ইমরানের দল পিটিআই-এর এগিয়ে থাকার খবরে সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। ছবি: রয়টার্স।
পাকিস্তানের ভোটের ফল আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা হবে আজ। সময় যত এগোবে তত স্পষ্ট হবে প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবিদার। পাকিস্তানের দৈনিক ‘ডন’ এর খবর অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত ১১৩ টি আসনে এগিয়ে রয়েছে প্রাক্তন পাক ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খানের দল তেহরিক-এ-ইনসাফ (পিটিআই)। ম্যাজিক সংখ্যা ১৩৭-এর চেয়ে যা সামান্যই দূরে। জেলবন্দি নওয়াজ় শরিফের দল পিএমএল-এন ৬৪ টি আসনে এগিয়ে। বিলাবল ভুট্টোর পিপিপি এখনও আটকে ৪৩-এ। তবে প্রাদেশিক আইনসভাগুলির মধ্যে পঞ্জাব কার দখলে থাকবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। কাল রাত পর্যন্ত এখানে পিএমএল-এন এগিয়ে থাকলেও সকালের পর হিসেব বদলাচ্ছে সেখানে। সিন্ধুপ্রদেশে এগিয়ে পিপিপি, খাইবার পাখতুনখোয়ায় পিটিআই। গণনা শেষ হয়েছে মাত্র ৪৭ শতাংশ আসনের। এখনও বাকি অনেক আসনের হিসাব।
রাজনীতিক মহলের মতে, প্রথম থেকেই পাক সেনাবাহিনী চাইছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ইমরান খান কুর্সিতে বসুন। কিন্তু একান্তই একক ভাবে ম্যাজিক সংখ্যা ছোঁওয়া সম্ভব না হলে বিলাবল ভুট্টোর দল পিপিপি-র সঙ্গে জোট বাঁধুক ইমরান খানের পিটিআই।
কাল রাতেই পিটিআই-এর টুইটার পেজে লিখেছিল, ‘পাকিস্তানিরা, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জন্য আপনারা তৈরি?’
৩৪২ আসনের পাক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সরাসরি ভোট হয় ২৭২টি আসনে। ৭০টি আসন সংরক্ষিত থাকে মহিলা ও সংখ্যালঘুদের জন্য, যেগুলি ভোটে জেতা আসনের আনুপাতিক হারে বণ্টিত হয় দলগুলির মধ্যে। মোট আসনের নিরিখে সরকার গড়তে ১৭২টি আসন দরকার। যার অর্থ, ভোট-হওয়া ২৭২টি আসনের মধ্যে ১৩৭টি জিতলেই সরকার গড়া যাবে। ইমরানের দল জানাচ্ছে, একাই প্রয়োজনীয় আসন দখলের ব্যাপারে তারা আত্মবিশ্বাসী। গণনা স্থগিত রাখা হয়েছিল দু’টি আসনে।
কম-বেশি ৮৫ হাজার বুথ। বুথে-বুথে সিসি ক্যামেরা। পাকিস্তানের ভোটে আজ পাহারায় ছিল সেনা ও পুলিশ মিলিয়ে প্রায় ৮ লাখ নিরাপত্তাকর্মী। তবু সন্ত্রাস ঠেকানো যায়নি। আগেভাগেই হাজারখানেক কফিন জোগাড় করে রেখেছিলেন পেশোয়ারের ডেপুটি কমিশনার ইমরান হামিদ শেখ! বোমাটা ফাটল বালুচিস্তানের রাজধানী শহর কোয়েটার ইস্টার্ন বাইপাস এলাকার একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে।
ইসলামাবাদের বুথে ইমরান খান। বুধবার। ছবি: পিটিআই।
সবে তখন লাইন লম্বা হতে শুরু করেছে তামির-এ-নাউ এডুকেশন কমপ্লেক্সে। হঠাৎ বিস্ফোরণ। ব্যালট-বাক্স ছেড়ে পালালেন ভোটকর্মীরা। ৫ পুলিশকর্মী ও ২ নাবালক-সহ ঘটনাস্থলেই প্রাণ গেল ৩১ জনের। আহত অন্তত ৩২। পুলিশের অবশ্য দাবি— ভোট বানচাল উদ্দেশ্য নয়, তাদেরই নিশানা করেছিল হামলাকারী আইএস জঙ্গি। দিনের শুরুতেই খাইবার পাখতুনখোয়ার একটি বুথের বাইরে আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টির কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে পিটিআই। গুলিযুদ্ধে এক পিটিআই কর্মীর মৃত্যু হয়। জখম ২। দিঘরি অঞ্চলের এক বুথের বাইরেও গুলিতে এক ভোটদাতার মৃত্যু হয়েছে। লারকানায় পিপিপি শিবিরের কাছে বোমা ফেটে জখম হয়েছেন চার জন।
আরও পড়ুন: ইমরানে লাভই দেখছেন ভারতের গোয়েন্দারা
বুধবার ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ৩টে ২৩। পিটিআই টুইট করল— ‘নির্ভয়ে ভোট দিতে আসুন। গণতন্ত্রের স্বার্থেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করুন।’ বোঝা গেল, ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হলেও তখনও তেমন জমেনি লাইন। খবর এল, পোলিং স্ট্যাম্প এসে পৌঁছয়নি বলে শিয়ালকোটের একটি বুথে তখনও ভোট শুরুই হয়নি। ভোটযুদ্ধে শামিল দলগুলির অবশ্য দাবি, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছবিটা পাল্টেছে।
ভোটে দাঁড়াতে পারেনি লস্কর প্রধান হাফিজ সইদ। কিন্তু লাহৌরের ভোটকেন্দ্রে সকাল-সকাল ভোট দিয়ে গিয়েছে সে। ভোট দেন প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে থাকা নওয়াজ় শরিফের ভাই শাহবাজ়। পেশোয়ারে লারকানায় ভোট দিলেন বিলাবল ভুট্টো।
আর ইমরান খান? বুথেও নিজের ক্যারিশমা দেখিয়ে গেলেন ‘কাপ্তান’। টিভি ক্যামেরার সামনেই ভোট দিলেন খুল্লমখুল্লা। বুথ থেকে বেরিয়ে মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদেরও। কিন্তু এ তো নির্বাচনী বিধিভঙ্গ! মাঝখানে খবরও রটে গেল, পিটিআই নেতার ভোট বাতিল করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। শো-কজ় নোটিস গিয়েছে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সব সংবাদমাধ্যমের দফতরে। অথচ এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ইমরানের দল ফলাও করে জানিয়ে দিল, তাদের নেতার ভোট-বাতিলের খবর ভুয়ো। এমনকি, যে সব সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রচার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জিও জানিয়েছে পিটিআই। পরে অবশ্য জানা যায়, ইমরানকে বিধিভঙ্গের নোটিস দিয়েছে কমিশন। ৩০ জুলাই হাজিরা দিতেও বলা হয়েছে তাঁকে।
ভোটচিত্র: লাহৌরে ২৬/১১-এর মূল চক্রী হাফিজ সইদের ভোট দান। ছবি: পিটিআই।
রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলে ৯৩ জন কয়েদিও আজ ভোট দিলেন। কিন্তু নওয়াজ় ও তাঁর মেয়ে মরিয়ম সুযোগ পেলেন না। কেন? উত্তর মেলেনি। ঠিক যেমন উত্তর পাওয়া গেল না, একটা ভোট নিতে কোনও কোনও বুথে ১৫ মিনিট লাগল কেন! সিন্ধুপ্রদেশে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত বহু বুথেই ভোটারদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলে দুপুরেই নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছিল ভুট্টোর দল। ওঠে এন্তার রিগিংয়ের অভিযোগও। কমিশনের কাছে পিএমএল-এনের তরফেও। তাতে বলা হয়, লাইন বেড়েই চলেছে। তাই যেন ভোটদানের সময়সীমা আরও এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়।
বুথ থেকে বেরিয়ে ভোটদাতাদের একটা অংশ কিন্তু ‘কাপ্তান’-এর উদ্দেশে ‘ভি’ দেখিয়ে গেলেন। দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জ়ুলফিকার আলি ভুট্টোর নাতনি ফতিমা ভুট্টো কার্যত ইমরানকেই উড়িয়েই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘পাক সেনা পরিচালিত সার্কাসে ইমরান শুধুই একজন খেলোয়াড়।’’
আরও পড়ুন: ‘ভোট দিন, হালুয়া-পুরি-কফি আপনার জন্য ফ্রি’
কেন ইমরানে আপত্তি— ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ফতিমা বলেন, ‘‘২০০৬-এ এই ইমরানই নারী সুরক্ষা বিলের বিরোধিতা করেছিলেন। দুর্নীতি দমনের কথা বলে দল গড়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরই দলেই দুর্নীতিবাজদের ভিড় বেশি।’’ ফতিমা উস্কে দেন ইমরানের দলের এক ভোটপ্রচারের স্মৃতিও। তাঁর কথায়, ‘‘ঘটনাটা ১৭ জুলাইয়ের। করাচি শহরে একটা গাধাকে খুঁটিতে বেঁধেছিল পিটিআই-এর এক দল কর্মী-সমর্থক। তার পরেই শুরু হল বেধড়ক কিল-লাথি-চড়। মারতে মারতে চোয়াল ভেঙে ফেলল, তবু থামল না। মৃতপ্রায় গাধাটাকে রাস্তায় ফেলে উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিল। শেষটায় ওখান থেকে চলে যাওয়ার আগে নিথর পশুটার গায়ে লিখে দিল— নওয়াজ়।’’
ইমরান ক্ষমতায় এলে কী হবে, তা নিয়ে বহুদিন ধরেই জল্পনা চলছে নয়াদিল্লিতে। যদিও পাক হাইকমিশনারের দাবি, যে দলই ক্ষমতাই আসুক, ভারতের চিন্তার কিছু নেই। ইস্তাহার কিংবা ভোটের প্রচারে কোনও দল ভারতকে নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেনি বলে দাবি তাঁর।
একটা সম্ভাবনা অবশ্য ভাবাচ্ছেই অনেককে। নিজের দল স্বীকৃতি না পাওয়ায় অন্য দলের প্রতীকে ২৬৫ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল ২৬/১১-র পাণ্ডা হাফিজ। তারা কেউ জিতেছে কি না, রাত পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। যদি জেতে? কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, সে ক্ষেত্রে সন্ত্রাস সরাসরি ঢুকে পড়বে পাকিস্তানের ক্ষমতার মূল স্রোতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy