প্রিন্স হ্যারি। ছবি: ফাইল
রাজার ছেলে রাজা হবে, না হলেও রাজসুখ বা রাজসম্মান ভোগ করবে, এটাই তো দস্তুর। বিশ্বে খুব কম দেশেই এখন রাজতন্ত্র টিকে আছে। ব্রিটেনে রাজপরিবারের ক্ষমতা গেলেও, তাঁর ‘সিংহাসন’টা এখনও অটুট। এখনও রাজা বা রানির অভিষেক হয় ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে। ক্ষমতা না থাক- রাজকীয় সম্মান, রাজকীয় বৈভব, রাজকীয় আচার-ব্যবহার-হাবভাব এখনও অটুট। সেই পরিবারের ছেলে, রাজপুত্র হ্যারি, প্রিন্স চার্লস এবং প্রিন্সেস ডায়ানার সন্তান, এই রাজকীয় ‘খাঁচা’র থেকে মুক্তি চান। নিজের মুখেই সে কথা বলে বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন হ্যারি। রাজা হতে চান না তিনি। কেনসিঙ্গটন প্যালেসের প্রিন্স হেনরি অব ওয়েলস একজন সাধারণ মানুষের জীবন পেতে চান। রবীন্দ্রনাথের সুয়োরানি চেয়েছিলেন দুয়োরানির দুঃখ পেতে। যুবরানি ডায়নার ছোট ছেলে আরও এক ধাপ এগিয়ে মনে করেন, শুধু তিনি নন, আসলে রাজপরিবারের কেউই আর রাজা বা রানি হতে চান না। হ্যারির কথায়, ‘‘রাজপরিবারে এমন কি কেউ আছেন যিনি রাজা বা রানি হতে চান? আমার তা মনে হয় না।”
আমাদের এই দেশে এক রাজার ছেলে এক গভীর রাতে সব কিছু ছেড়েছুড়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন জীবন এবং দর্শনের কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে। আড়াই হাজার বছর পরও সেই মানুষটাকে বিশ্ব আজ এক ডাকে চেনে গৌতম বুদ্ধ নামে। ব্রিটেনের প্রিন্স হ্যারি তেমন কোনও পথের সন্ধানে বেরোবার কথা বলেননি। কিন্তু হ্যারির মতো রাজপুত্রদের কারও কারও কাছে আজও কি প্রোটোকলময় জীবনটা অসাড়, অর্থহীন মনে হয়? রাজপরিবারের ঐতিহ্য, বৈভব, আড়ম্বর, জৌলুস- যাতে তাঁদের জন্মগত অধিকার, তাতে কি হাঁফিয়ে ওঠেন হ্যারিরা? হয়তো তাই। তা না হলে বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিনকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় প্রিন্স হ্যারির মুখে ‘বেমানান’ কথাগুলি শোনা যেত না।
কী এমন বলেছেন যুবরানি ডায়ানার মা হারানো ছোট ছেলে?
বছর কুড়ি আগে জীবনটা ওলট পালট হয়ে যায় বারো বছরের ছেলেটার। ১৯৯৭ সালের ৩১ অগস্ট ডায়ানার মৃত্যু বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। লন্ডনের রাস্তায় ছোট্ট রাজপুত্র মায়ের কফিনের পিছনে হেঁটে যাচ্ছে- সেই দৃশ্য গোটা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছেন। সেই বিপর্যয় যে তাঁকে কতটা ছুঁয়েছিল, তা কি রাজপরিবারের কেউই জানতে পেরেছিলেন? ৩২-এ পৌঁছে তিনি বলছেন, রাজপরিবারের নিয়ম পালন করতে গিয়ে তাঁরা ‘ক্লান্ত’। ‘জারে থাকা গোল্ডফিশ’-এর মতো তাঁদের অবস্থা, যাঁদের বাইরে থেকে সবাই শুধু দেখছেন রাজকীয় সম্মান আর বিষয় ‘উপভোগ’ করতে।
যুবরানি ডায়ানার শেষযাত্রা। ছবির ডানদিক থেকে যুবরাজ চার্লস, প্রিন্স হ্যারি। বাঁদিক থেকে দ্বিতীয় প্রিন্স উইলিয়াম। ছবি: ফাইল
কিন্তু মায়ের মৃত্যুর এত বছর পর হঠাৎ এমন মন্তব্য কেন?
আসলে শোক কেটে গেলেও স্মৃতিগুলো এখনও সতেজ। অনুভূতিগুলি আরও পরিণত। পিছনে ফিরে তাকিয়ে হ্যারি বলেছেন, প্রিন্সেস অব ওয়েলস-এর কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। আর সেই দেখা তখন থেকেই তার শিশু-কিশোর মনে ছাপ রেখেছিল। মায়ের হাত ধরে দাদার সঙ্গে গৃহহীন গরিব মানুষের জীবন-যন্ত্রণা দেখেছেন। বড় হয়েও সেই দেখাগুলো তাঁর চিন্তায়, চেতনায়, ভাল-মন্দ লাগার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেগুলোই অন্য ভাবে ভাবতে শেখার, বাঁচতে শেখার স্পৃহা জাগিয়েছিল। মায়ের দেওয়া শিক্ষা থেকেই বাজারে গিয়ে নিজের জিনিসপত্র নিজেও কেনেন প্রিন্স হ্যারি। দোকানে গিয়ে মাংস কেনেন। আর মনে মনে চান, কেউ যেন তাঁকে আলাদা করে না দেখে! ‘সুয়োরানি’র মতো সোনার বাঁশি বয়ে না বেরিয়ে, বাঁশের বাঁশিতে সুর তৈরি করতে চান তিনি। রাজার মতো নয়, আম আদমি হয়ে টাটকা নিঃশ্বাস নিতে চান প্রিন্স হেনরি অব ওয়েলস।
চান তো বটে, কিন্তু কতটা পারবেন? এখানে অবশ্য হ্যারি বেশ ‘প্র্যাকটিক্যাল’। সব ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসার কথা আদৌ ভাবছেন না। বরং রাজপরিবারের জীবনে যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, তাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। অর্থাৎ বদলাতে চান ভিতরে থেকেই। “আমরা সঠিক সময়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করব। আমরা ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আধুনিকীকরণ করছি। নিজেদের জন্য নয়, মানুষের জন্য”- বলছেন হ্যারি। এক দিন তাঁর মা ব্রিটিশ রাজপরিবারের অনেক কিছু ধরেই হ্যাঁচকা টান মেরেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন বাইরে থেকে বিয়ে করে রাজপরিবারে আসা এক আধুনিকা। তাঁর ছেলে, জন্মে থেকেই যিনি রাজপুত্র, তিনি কতটা ‘রাজবিধি’ শেষ পর্যন্ত ভাঙতে বা ডিঙোতে পারবেন তা পরের কথা। কিন্তু ভিতরের অনুভূতিগুলোকে যে ভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি, তাতে ডায়ানা-পুত্র মানুষ-হ্যারিকে চিনতে অসুবিধে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy