হাতে হাত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। -ফাইল ছবি।
শ্যাম রাখলে তো কূল রাখা যায় না। আবার কূল রাখতে গেলে যে শ্যাম থাকে না সঙ্গে! অথচ ভারতকে এখন শ্যাম আর কূল দু’টোই রাখতে হবে। একই সঙ্গে। নিজের স্বার্থে।
মার্কিন ড্রোন হানায় ইরানের সেনাকর্তা জেনারেল কাসেম সোলেমানি-সহ কয়েক জনের মৃত্যু ও তার প্রত্যাঘাতে ইরাকে মোতায়েন মার্কিন সেনা ঘাঁটির উপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের প্রেক্ষিতে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের সামনে এখন অগ্নিপরীক্ষা।
আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে মধুর থেকে মধুরতর হয়ে উঠেছে। আবার একই সঙ্গে ইরান-সহ মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টিকেও ভারত যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়েছে। প্রতিরক্ষার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও পেন্টাগন ও তেহরানের হাতে হাত রেখে চলে দিল্লি। তাই মার্কিন ড্রোন হানা ও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের পর ভারত খুব স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বিগ্ন। যাতে দু’দেশ অবিবেচকের মতো কোনও ঝটিতি সিদ্ধান্ত না নিয়ে বসে প্রকাশ্যে তার আবেদনও জানিয়েছে ভারত। কারণ, সেটা হলে আখেরে ভারতেরই ক্ষতি। ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। ফলে, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কালবিলম্ব না করে কথা বলেছেন ইরানের বিদেশমন্ত্রী জাভাদ জারিফ ও মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পায়োর সঙ্গে।
ভারত ও আমেরিকাকে কাছে এনেছে চিন
গত কয়েক দশকের ঘটনাগুলি ভাবুন। বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত ও আমেরিকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি অনেক বেশি পরিমাণে একই মোহানায় মিশেছে। ফলে, দু’টি দেশের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।
সঙ্গে আছি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের হয়ে প্রচারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত বছর, হিউস্টনে।
তার জন্য অনেকটাই অবদান রয়েছে আমাদের পাশের ঘরের প্রতিবেশী চিনের। অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে চিন এশিয়া-সহ প্রায় গোটা বিশ্বে একেবারে সামনে চলে আসায় তাকে ঠেকাতে অনেকগুলি দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার ভাবনা ভাবতে হয়েছে আমেরিকাকে। সেই কাজে এগিয়ে যেতে কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশকে নিয়ে ‘লিগ’ বা সমমনস্ক জোট গড়ার পথে আমেরিকাকে হাঁটতে হয়েছে। তাই ভারতের মতো উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে ওঠা একটি গণতান্ত্রিক দেশকে পাশে পাওয়ার বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আমেরিকার। চিনের নাকের ডগার পড়শি হওয়ায় সেই জোটে ভারতের জায়গাটাও একেবারে সামনে। ভূমিকাটা যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের উপর আমেরিকার নজর পড়েছে দেখে মার্কিন-মিত্র বড় দেশগুলিরও ভারতকে নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে, সেই সব দেশের সঙ্গে আমাদের হাই-টেক বাণিজ্য বেড়েছে। মহাকাশ গবেষণা ও পারমাণবিক শক্তিকে অসামরিক ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর নিত্যনতুন প্রযুক্তি আদানপ্রদানে সহযোগিতা সম্ভব হয়েছে।
এতে আমাদের উপকারই হয়েছে। পরমাণু অস্ত্র প্রসার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) সই না করার ফলে যে সব প্রযুক্তি হাতে পাওয়া অসম্ভব ছিল আমাদের, ঘুর-পথে সেই সব প্রযুক্তি ভারতের হাতে আসছে।
ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে ওঠা-নামা
ইরানের ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়েছে। তেহরানের উচ্চাশা, পরমাণু অস্ত্রে স্বয়ম্ভর ও শক্তিশালী হয়ে ওঠা। কিন্তু এনপিটি-র শর্তগুলি তার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, মূলত পশ্চিমি দেশগুলির সম্মিলিত প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশন (আইএইএ) ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ভারতও সেই প্রস্তাবের শরিক ছিল। আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি সহযোগিতা চুক্তিতে সই করার ফলে এনপিটি-র শর্ত লঙ্ঘন করে তেহরানের পরমাণু অস্ত্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠার উচ্চাশার বিরোধিতাই করতে হয়েছে দিল্লিকে।
ভারতের একদা ভরসা। ইরানের বাশারে তেল শোধনাগার
ইরানের ওই উচ্চাশাকে দমন করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ভারত তার প্রতিবাদ করেনি জোরালো ভাবে। যা তেহরানের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়েছে। ইরানের তেল না পাওয়া গেলে অন্য রাস্তা ধরতে হবে ভেবে দিল্লি ওই সময় সৌদি আরবের দিকে ঝোঁকে। সেই সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যে দেশটি ইরানের ঘোর শত্রু বলেই পরিচিত। ফলে, ইরান তো বটেই গোটা বিশ্বেই এমন একটা সন্দেহ দেখা দেয়, ভারত কি আমেরিকার চাপের কাছেই মাথা নুইয়েছে? আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে বড় মূল্য চোকাতে হয়!
এই সব ঘটনা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ওঠা-নামা হয়েছে। যদিও নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য ভারত কিন্তু ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টিকে অবহেলা করেছে, এমনটা বলা যাবে না। বলব, গুরুত্বই দিতে চেয়েছে।
ভারতের বাণিজ্যতরীর ভরসা। ইরানের চাবাহার বন্দর
পাকিস্তানকে এড়িয়ে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার প্রজাতান্ত্রিক দেশগুলিতে পৌঁছতে ইরানের চাবাহারে সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার জন্য প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে ভারত। বিনিয়োগ করেছে ওই সমুদ্রবন্দরের লাগোয়া সড়কপথেও। আন্তর্জাতিক নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর দিয়ে এই রেল, সড়ক ও সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে দূরের দেশগুলিতে আরও বেশি করে পৌঁছতে ইরান খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভারতের কাছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বেজিং চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর ও পাকিস্তানের গ্বাদরে সমুদ্রবন্দর বানানোর পথে অনেকটা দূর এগিয়ে যাওয়ায় রফতানির পরিমাণ বাড়াতে আর তার খরচ কমাতে ভারতের কাছে জরুরি হয়ে উঠেছে নতুন নতুন বাজারে সহজে পৌঁছনো। তার জন্য চাবাহার সমুদ্রবন্দর ও ইরানের উপর দিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডরের উপর দিল্লির নির্ভরতা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
যদিও ইরানের সঙ্গে হালে ভারতের সম্পর্কের ওঠা-নামার ছাপ পড়েছে চাবাহার সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজেও। কাজ মাঝে মধ্যেই থেমে থেকেছে।
কেউ চিরশত্রু নয়, নয় বরাবরের বন্ধুও
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে যেমন চিরশত্রু বলে কিছু হয় না, তেমনই বরাবরের বন্ধু বলেও কিছু হয় না। সেগুলি আপেক্ষিক। সময়ের সঙ্গে বদলায়। দেশগুলির স্বার্থটাই সেখানে সবচেয়ে বড় কথা। সেটা কিন্তু বদলায় না। এই নীতি মেনেই বিদেশনীতি এমন ভাবে ঠিক করতে হয়, যাতে তার দৃশ্যত কিছু সুফল পাওয়া যায়। যাতে সেই বিদেশনীতির খেসারত দিতে না হয়।
এক সময় দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নির্জোট আন্দোলনকে সমর্থন করার প্রয়োজন হয়েছিল ভারতের । বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ কেটে যাওয়ার পর সেই নির্ভরতা নির্জোট থেকে এখন বহুজোট নির্ভরতায় বদলে গিয়েছে। নিজের স্বার্থরক্ষার লক্ষ্যটিতে অবিচল থেকেই।
কাছাকাছি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অনাবাসী ভারতীয়রা। গত বছর দীপাবলিতে হোয়াইট হাউসে।
তবে এই বহুজোট নির্ভরতার নীতি মেনে চললে খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে সেই নীতিকে বাস্তবায়িত করতে হয়। দু’টি বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষের বাতাবরণ তৈরি হলে তখন আর পক্ষপাতিত্ব সম্ভব হয় না। ইরান সমস্যা এ বার ভারতকে সেই চ্যালেঞ্জের মুখেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আর সেটা যে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল, তা নয়।
অগ্নিপরীক্ষার মুখে ভারতের বিদেশনীতি
ভারতের বিদেশনীতির এখন অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার সময়। মনে রাখা উচিত, ভারতের এই সময়ের বিদেশনীতি ভবিষ্যতে দুই দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকা বা না থাকার একটি মুখ্য কারণ হয়ে থাকবে।
কোনও একটি দিকে ঝুঁকে পড়াটা অবাঞ্ছনীয়। সে ক্ষেত্রে ভারত হয়তো সমস্যা থেকে সরে থাকতে পারে। বা, দৃশ্যত নিরপেক্ষ থাকতে পারে। তাতে দু’দেশের শুভেচ্ছা সে পাবে না, বরং সন্দেহের চোখে পড়তে পারে। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাধারণ নীতি হিসাবে যেটা ধরা হয়, সেটা হল, ‘তুমি যদি আমার সঙ্গে না থাক, তার মানে তুমি ওদের সঙ্গে আছ’। তবে সমস্যা থেকে সরে থাকলে আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতকে সাইডলাইনেও চলে যেতে হতে পারে।
এ বার কি ‘শান্তির কারিগর’ হয়ে উঠবে ভারত?
অন্য দিকও রয়েছে। চিন যেমন বিশ্বাস করে, প্রত্যেকটি চ্যালেঞ্জই একটি সুযোগের জন্ম দেয়। তার জন্য নিরপেক্ষ থেকে ইরান সমস্যা মেটাতে শান্তি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করাটাই ভারতের শ্রেয়। বিভিন্ন সময়ে সম্পর্কের টানাপড়েন সত্ত্বেও, দু’দেশের সঙ্গেই যেহেতু ভারতের সম্পর্ক রয়েছে, তাই দিল্লির উচিত, সেই পথগুলি ধরেই ইরান সমস্যা মেটাতে সক্রিয় হয়ে ওঠা। ভারত নিজে এখনও মধ্যপন্থায় বিশ্বাস রাখছে। আর দুই বিপরীত মেরুর মধ্যে নিজেকে সেতু হিসাবে দেখতে চাইছে।
ইরান ও আমেরিকার মধ্যে শান্তি-দৌত্য শুরুর প্রয়াসে ইতিমধ্যেই আমাদের ‘একটা ভাল বন্ধু’ হিসাবে দেখতে চেয়েছেন ভারতে ইরানের রাষ্ট্রদূত আলি চেঘেনি। উত্তেজনা কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও। মার্কিন মুলুকে নির্বাচনের বছরে যখন হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে, তখন আমেরিকাকে সম্ভবত আর একটা দিশাহীন যুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন না প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আবার ইউক্রেনীয় বিমান ধ্বংসের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক স্তরে ইরান আরও চাপে পড়বে, সন্দেহ নেই।
ফলে, যুদ্ধের সম্ভাবনা স্তিমিত হলেও এই মুহূর্তে ইরান সমস্যা মেটাতে কোনও এক বিশ্বাসযোগ্য তৃতীয় পক্ষের দৌত্যের আশু প্রয়োজন। ভারতের এখন সেই ভূমিকাই নেওয়া উচিত। এতে শুধুই মধ্যপ্রাচ্য বা গোটা বিশ্ব উপকৃত হবে তা নয়; একই সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতে ‘শান্তির কারিগর’ হিসাবে ভাবমূর্তি গড়ে তোলারও সুযোগ আসবে ভারতের সামনে।
ভারত কি সেই সুযোগটা হাতছাড়া করবে?
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ফাইল ছবি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy