মৃতদের গণসৎকার। সোমবার কাঠমান্ডুতে। ছবি: রয়টার্স।
বলার অপেক্ষা মাত্র! ‘‘দেখ, দেখ আবার হলো কিনা! মনে হচ্ছে না বাড়িটা কাঁপছে!’’ হোটেলে চেক ইন করব কি, মালপত্র নিয়ে ছিটকে ফের রাস্তায়। সঙ্গে গোটা হোটেল।
এ ভাবেই স্বাগত জানাল এক অচেনা কাঠমান্ডু। যার অন্য নাম এখন আতঙ্কের রাজধানী। কার্যত শনিবারের পর থেকে গোটা শহরটিই রাস্তায়। প্রায় অশক্ত বৃদ্ধ থেকে দুধের শিশুকে নিয়ে মা। ছাপোষা নেপালি থেকে বিদেশি পর্যটক। সকলেরই ঠিকানা কেয়ার অব রাজপথ। ঘরবাড়ি-হোটেল রয়েছে বটে, কিন্তু সে-মুখো হচ্ছেন না বিশেষ কেউই। দিনযাপন আর রাত কাটানোর জন্য খোলা আকাশই এখন বেশি ভরসার। দু’দিনে কমবেশি প্রায় চারশো ভূকম্পের ধাক্কায় যেন শক্তিহীন হয়ে পড়েছে হিমালয়ের কোলে এই শহরটা। তারই মধ্যে খবর ছড়িয়েছে সকাল থেকে— আজ নাকি আরও বড় ধাক্কা আসছে! তাতেই থমথমে গোটা শহর। প্রতিটি মুখেই আতঙ্কের ছাপ, কী জানি কী হয়!
দিনের শেষে সত্যি হল আতঙ্ক। ফের কাঁপল মাটি। এখানকার ঘড়িতে ৬টা ২১। তার পরে আবারও। রাত ৯টা ৪০-এ। বিকেল পর্ষন্ত কিছু না ঘটায় কেউ কেউ মনে করেছিলেন, আজকের দিনটা বুঝি রেহাই দিল মাটির নীচের টেকটোনিক প্লেটেরা। বিরতি দিল রেষারেষিতে। অল্প কিছু পরিবার ঘরেও ফিরেছিলেন। ভেবেছিলেন, বুঝি বা শেষ হলো পথবাসের পর্ব। সন্ধের পর থেকে জোড়া কম্পনে তাঁরা ফের ছিটকে এসেছেন পথে। আজকের কম্পনে ক্ষয়ক্ষতি কতটা হলো, রাতে তার ছবিটা স্পষ্ট না হলেও, ভাঙা মনে সামান্য যেটুকু আশা জেগেছিল তা-ও যেন চৌচির হয়ে গেল আরও এক বার। এই টানাপড়েনের শেষ কোথায়? কাঠমান্ডুর কাছে এর চেয়েও বড় প্রশ্ন এখন, পরের বার কী হবে?
ভয়টা যে কী পরিমাণ ছড়িয়েছে, তা মালুম পেয়েছিলাম সকালেই। মৈত্রী অভিযানের ত্রাণ-বিমানে করে সদ্য পা দিয়েছি ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। অপেক্ষারত মানুষের কল্যাণে গোটা বিমানবন্দর নরকের স্তূপ। অভিবাসন দফতরের কাউন্টারে আমাদের দেখে রীতিমতো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন নেপালি অফিসার। ‘‘সবাই পালাচ্ছে। আর আপনারা এখানে কী করতে এসেছেন! জানেন না একের পর এক ভূমিকম্প হচ্ছে? আজও হবে বলেছে।’’
ওই অফিসারের কথাটা কতটা সত্যি, বিমানবন্দরের বাইরে পা দিয়েই তা বুঝতে পারলাম। আতঙ্কে শহর থেকে পালাতে পারলে বাঁচেন বিদেশিরা। কাতারে কাতারে মানুষ লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছেন বিমানের জন্য। অধিকাংশই ভারতীয়, বাকি বিদেশিদের বেশির ভাগই নেপাল ঘুরতে এসে আটকে পড়েছেন। বিমান কে কবে পাবেন জানেন না কেউ। দু’দিন ধরে বিমানবন্দর চত্বরেই হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন, আজ কি জায়গা হবে? ফিরতে পারবেন কি, যত কাণ্ডের এই শহর থেকে!
শেষ স্পর্শ। পশুপতিনাথ মন্দিরের কাছে অন্ত্যেষ্টির আগে।
সোমবার কাঠমান্ডুতে। ছবি: এএফপি।
শনিবারের ভূমিকম্পের ধাক্কায় মূলত ভক্তপুর বা ললিতপুরের মতো জায়গাগুলিতে বেশি পড়লেও, কম ক্ষতি হয়নি রাজধানীরও। ধসে গিয়েছে অধিকাংশ পুরনো বাড়ি। মোড়ে মোড়ে ধ্বংসস্তূপ। পাশ দিয়ে ফালি রাস্তায় চলছে যানবাহন। উপড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, মাটি ফুঁড়ে হা করে বেরিয়ে এসেছে গহ্বর। বাদ যায়নি শতাব্দী-প্রাচীন মন্দির বা স্কুল। দোলপায় পাহাড়চুড়োর ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির, রানিপোখরিতে ১৮৫৪ সালে তৈরি দুর্বার হাইস্কুল, এমন অনেক কিছুই এখন কার্যত ভগ্নস্তূপ।
তবে সব ছাপিয়ে সুনধারার ধরহরা। পাঁচ তলা সমান ধরহরা ছিল অনেকটা আমাদের শহিদ মিনারের মতো। এর মাথায় উঠে কাঠমান্ডু দর্শন করতেন পর্যটকরা। অতীতের অনেক ঝড়-ঝাপটা সয়ে এলেও এ বার আর রক্ষা পায়নি। দু’শো বছরের ওই মিনার গত শনিবার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। গোটা এলাকা তখন পর্যটকে ভর্তি। সামনেই দোকান বিকাল শ্রেষ্ঠর। তিনি বললেন, ‘‘দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আচমকা মাটি দুলতে শুরু করল। তীব্রতায় ছিটকে পড়লাম। উপরে তাকিয়ে মিনারটিও দুলছে। এক সময়ে পিছন দিকে হেলে ধুম করে সামনে নুয়ে পড়ল সেটি।’’ ওই ঘটনায় কমপক্ষে পঞ্চাশ জন মারা গিয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
ঘটনার দু’দিন পরে আজ ধরহরার অবশেষ ঘিরে ভিড়ে ভিড়াক্কার। নেপালের গ্রাউন্ড জিরো। পাঁচতলা সৌধের কিছুটা রয়ে গিয়েছে স্মৃতি হিসেবে। ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে নমো নমো করে।
উল্টো দিকেই টুনিখেলের মাঠ। বিশাল এই প্রান্তর জুড়ে অস্থায়ী শিবির। কেবল তাঁবু আর তাঁবু। মাটিতে শতরঞ্চি বিছিয়ে কোনও ভাবে শোয়ার ব্যবস্থা। ঢালাও লঙ্গর। অনেকেই জানের সঙ্গে মালও নিয়ে এসেছেন। তাঁবুর পাশেই বাঁধা রয়েছে গাড়ি। দুপুরের কড়া রোদ এড়াতে সেই গাড়িতেই ক্ষণিকের বিশ্রাম চলছে পালা করে।
ঘুরতে ঘুরতে মাঠেই দেখা সোনারপুরের বাসিন্দা বলরাম পোরের সঙ্গে। নেপালে রয়েছেন পঁয়ত্রিশ বছর ধরে। স্থানীয় স্বর্ণকার সমিতি তথা বাঙালি সমাজের এক জন মুরুব্বিও বটে। মাঠেই তাঁকে ঘিরে রয়েছে প্রায় গোটা পঞ্চাশ বাঙালির একটি দল। সকলেই সোনার কাজ করেন। অধিকাংশের বাড়ি হাও়ড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে। কী করে দলের মানুষগুলোকে দেশে ফেরাবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না বলরামবাবু। বললেন, ‘‘নেপালের বীরগঞ্জ হয়ে বিহারে ঢুকে গেলে নিশ্চিন্ত। সেখান থেকে শুনেছি ভারত সরকার ট্রেনের ফ্রি টিকিটের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু কোনও গাড়িই যেতে চাইছে না।’’
প্রায় এক দশক ধরে কাঠমান্ডুতে থাকা এই বাঙালি পরিবারগুলি এখন প্রাণ নিয়ে ফিরতে মরিয়া। হাওড়ার জিকিরার বাসিন্দা সুদর্শন বেরা স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ১১ বছর ধরে কাঠমান্ডুতে রয়েছেন। আর এখানে থাকার কোনও ভরসা পাচ্ছেন না সুদর্শন। স্ত্রী-ও জেদ ধরছেন বাড়ি ফেরার জন্য। একই এলাকার বাসিন্দা বিপ্লবেরও যুক্তি, ‘‘আপাতত প্রাণ বাঁচিয়ে ঘরে যাই। পরে পরিস্থিতি ঠিক হলে আবার ফিরে আসব। কাজ তো আর পালাচ্ছে না।’’ বলরামবাবুর দাবি, কাঠমান্ডুতে অন্তত ছয় থেকে আট হাজার বাঙালি রয়েছেন। তাঁদের অন্তত ৭৫ ভাগ ফিরে গিয়েছেন। বাকিরাও শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন।
এ ছাড়া উপায়টাই বা কী?
ত্রাণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। যেখানে নেপাল সেনা রয়েছে সেখানে তা-ও কিছুটা কাজ হয়েছে। কিন্তু তারাও অনেক জায়গায় পৌঁছতে পারেনি এখনও। কোথাও সবে শুরু হয়েছে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ। শহর জুড়ে তেলের হাহাকার। পাম্পে লম্বা লাইন। কাঠমান্ডু শহরের বড় অংশ এখনও জেনারেটর নির্ভর। বিদ্যুত্ আসছে-যাচ্ছে। খাবারের দোকান খুঁজে পাওয়া মানে লটারি পাওয়া। আর ইন্টারনেট তো ভিনগ্রহের ব্যাপার!
নেপালি হিসেবে এখন ২০৭২ সাল চলছে। কিন্তু এই ভূমিকম্পের ধাক্কায় গোটা শহর যেন হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছে আচমকা। পরিকাঠামো একেবারে তছনছ। নেপালের সরকারের দাবি, তারা ঠিক আবার সব কিছু পুনর্নির্মাণ করে দেবে।
সকলের কেবল একটাই প্রার্থনা— আর যেন ভূমিকম্প না হয়। শনিবারের ওই ভূমিকম্পের পরে তেরাত্তির কাটতে চলেছে আজ। ভালোয় ভালোয় কেটে যাক এই আশাতেই বুক বেঁধেছে গোটা পশুপতিনাথের শহর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy