(বাঁ দিকে) গৌতম গম্ভীর এবং রোহিত শর্মা (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ় জয় পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। ঠিক যে ছিল না, ভারতে এসে বুঝিয়ে দেয় নিউ জ়িল্যান্ড। আবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পার্থে জয় টম লাথামের দলের কাছে লজ্জার হারে প্রলেপ দেয়। বর্ডার-গাওস্কর ট্রফির প্রথম টেস্টে বিরাট কোহলি, যশস্বী জয়সওয়াল, মহম্মদ সিরাজদের পারফরম্যান্স আশা দেখালেও দ্বিতীয় টেস্ট থেকে চেনা ফর্মে দেখা যাচ্ছে না ভারতীয় দলকে।
রোহিত শর্মার দলের খেলায় পরিচিত আগ্রাসী মেজাজ উধাও। কেন এমন পরিবর্তন? তিন-চার বছর আগেও বিদেশের মাটিতে শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করত ভারতীয় দল। এখন ৫০-৫০ পরিস্থিতিতে সেই দলই ড্র করার জন্য খেলে। মানসিকতার পরিবর্তন বেশ স্পষ্ট। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ২০২১ সালের লর্ডস টেস্টের কথা। সে বার চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ২৬২ রান। ৬০ ওভারে সেই রান তুলতে হত জো রুটের দলকে। কোহলির ভারত ৫১.৫ ওভারে ইংল্যান্ডকে অলআউট করে ১৫১ রানে ম্যাচ জিতেছিল। ঘরের মাঠে জসপ্রীত বুমরাহ, মহম্মদ শামি, মহম্মদ সিরাজ, ইশান্ত শর্মা, রবীন্দ্র জাডেজার বল সামলাতে পারেননি ইংরেজ ব্যাটারেরা। চার জন ব্যাটার আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে। সেই দলেরই মেলবোর্নের ২২ গজে অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেট ফেলতে সময় লেগেছে ১৯.৩ ওভার। ২০২১ সালের দলের পাঁচ বোলারের তিন জন ছিলেন মেলবোর্নেও। চোটের জন্য শামি ছিলেন না। আর ইশান্ত এখন ভারতীয় দল থেকে অনেক দূরে।
ইশান্তের মতোই ভারতীয় দল থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে চেতেশ্বর পুজারা, অজিঙ্ক রাহানেদের। ক্রিকেটার পরিবর্তন যে কোনও দলের জন্যই স্বাভাবিক। দলে এসেছেন যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমন গিল, আকাশ দীপ, ওয়াশিংটন সুন্দরের মতো তরুণেরা। পালা বদল স্বাভাবিক। পরিবর্তদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবু কোহলির সেই ভারতের সঙ্গে রোহিতের এই ভারতের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। কোচ হিসাবে দ্রাবিড়ের শেষ টেস্ট সিরিজ় ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। কেপটাউন টেস্টে বুমরাহ, সিরাজ, মুকেশ কুমার এবং প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ টেম্বা বাভুমার দলকে দু’ইনিংসে অলআউট করেছিল যথাক্রমে ৫৫ এবং ১৭৬ রানে। সেখানেও ছিলেন না শামি। এ জন্যই অমিলটা আরও বেশি করে চোখে লাগছে। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে লেগেছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও লাগছে।
অমিলের শুরুটা হয়তো সাজঘর থেকেই। তখন ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। এখন গৌতম গম্ভীর। ক্রিকেটজীবনে দ্রাবিড় রক্ষণাত্মক ব্যাটার হিসাবে পরিচিত ছিলেন। গম্ভীর ছিলেন আগ্রাসী মেজাজের। অথচ কোচ হিসাবে দ্রাবিড় দলকে কখনও রক্ষণাত্মক হওয়ার পরামর্শ দিতেন না। ক্রিকেটারদের স্বাভাবিক খেলার স্বাধীনতা দেন। গম্ভীর নির্দেশের জালে কোহলি, রোহিতদের বেঁধে ফেলেছেন তা নয়। তবু ভারতীয় দলকে মাঠে রক্ষণাত্মক দেখাচ্ছে। পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে নেতৃত্বের দর্শনেও। কোহলি পাঁচ বোলার নিয়ে খেলার পক্ষে ছিলেন। সব সময় প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের আক্রমণ করার চেষ্টা করতেন। রোহিতও পাঁচ বোলার নিয়ে খেলছেন। কিন্তু প্রতিপক্ষকে সারাক্ষণ চাপে রাখার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না তাঁর নেতৃত্বে।
রবি শাস্ত্রী, দ্রাবিড়দের সময় প্রতিটি টেস্টে প্রতিপক্ষের ২০টি উইকেট নেওয়াই থাকত ভারতীয় দলের মূল লক্ষ্য। প্রতিপক্ষ যত রানই করুক, দু’বার অলআউট করতেই হবে। সেই মানসিকতা দেখা যাচ্ছে না গম্ভীর জমানায়। ভারতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তাঁর কোচিংয়ের কোনও উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা ছিল না। আইপিএলে লখনউ সুপার জায়ান্টস এবং কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে সাফল্য পেয়েছেন মেন্টর হিসাবে। টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট ক্রিকেটের পার্থক্য নিশ্চিত ভাবে অজানা নয় গম্ভীরের। তবে পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর দুর্বলতা স্পষ্ট অনেকটাই। সে ঘরের মাঠে হোক বা বিদেশে। পিচের চরিত্র অনুযায়ী বোলিং আক্রমণ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে চারটি টেস্টের প্রতিটিতে বোলার পরিবর্তন করেছে ভারতীয় শিবির। বুমরাহ এবং সিরাজ বাদে সবাইকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলানো হয়েছে। পার্থে খেলেন হর্ষিত রানা এবং ওয়াশিংটন। অ্যাডিলেডে ওয়াশিংটনের জায়গায় খেলানো হয় রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে। সাফল্য না আসায় ব্রিসবেনে খেলানো হয় আকাশ এবং জাডেজাকে। বাদ পড়েন হর্ষিত, অশ্বিন। মেলবোর্নে আবার ফিরিয়ে আনা হয় ওয়াশিংটনকে। তার আগেই অবসর নিয়ে নেন অশ্বিন। আবার নীতীশ কুমার রেড্ডি সব টেস্ট খেললেও তাঁকে বোলার হিসাবে সে ভাবে ব্যবহার করাই হচ্ছে না।
শুধু বোলার পরিবর্তন নয়, তাঁদের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মুন্সিয়ানা দেখাতে পারছেন না রোহিত। মেলবোর্নে বুমরাহ বল করেছেন ৫৩.২ ওভার। আর তিন অলরাউন্ডার মিলিত ভাবে ৬৪ ওভার বল করেন। বুমরাহের উপর রোহিতের অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ার কারণ অন্যদের ব্যর্থতা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোলারদের খেলানো হলেও প্রত্যাশিত সাফল্য পাচ্ছেন না কেউ। বোলিং কোচ মর্নি মর্কেলকে এক রকম জেদ করেই নিয়ে এসেছেন গম্ভীর। বোলারদের সাফল্যের পথ দেখানোর দায়িত্ব তাঁর। মর্কেলের ভূমিকা নিয়েও তাই প্রশ্ন উঠছে।
গম্ভীরের কাজ কঠিন করেছে রোহিত, কোহলি, শুভমন গিল, ঋষভ পন্থদের ফর্মে না থাকা। প্রথম টেস্টে শতরান ছাড়া কোহলি অস্ট্রেলিয়ায় রান পাননি। রোহিত মিডল অর্ডার হোক বা ওপেনিং, সব জায়গাতেই এক রকম। শুভমন খেলতে পারছেন না। পন্থ প্রতি ইনিংসেই অবিবেচকের মতো আউট হচ্ছেন। তবু তাঁদের প্রথম একাদশের বাইরে রাখতে পারছেন না গম্ভীর। মেলবোর্নে শুধু শুভমন খেলেননি। ভারতীয় দলের ব্যর্থতার দায় শুধু গম্ভীরের নয়। তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেও আড়াল করা যাবে না সিনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যর্থতা। ভারতীয় দলকে লড়াই করতে হচ্ছে প্রায় অর্ধেক ব্যাটিং এবং অর্ধেক বোলিং নিয়ে। কোহলির আগ্রাসী মেজাজ বা রোহিতের সতীর্থের উপর রেগে যাওয়া দিয়ে আর যাই হোক ম্যাচ জেতা যায় না। পরিকল্পনার অভাবের পাশাপাশি সিদ্ধান্তহীনতার ছাপ সর্বত্র। ভারতীয় ক্রিকেটের পালাবদলের সময় বোধহয় আরও বেশি সতর্ক এবং দায়িত্ববান হওয়া উচিত ছিল সকলের।
গত অস্ট্রেলিয়া সফরে কোহলির পিছিয়ে থাকা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সিরিজ় জিতিয়েছিলেন রাহানে। এ বার বুমরাহের নেতৃত্বে এগিয়ে থাকা পিছিয়ে পড়েছে রোহিতের নেতৃত্বে! এই অমিলটাও দৃষ্টিকটূ দেখাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy