন, ৫ অগস্ট একটি দেয়াল ভাঙা পড়েছিল। তার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে বলায় তিনি শ্রমিকদের ডেকে বাড়িটি ভেঙেছেন। এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মী ও ফিল্ম সোসাইটি সদস্যদের একাংশের অভিযোগ, ‘‘অধ্যক্ষ এখন ছাত্রদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। ছাত্ররা ভাঙলে কলেজের নতুন ভবনেও ভাঙচুর চালাত। সেখানকার একটি জানালার কাচও ভাঙেনি।’’
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদীদের জানানো হয়েছে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যাঁরা এই বাড়ি ভাঙায় জড়িত থাকবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হবে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা সংরক্ষণ করা হবে। যদিও অধ্যক্ষের বক্তব্য, ‘‘এটা সংরক্ষণের এখন তো আর কিছু নেই।’’ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন সখেদে অভিযোগ করেন, ‘‘কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেক দিন ধরেই বাড়িটি ভেঙে ফেলার চেষ্টায় ছিল৷ এখন দেশের একটি বিশেষ অবস্থায় বাড়িটি ধ্বংস করে ফেলল। মুছে দিল বাংলার একটি অসাধারণ পরিবারের শেষ স্মৃতি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy