Advertisement
০৪ জানুয়ারি ২০২৫
Borewell Incidents in India

প্রিন্স থেকে চেতনা, কুয়ো নামক মৃত্যুফাঁদে পা একের পর এক শিশুর, শিক্ষা হল না ১৯ বছরেও

২০০৬ সালে হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে কুয়োয় পড়েও বেঁচে ফিরেছিল চার বছরের প্রিন্স। তার পর থেকে বার বার একই ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কুয়োর গভীরে মৃত্যু হয়েছে শিশুদের। তবে টনক নড়েনি।

(বাঁ দিকে) কুয়ো থেকে উদ্ধার হরিয়ানার প্রিন্স কাশ্যপ। কুয়োয় মৃত রাজস্থানের চেতনা (ডান দিকে)।

(বাঁ দিকে) কুয়ো থেকে উদ্ধার হরিয়ানার প্রিন্স কাশ্যপ। কুয়োয় মৃত রাজস্থানের চেতনা (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৫ ২১:৪৪
Share: Save:

২০০৬ সালের জুলাই মাস। হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রের হলদেরি গ্রামে একটি ইঁদুরের পিছনে তাড়া করতে গিয়ে কুয়োয় পড়ে গিয়েছিল প্রিন্সকুমার কাশ্যপ। চার বছরের ওই শিশুকে নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় পড়ে যায়। সকলের প্রার্থনার মধ্যে উদ্ধারকারীদের নিরলস চেষ্টায় ৫০ ঘণ্টা পরে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল প্রিন্সকে। ৬০ ফুট গভীর কুয়োয় মৃত্যুর কোল থেকে জীবনে ফিরে এসেছিল একরত্তি। সেই ঘটনার পরে প্রায় দুই দশক কেটে গিয়েছে। কিন্তু ছবিটা বদলায়নি। শিশুদের কুয়োয় পড়ে যাওয়ার খবর এসেছে বার বার। উদ্ধারকারীরা কাউকে বাঁচাতে পেরেছেন। কেউ কুয়োর আঁধারেই হারিয়ে গিয়েছে। যেমনটা হল রাজস্থানের ছোট্ট চেতনার ক্ষেত্রেও। কুয়োয় পড়ে যাওয়ার ১০ দিন পরে তাকে উদ্ধার করা গেল বটে, কিন্তু বাঁচানো গেল না।

হরিয়ানায় উদ্ধার সেই প্রিন্স কাশ্যপ এখন।

হরিয়ানায় উদ্ধার সেই প্রিন্স কাশ্যপ এখন। ছবি: সংগৃহীত।

গত ২৩ ডিসেম্বর রাজস্থানের কোটওয়ালেতে খেলতে খেলতে কুয়োয় পড়ে যায় তিন বছরের চেতনা। মাঠের মধ্যে চাষের প্রয়োজনে ৭০০ ফুট গভীর কুয়ো খুঁড়ে রাখা হয়েছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়। সেই মৃত্যুফাঁদেই পা দিয়ে ফেলে চেতনা। প্রথমে ১৫ ফুটে গিয়ে আটকে পড়েছিল সে। পরিবারের লোকজন তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হয়। ১৫০ ফুট গভীরে গিয়ে আটকে পড়ে সে। উদ্ধারকাজ শুরু হলেও দু’দিন পর থেকেই আর কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি একরত্তির। বুধবার, ১০ দিন পরে অবশেষে কুয়ো থেকে টেনে তোলা গিয়েছে চেতনাকে। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

রাজস্থানে তিন বছরের চেতনার উদ্ধারকাজ চলছে।

রাজস্থানে তিন বছরের চেতনার উদ্ধারকাজ চলছে। ছবি: পিটিআই।

উদাসীন প্রশাসন

২০১৯ সালে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (এনডিআরএফ) যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়, ভারতে অন্তত ২ কোটি ৭০ লক্ষ কুয়ো রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রামে জলাভাবের কারণে চাষের প্রয়োজনে ওই সব কুয়ো খোঁড়া হয়। যন্ত্রের সাহায্যে তা থেকে চাষের জমিতে জল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে গেলে এবং জল শুকিয়ে গেলে যন্ত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। তার পর আর সেই কুয়োর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামান না কর্তৃপক্ষ। কুয়োগুলি খোলা গর্ত হিসাবেই পড়ে থাকে দিনের পর দিন। একের পর এক ঘটনার পরেও প্রশাসন এ বিষয়ে উদাসীন, টনক নড়ছে না কুয়ো খননকারী জমির মালিকদেরও। চেতনার ঘটনাও আরও এক বার তা প্রমাণ করল।

কুয়োয় পাতা মৃত্যুফাঁদ।

কুয়োয় পাতা মৃত্যুফাঁদ। ছবি: শাটারস্টক।

১৯ বছর ধরে আতঙ্কের নাম কুয়ো

মধ্যপ্রদেশের সৃষ্টি: ২০২৩ সালে মধ্যপ্রদেশের সেহোরের গ্রামে ৩০০ ফুট গভীর কুয়োয় পড়ে গিয়েছিল আড়াই বছরের ছোট্ট সৃষ্টি কুশওয়াহা। দু’দিন পরে উদ্ধারকারীরা কুয়ো থেকে তার পচাগলা দেহ উদ্ধার করেন। জমির মালিক এবং কুয়ো খননকারীর বিরুদ্ধে পুলিশ এফআইআর দায়ের করেছিল বটে, কিন্তু লাভ হয়নি।

তামিলনাড়ুর সুজিত: ২০১৯ সালে তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লিতে কুয়োয় পড়ে যায় তিন বছরের সুজিত উইলসন। ৮০ ঘণ্টা ধরে সেই উদ্ধারকাজ চলেছিল। কিন্তু একরত্তিকে বাঁচানো যায়নি। সেই ঘটনা এতটাই সাড়া ফেলেছিল চারদিকে যে, দাবাড়ু রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ তাঁর বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব উৎসর্গ করেছিলেন সুজিতের নামে।

মধ্যপ্রদেশের তন্ময়: ২০২২ সালের ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশের বেতুলে ৫৫ ফুট গভীর কুয়োয় পড়ে গিয়েছিল তন্ময় সাহু। আট বছরের ওই শিশুকে উদ্ধার করতে ৬৫ ঘণ্টা ধরে লড়াই চালিয়েছিলেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা। কিন্তু তাকে বাঁচানো যায়নি। তন্ময়ের মা সে দিন একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘কোনও রাজনৈতিক নেতার ছেলে এ ভাবে কুয়োয় পড়ে গেলেও তাকে তুলতে এতটা সময় লাগত তো?’’

ছত্তীসগঢ়ের রাহুল সাহু: ২০২২ সালের জুন মাসে ১০ বছরের রাহুল পড়ে গিয়েছিল কুয়োয়। ছত্তীসগঢ়ে ১০৪ ঘণ্টা ধরে চলেছিল তার উদ্ধারকাজ। রাহুলকে অবশ্য জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছিল। মৃত্যুকে ছুঁয়ে ফিরে এসে অন্ধকার অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিল সে।

ছত্তীসগঢ়ের কুয়ো থেকে জীবিত উদ্ধার রাহুল সাহু।

ছত্তীসগঢ়ের কুয়ো থেকে জীবিত উদ্ধার রাহুল সাহু। —ফাইল চিত্র।

২০২২ সালের মার্চ মাসে মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় আট বছরের আরও এক শিশু কুয়োয় পড়ে গিয়েছিল। ৬০ ফুট গভীর কুয়োর ৪৩ ফুটে গিয়ে সে আটকে থেকেছিল দু’দিন। পরে তারও দেহ উদ্ধার করা হয়।

জীবিত উদ্ধারে সাফল্যের হার কম

এনডিআরএফ-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ৪০-এরও বেশি শিশু কুয়োয় পড়ে গিয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে তাদের জীবিত উদ্ধার করায় সাফল্যের হার বেশ কম। ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই উদ্ধারকাজ ব্যর্থ হয়েছে।

রোগ জানা, রোগের কারণও অজানা নয়। তা সত্ত্বেও কেন তা নির্মূল করা যাচ্ছে না? বার বার কেন একই ঘটনা ঘটে চলেছে দেশের নানা প্রান্তে? উত্তর নেই প্রশাসনের কাছে। রাজস্থানে চেতনার মৃত্যুর পর আরও এক বার সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। অনেকের মতে, প্রশাসনের একাংশের উদাসীনতাই এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী। বেআইনি কুয়ো খনন আটকাতে বা কুয়োর রক্ষণাবেক্ষণে জোর দিতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। শুধু শিশু নয়, যে কোনও মানুষ এবং পশুর কাছে এই সব কুয়ো তাই হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ।

অন্য বিষয়গুলি:

Borewell Prince Kashyap Rajasthan Borewell Deaths
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy